অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

পাপিয়া জেরীনের গপ্পো সপ্পো

পর্ব ৬

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০১৯

এই দৃশ্য আমার মনে নাই, কিন্তু আম্মু এমন করে বলে, মনে হয় আসলেই আমরা তাকায়ে আছি দুইজন দুইজনের দিকে আর চোঁ চোঁ করে আম্মুর দুধ খাইতেছি। সিমু (আদরের নাম মো) আমার চাইতে এক বছর আট মাসের ছোটো, ও ওর আম্মুর দুধ না খেয়ে আমার আম্মুর দুধ খাইতো। সবাই বলে একই মায়ের দুধ খাওয়াতে আমাদের দুইজনের গলার স্বর ঠিক একই রকম হইছে। এমনকি মরণ কাকু, যিনি অন্ধ কিন্তু গলা শুনলে ঠিকঠাক নাম বলে দিতে পারে, তারেও আমরা কনফিউজ করে দিতাম।

হ্যালো মরণ কাকু! বললেই হকচাকায়ে যাইতো সে।
কে? পুপ্পু? ও... সিমু? কে বলো তো তুমি? দেখি আবার ডাক দেও!
আমরা তার কাছে না গিয়া খালি হাসতাম।

মজার বিষয় হইলো, আম্মুও ফোনে প্রথম দিকটায় কনফিউজ হয়ে যাইতো, কার সাথে কথা বলতেছে সে। আরো অনেক ফোনালাপে আমরা দুইজনই অংশগ্রহণ করছি কিন্তু অপর প্রান্তের লোকগুলা বুঝতো না। যাই হোক, ও সিমু, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, সাথে আমার খালাতো বোনও। আমাদের দুইজনের সবচাইতে পুরানো স্মৃতি হইলো হাগু বিষয়ক, আমরা তখন অনেক ছোটো, প্যানে বসে হাগু করতে পারি না। নানাভাই আমাদের জন্য দুই জোড়া ইট উঠানের শেষ প্রান্তে নিয়া সেট করে দিলো। বিশাল উঠানটা শেষ হইছে একটা ছোট্ট খালের পাশে গিয়া, সেই খালপাড়ে বইসাই আমরা দুইজন হাগু করতাম। খালের উপর কালভার্ট থেকে ফাজিল কতগুলা পোলাপান আমাদের হাগু নিয়া শ্লোগান দিতো:

পুপু হাগু দিয়েছে
লাল গু খেয়েছে।

সিমু হাগু দিয়েছে
লাল গু খেয়েছে।

আমাদের এক্চ্যিলি লজ্জার বয়স ছিলো না তখন, কিন্তু টেন্সড থাকতাম হাগুর কালার নিয়া, আসলেই লাল কিনা বা কেন ওরা `লাল গু` বলতেছে এইসব আর কি। একটা সময় ত্যাক্ত হইয়া আমরা ঠিক করলাম যে, খালপাড়ে আর হাগু করবো না।

উঠানের দক্ষিণ কোনায় একটা পুরানা আমলের পায়খানা ছিল, তার পাশেই বিশাল জাম গাছ। সেইখানে ভূত ছিল বিধায় কেউ যাইতো না। কিন্তু আমরা নিরুপায়, প্রথমে জাম গাছের শিকড়ে বসে হাগু করতে শুরু করলাম, পরে আস্তে আস্তে সাহস করে সেই প্রাচীন পায়খানায় ঢুকে গেছিলাম। বিশাল উঁচু এক পায়খানা, নীচে স্লোপ। এইখানে পাশাপাশি বসার সিস্টেমও নাই। আমি আর সিমু ঠিক করলাম দুইজন পরস্পরের পিঠ ঠেকায়ে উল্টা হয়ে বসবো। মনে পড়ে, সেইখানে দুই তিনটা পেটমোটা মাছি আসতো ডিস্টার্ব করতে,ওরা মাতালের মত স্লো স্লো উড়তো। একবার আমাদের শরীরে বসতো, একবার স্লোপের নীচে, একবার গিয়া দেয়ালে। আমরা ওগুলারে দেয়ালে থাপ্পড় দিয়ে আধমরা করতাম, শেষে ওদের পাছা দিয়ে ঝাড়ুর কঠি ছোট ছোট করে ভেঙ্গে ঢুকায়ে দিতাম। মাছিগুলা কাঠিগুলা নিয়ে আমাদের পায়ের কাছে পিল পিল করতো, কাঠির ওজনে মাছিগুলারে মনে হইতো ক্লান্ত ভারবাহী জেট প্লেন।

