রাহাত খান

রাহাত খান

পারভীন সুলতানার গদ্য ‘আমার ছোট ময়না’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০২৪

চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত হাওর। মাঝখানে দ্বীপের মতো গ্রাম, বর্ষাকালে জল থই থই সমুদ্র যেন। সেই জলের আয়নায় ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে ছয়শো বছরের পুরনো খাঁসাব বাড়ি। জল আর নানা গাছ গাছরার সবুজে জড়াজড়ি এই বাড়ির সূতিকাগারে ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের এক সুরেলা ভোরে জন্মাল আমার ‘ছোট ময়না’ বাংলাদেশের বরেণ্য কথাশিল্পী রাহাত খান। বাবা আলী এমদাদ খান, মা রহিমুন্নেছার ছোট ছেলে রাহাত। আমার মায়ের পিঠাপিঠি ছোট ভাই রাহাত । আমরা ডাকতাম ছোট ময়না।

বাড়ির সবচেয়ে ছোট আর আদরের ছেলে। পড়াশোনার জন্য কিন্তু তাগাদা দিতে হত না। আম্মার কাছে শুনেছি--তারা দু’ভাইবোন একসঙ্গে স্কুলে যেতো, পথে ছোট ময়না যে নিপাট ভদ্র হয়ে থাকতো মোটেও তা নয়। বোনের সাথে দুস্টুমি, খুনসুটি, অজানা সুদূরে একটা ঢিল ছোঁড়া, গাছের ডাল টেনে ধরা, লাফালাফি সবই চলতো, তবে স্কুলে ঢুকেই সুবোধ বালক, ক্লাসে মনোযোগি ছাত্র।

প্রত্যন্ত সবুজ গ্রাম আর জলের তরল পাটাতন ডিঙ্গিয়ে শৈশবে লেখা-পড়ার জন্য চলে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হন ক্লাস সেভেনে। স্কুলে পড়ার সময় ছোট ময়নার মিতালী গড়ে ওঠে বৃটিশ আমলের পুরনো শহর ময়মনসিংহ আর ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে। এছাড়া শৈশবের টলমলে জলরাশি, নিজ গ্রামের সাংস্কৃতিক আবহ--কিচ্ছা, গীত, পালাগান, ষাঁড়ের লড়াই তার বোধে লেখক হয়ে ওঠার স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল।

স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ছোট ময়না আনন্দমোহন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাশ করে যোগ দিলেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে প্রভাষক হিসেবে।

মামার বাসাটা রেললাইনের ধারে। নদীর মতো রেলগাড়িও বহমান আর গতিশীল। ট্রেনের হুইসেলে সবার মন বোধহয় ‘অপু‘ আর ‘দূর্গা‘র মতো উদাস হয়ে ওঠে। মামার লেখার টেবিল থেকে ট্রেনের কু-ঝিক ঝিক বাঁশি শোনা যায়। ট্রেনের জানালায় কত বিচিত্র মানুষের মুখ! তাদের জীবনের না-জানা গল্প মামার কলমে প্রাণ পায়। রাহাত খানের কলম গল্প লিখতে শুরু করে।

একসময় ময়মনসিংহের পাঠ চুকিয়ে ছোট ময়না ঢাকাগামী ট্রেনে ওঠেন। ঢাকা জগন্নাথ কলেজে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ঢাকায় থিতু হয়ে তিনি লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক লেখা। বাংলাদেশের পাঠক এক নতুন শক্তিশালী কথাশিল্পীকে পান।

আমরা তখন ছোট ময়না ডাকলেও আমাদের ছোট ময়না কিন্তু কালো নয় মোটেও। ফরশা, একমাথা ঝাকড়া চুলের মামাকে রাজপুত্রের মতো লাগতো। তার কলম ময়না পাখির মতোই মিষ্টি কথা বলে। ক্লাস ফোরে কি ফাইভে পড়ি। তখন থেকেই আমরা তার লেখার ভীষন ভক্ত। তাঁর ‘দিলুর গল্প’,‘শাদা কাকু কাল কাক’ এর মন্ত্রমুগ্ধ পাঠক আমরা ছোটরা। দিলু আর গজার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছি। পরস্পরকে আমরা বকাঝকাও করি দিলুর গল্পের স্টাইলে--- ইলিম্পু, ডিলিম্পু, য়স্কট, টস্কট অর্থাৎ ‘ইডিয়ট’। ভাইবোনদের মধ্যে দিলুর গল্প পড়ার জন্য কাড়াকাড়ি হতো। বেচারা বই অল্পদিনেই যেতো ছিঁড়ে। প্রথমে সৌজন্য কপি মামার কাছ থেকে পাওয়া, এরপর আমরা নিজেরাই কিনে নিতাম।

একটা স্পর্শ কাতর ঘটনা এখানে না বল্লেই নয়। মামা পড়তেন আনন্দমোহন কলেজে। তখন তার বি.এ. পরীক্ষা চলছে। নানু ছিলেন লিভার এর রোগি। প্রচণ্ড অসুস্থ নানু। ডাক্তার আশা ছেড়েই দিয়েছেন, নানু নানাকে বারণ করলেন ছেলেকে যেন তার অসুখের কথা না জানানো হয়। সন্তানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। মামার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নানু মারা গেলেন। ছোট ময়নাকে জানানো হলো না। ময়মনসিংহ শহর থেকে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল থানার প্রত্যন্ত ‘জাওয়ার’ গ্রামে যেতে প্রায় দেড়দিন লেগে যেতো। মামার বি.এ পরীক্ষা শেষ হলে বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু মায়ের প্রিয় মুখের সাথে আর দেখা হলো না তার।

