অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

পাপিয়া জেরীনের গপ্পো সপ্পো

পর্ব ২

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০১৯

ঘ্রাণজনিত

আমার বয়স যখন চল্লিশ দিন, তখন আম্মু চাকরিতে জয়েন করতে গেল বরিশাল। যাবে, জয়েন করবে— এক সেকেন্ড দেরি না করেই রওনা দেবে। বিশাল লঞ্চের ভিতরে সে বসা, লজ্জায় নড়াচড়া করতে পারতেছে না। কারণ তার শাড়ি-ব্লাউজ সব দুধে ভিজে যাইতেছে। পাশে কোথাও নাকি কোনো দুধের বাচ্চা কানতেছিল, সেই শব্দে দ্বিগুণ বেগে ফিনকি দিয়া দুধ পড়া শুরু হইল। এখন সে কী করবে? ব্যাগ থেকে নতুন কাপড় বের করে বুকে চাপ দিয়ে রাখছে।

আর অন্যদিকে আমি মুন্সীগঞ্জে, মুখে কিছুই নিতেছি না। মিছরির পানি, ল্যাক্টোজেন কিছুই না। একদিন পার হওয়ার পর আমি নাকি তাকানোও বন্ধ কইরা দিছি। নড়াচড়া বন্ধ, শুধু মাথার তালুতে টিকটিকিটা টিক্টিক্ করতেছে। দুইদিন পরে আইসা আম্মু দেখে, আমারে ঘিরা খালারা আর নানু বসা। আইল্যার আগুনে তারা আমারে স্যাঁক দিতেছে, কিন্তু আমি চোখও মেলি না— মুখেও কুলুপ। আম্মু কাছে আসতেই আমার শরীরে কাঁপুনি— নানু বলতেছিল, দেখ! মায়ের ঘ্রাণ পাইছে। আম্মু আমারে বুকে জড়ায়া ধরলে। দুধ দেয়ার সাথে সাথে ম্যাজিক! মুখে দুধ নিয়া আমি চোখ মেললাম— রংধনুর মতো চোখের মণির রং চেইঞ্জ হইতে শুরু করল।

এই ঘটনা বহুবার শোনা। একটু বড় হওয়ার পরের ঘটনা আমার নিজেরই মনে আছে। বৃষ্টি হইলে দুপুরবেলা আম্মুর পেটের ভিতর গুঁইজা গল্প শুনতাম। একটা সময় শীত করলে আম্মু গায়ে কাঁথা দিতো, শ্বাস নেয়ার জন্য মাথার কাছে একটু খোলা। আম্মুর শরীরের গন্ধটা অদ্ভুত, শশা-মেথী-চন্দনের একটা তিনমিশালি গন্ধ।

শীতের সময় লেপের ভিতর আম্মুরে জড়ায়ে ধরলে সেই একই গন্ধ! আম্মু সেহরির সময় উঠতো। অনেকক্ষণ গন্ধটা থাকতো না, আবার লেপে ঢুকলেই সেই সুগন্ধ। এই গন্ধটা আমি ভুলতে পারি না, মনে হয় তার পেটের ভিতর থেকা বাইর হয়। আম্মুর সাথে এখন আর শোয়া হয় না। কিন্তু তার জামা কাপড়ে আমি লুকায়ে ঘ্রাণ নেই। হাতমুখ ধোয়ার পর তার ওড়নায় মুখ মুছি। ঘুরান দিয়ে সে ওড়না হাতে নিয়া চিৎকার করে, এইমাত্র ওড়নাটা শুকনা আছিলো! ভিজাইলো কে? কোন শুওরের বাচ্চায়.... ব্লা ব্লা ব্লা। আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারি না, একটু ভয় ভয়ও লাগে।