এরপর বড় হওয়ার সাথে সাথে পায়খানা বিষয়ক সমস্যা সল্ভ হইছিলো মনে হয়, কারণ এ নিয়া আর কিছু মনে পড়ে না।

আমাদের স্কুলজীবন আমাদেরকে আলাদা করে দিছিলো, ও ভর্তি হইছিলো ঢাকায়।ওর স্কুলের নাম ছিলো কথাকলি বিদ্যানিকেতন। আমার স্কুল মুন্সীগঞ্জে। বিশাল ছুটিতে বা বিয়েশাদিতে অনেকদিন পর পর একসাথে হইতাম আমরা। এবং দীর্ঘ বিচ্ছেদের কারণে হয়তো আমাদের তখনকার কর্মকাণ্ড হয়ে যাইতো অস্বাভাবিক রকমের উদ্ভট।

একবার স্কুলের ছুটিতে গেলাম মাদারীপুর, আমার নানীর বোনের বাড়ি, নাম সুরাইয়া নানুমণি। আমরা দুইজন সেইখানে ঘাটলা পাইলাম একটা বিশাল। দুইজন দুইটা ছিপ নিয়া বসলাম, কিন্তু মাছ উঠলো না। সিমুর আম্মু, মানে আমার মেঝো খালা বারবার আসে দেখতে, কারণ সিমু সাঁতার জানে না। আমরা টানা তিনদিন পুকুর সেই পাড়ে ছিলাম সেইবার।নাওয়া খাওয়া এক জায়গায়। পুকুরপাড়ে একটা বিশাল তালগাছের নীচে চকি পাতা, তার উপর পাটি পাতা। আমরা ঘুম দিতাম সেইখানে।ঘুমানোর পর আমাদেরকে কেউ হয়তো ঘরে নিয়া আসতো। মনে আছে, সিমু পানির কাছে আইসা বসা আর আমি কোমর পানিতে-- ও বললো, দ্যাখো পানিতে ডিম! আমি আরেক সিড়ি নীচে দেখি সত্যিই গোল করে রাখা দশ বারোটা ডিম--পুরাই গোল পিং পং বলের মতো আর ধবধবা সাদা। আমি একটা একটা করে সিমুকে দিলাম তারপর দুইজনেই গেলাম সুরাইয়া নানুমণির কাছে। উনারে বললাম, ডিম ভেজে দ্যাও। সে তো অজ্ঞান হয় হয় অবস্থা। আমরা তারে যতই বলি --এগুলা রুই মাছের ডিম, সে ততবার খেচকি দিয়া ওঠে। পরে রোমু মামা ইনভেস্টিগেট করে বের করলো --ওগুলা কাছিমের ডিম। আমার এখনও অবশ্য বিশ্বাস হয়না, কোনো কাছিম ঘাটলায় এতোগুলা ডিম পাড়তে পারে। যাই হোক সেইবারের বেড়ানোটা আমাদের জন্য স্মরণীয় হয়ে রইলো। এখনও কোনো কোনোদিন হঠাৎ সেই ঘাটলা স্বপ্নে দেখি, আর দেখি একটা একটা করে ডিম ওর কোঁচড়ে দিতেছি। সিমুও দেখে কিনা জানি না, দেখে হয়তো।