কথা শিল্পী রাহাত খান আমার প্রিয়তম লেখক। মনে হয় না আমি তার কোন লেখা ‘মিস’ করেছি’। মামা তার প্রতিটি বই পরম স্নেহে আমাকে দিয়েছেন, মমতা ভরে তাতে লিখেছেন ‘ স্নেহের রুবীকে’ ছোট মামা’। বড় হতে হতে টের পাই ছোট ময়নাকে আমিও যে কখন ছোট মামা ডাকতে শুরু করেছি।

মামা জগন্নাথের ক্যাম্পাস ছেড়ে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় যোগদান করলেন’ তার ছোট ছোট হাতের একটু বাঁকা লাইনের নান্দনিক অক্ষরগুলো আমার মুখস্ত। ইত্তেফাকের নিয়মিত কলাম ‘চতুরঙ্গ’ এর লেখক ‘সুহৃদ’ তিনি। সত্যিকার অর্থেই আমার মামার মন অনেক সুন্দর আর উদার। মানবিক ও অর্থনৈতিক যে কোন সমস্যায় বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনকে নিরলস সাহায্য করেছেন তিনি। বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন আমার মামা।

মামা ঢাকাবাসি হলে তার বাসা হয়ে ওঠে আমাদের মামা বাড়ি। তার ছেলেমেয়েরা আমার ভাই, বোন, বন্ধু। নীনা মামী আমাদের মামী হলেও যেন প্রিয় সখি। আমরা গল্পে গল্পে আর আড্ডায় মেতে কোন কোন দিন মামা বাসায় থাকলে সচকিত হই!

মামা লিখছেন! গভীর মগ্ন প্রিয় লেখকের সেই ধ্যানীরূপ অপলক চেয়ে দেখি।

মামা অসুস্থ হলে তার ভাগ্নে ভাগ্নিরা আকুল হয়ে ছুটে যাই। শুধু বলার জন্য নয়, এটা খাঁটি সত্য মামা তার ভাগ্নে ভাগ্নিদের সন্তানের মতো মমতা আর ভালোবাসা দিয়েছেন। কখনো বা তার দায়িত্ববোধ সন্তানের চেয়েও বেশি পালন করেছেন। এ জন্য আমার উদার মামাতো ভাইবোনরা ঈর্ষান্বিত নয় এর পেছনে আমার নীনা মামীর অবদান অনেক বেশি। সন্তানদের তিনি এভাবেই মানুষ করে গড়ে তুলেছেন।

মামার সঙ্গে আমার রয়েছে আশ্চর্য কিছু মিল। আমরা দুজনই জন্মেছি নদী আর হাওর ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম জাওয়ারের খাঁসাব বাড়ির সূতিকাগারে। আমার শৈশব কৈশোর, যৌবন কেটেছে ব্রহ্মপুত্র নদের কূল ঘেষা পুরনো শহর ময়মনসিংহে। শুধু তাই নয়-- মামা ঢাকা চলে যাওয়ার পর রেললাইনের ধারের বাসাতেই থাকতে শুরু করি আমরা। আমার আব্বা ছিলেন নাসিরাবাদ কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। মামার রেখে আসা টেবিলেই লেখার হাতে খড়ি আমার। বিস্তৃত হাওরের জলজ সৌন্দর্য, ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত, ট্রেনের কু-ঝিক ঝিক বাঁশি আমার বোধেও লেখক হওয়ার বীজ বুনে।

প্রিয় ছোট ময়না, আমার প্রিয় কথা সাহিত্যিক রাহাত খান। মামা বাংলা কথাশিল্পকে রাঙিয়েছেন তার নান্দনিক লেখনিতে আর আমি তার ভাগ্নি কলম তুলিতে রঙ লাগাচ্ছি। কথাকে শিল্প করার তাড়না আমার রক্তেও যে রয়েছে। রাহাত খানের লেখা আমাকে প্রাণিত করে। আমার ছোট ময়না তুমি দীর্ঘজীবী হও আর কথাকার রাহাত খান কালজয়ী হোক তার মেধাবী সাহিত্য সৃষ্টির কৃতিতে।

আমার এই লেখা শেষ হওয়ার কিছু দিন পর----২৮ শে আগস্ট ২০২০ রাত ৮টায় পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে মামা না ফেরার দেশে চলে যান। আমরা আমাদের প্রিয় মামাকে হারিয়েছি আর বাংলা সাহিত্য হারিয়েছে এক শক্তিমান কথাশিল্পী ও ধীমান সাংবাদিককে। সৃজনশীল মানুষের মহৎ কাজের মৃত্যু নেই। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী গুণীজনের সৃষ্টিকে বয়ে বেড়ায় কাল থেকে কালান্তরে। আমার ছোট ময়না থাকবেন আমাদের অন্তরে আর লেখক রাহাত খান পাঠকের হৃদয়ে।