খুব শীতে আমি আমার বাচ্চাকাচ্চা নিয়া লেপ-কাঁথা গায় দিয়া শুই। ঝুম বৃষ্টিতে ওদের জড়ায়ে ধরে গল্প করতে চাই। ওরা আমার হাত সরায়ে দেয়, গল্পও শুনতে চায় না— ইউটিউবে কীসব প্রাঙ্কটাঙ্ক দেখে। ওরা ঘুমাইলে আমি ওদের চুলে বিলি দেই, শরীরের ঘ্রাণ নেই। দুজনের শরীরেই আলাদা আলাদা গন্ধ। আমার অদ্ভুত ভালো লাগতে থাকে। ঘুমের ঘোরে মনে হয় আমার খাটে দুইটা না, আরো দশবারোটা বাচ্চা— তখন নানুর কথা মনে আসে।

আমার নানু শেষ বয়সে একলা ঘুমাইতেন। কিন্তু তার বিছানার চারপাশে পাঁচ-ছয়টা বালিশ রাখতেন। সবাই এই বালিশের স্তূপ দেইখা হাসতো। উনি বলতেন, রাতে মশারি চাপ দিতে এইসব বালিশ রাখি— মশারি উইঠা যায়।

পরে একদিন বললেন সত্য কথা। উনার দশটা ছেলেমেয়ে। অন্তত চার-পাঁচজন বাচ্চা নিয়া না শুইলে ঘুম আসতো না তার। সে বলছিল, তার প্রত্যেকটা বাচ্চার শরীরের গন্ধ আলাদা, তেমনি বালিশগুলিরও। আমি বিশ্বাস করছিলাম।

সন্তান ও মায়ের মনে হয় ঘ্রাণজনিত যোগাযোগ থাকে। বিজ্ঞান বলতে পারবে কী যোগাযোগ। কিন্তু আমি প্রিয় মানুষেরও শরীরের গন্ধ পাই। বাতাসে সেই রেণু আসে। আমার শরীরেও তার ঘ্রাণ! আমার চুলে- নখে-পায়ে-মুখের ভেতর... সবখানে!

দুই.
আমার জন্য প্রথম প্রেমপত্র আসে যখন আমার বয়স বারো। প্রেমপত্র আমার ছোটখালা পড়তে থাকে আর আমি, আমার নানু আর আমার মা বইসা শুনতে থাকি। আমার আম্মুর কপাল ঘামতেছিল সেইদিন, স্পষ্ট মনে আছে। প্রেমপত্রের শুরুটা ছিলো এইরকম— আমার রজনীগন্ধা...

আমি একটু অবাক হইছিলাম। কারণ ছেলেটা ছিল জন্মান্ধ। আমি তখনও জানতাম না, অন্ধের ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়। ছেলেটার নাম রমজান, সে আম্মুর ছাত্র। আম্মু ওরে ব্রেইল শিখাইতো। চিঠিতে রমজান বলছিল, ‘তুমি অফিসে ঢোকার সাথে সাথে আমি টের পাই, কী তীব্র সুবাস!`

পরের ঘটনা কষ্টকর, ছেলেটাকে বেত দিয়া খুব মারা হইছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হইলো, আমিও রমজানের গায়ের সুবাস আলাদা কইরা চিনি। ওর কথা বলার সময় চোখের মণিগুলা উপরের দিকে উইঠা যাইতো, ঠোঁটের কোনায় আইসা থুতু জইমা সাদা হইয়া থাকতো। ওর গায়ের গন্ধটা অনেকটা নিউজপ্রিন্ট কাগজের গন্ধের মতো।

রমজান এখন মোক্তারপুর ব্রীজের সামনে ভিক্ষা করে। তিনমাস আগে আমি গাড়ির ভিতর থিকা হাত বাড়ায়া ওরে বিশটাকা দিছিলাম। সে আমারে দোয়া করল। আমার মনটা খুব খারাপ হয়া গেল, রমজান আমার গায়ের গন্ধটা টের পায় নাই অথবা ভুইলা গেছে।
 
নাকি সেই গন্ধটা আমি হারায়া ফেলছি!