আরেকবারের একটা অদ্ভুত স্মৃতি আছে বাদল মামার বিয়ের, উনার শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা খাট ও একটা সোফাসেট উপহার আসছিল। সবাইর চিল্লাচিল্লি অগ্রাহ্য করে আমরা দুইজন সেই ফার্নিচার ভর্তি পিকআপে উঠছিলাম, পিকআপ আসবে মোহাম্মদপুর থেকে মুন্সীগঞ্জ। আমাদের মায়েরা রাগে কাঁপতেছিলো আর আমরা নির্বিকার ভঙ্গিতে পিকআপের পিছনে রাখা ফোমে বইসাছিলাম। গাড়ি ছাড়তেই সন্ধ্যা নামলো। আমরা ফোমে শুইয়া আছি, আকাশ আমাদের উপর দিয়া চলতেছে, ট্রেনের মতো মেঘ ঘুরতেছে খালি। আমরা গান ধরলাম, তারপর নামলো বৃষ্টি। আমরা পলিথিন গায়ে দিয়া কাঁপতে কাঁপতে তখনও কী হাসতেছিলাম! তখন সম্ভবত ক্লাস থ্রি-ফোর এ পড়ি। অথচ মনে হয় এইতো সেইদিনের, কী তাজা সেই বৃষ্টির পানি, এখনও শরীরে এসে বিঁধতেছে।

বড় হওয়ার পরও আমাদের অদ্ভুত কাজকাম একটা সময় পর্যন্ত ছিলো। একসময় জাদুবিদ্যা নিয়া ট্রাইফাই করছিলাম। ধারাবাহিকভাবে আমরা পরীক্ষামূলক কাজ করতাম এইসব নিয়া। একবার আমার ৭/৮ জন বন্ধু (ছেলে) আসছিলো বাসায়। ওদের মধ্যে একজনরে আমরা বশ করার জন্য চায়ে একটা জিনিস মিশাইছিলাম। সবার কাপ নরমাল আর জিনিসটা ছিলো মগে। ট্রে নিয়া ঢোকার সাথে সাথেই মগ ছিনায়ে নিছিলো রাজন(অভ্যিয়াসলি ওইটা রাজনের জন্য ছিলো না)...এই দৃশ্যে আমি আর সিমু ডুকরায়ে উঠছিলাম। এই শিক্ষা হওয়ার পর আমরা এইসব জারিজুরি বাদ দিছিলাম।

এখন আমি আর সিমু অদ্ভুত সব স্মৃতি নিয়া বসে থাকি। আমাদের খুব একটা দেখা হয় না আজকাল। মাঝেমধ্যে পুরানো সেই স্মৃতিগুলা স্বপ্ন আকারে আসে। ও আমাকে ম্যাসেজ দেয়... তোমার কি মনে আছে, আমরা একবার চাঁদের আলোতে গোসল করতেছিলাম, তখন আকাশ থেকে একটা পাথর পড়ছিলো গায়ে?
আমি উত্তর দেই... হু
আচ্ছা দি, তোমার মনে আছে, পারভীন আন্টির বিয়েতে আমরা শেখ হাসিনার ঘোমটা বারবার সরায়ে তার খোঁপা খুলে দিতেছিলাম। কী সুন্দর সিল্কি লম্বা চুল! অথচ, উনি প্রতিবারই আমাদেরকে আদর করে দিতেছিলেন, মনে আছে?
আমি আবারও বলি... হু
আমি সংক্ষেপে সব উত্তর দিতে থাকি। আর ও বলতেই থাকে। ও স্মৃতি নিয়া বসে থাকে দূরে, আমিও শ্লথের মত আগাই পিছাই। আমার নিজেরে খুব অসহায় লাগে, মনে হয় আমরা কেন আর ফিরে যাইতে পারি না শৈশবে, কেন আর আগের মতো কিছু নাই!
আমার মাঝেমাঝে কেন যানি নিজেরে ঐ প্রাচীন পায়খানার কাঠিবিদ্ধ মাছির মতো মনে হইতে থাকে, অসহায়, শ্লথ!

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী