প্রণব আচার্য্যর গল্প ‘তুমি আমায় ডেকেছ’
প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২৫
সজল রুহিকে ভালোবাসতে চায়।
যদিও সজল তখনো নিশ্চিত নয়, এ ভালোবাসা অথবা ভালোবাসতে চাওয়া তাৎক্ষণিক, নাকি অনেক দিনের জন্য। সজলের এই ভালোবাসতে চাওয়া রুহির প্রতি প্রথম কিংবা একমাত্র নয়। কিন্তু আমরা বুঝে যাই, রুহির প্রতি জন্মানো এ অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী। মানে সে রুহিকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সজল রুহিকে প্রপোজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সজল যখন ভালোবাসতে চাওয়া না-চাওয়ার দোলাচলে, রুহি তখন পরিসংখ্যান ক্লাসে ঝিমোচ্ছিল। পূর্ববর্তী রাতে সে ঘুমায়নি। সারারাত রুহি পরিসংখ্যানের একটি অংকই মেলানোর চেষ্টা করছিল। প্রণয় প্রস্তাব নিয়ে কম কালি খরচ হয়নি এ গ্রহে; সুতরাং ওদের দুজনের প্রেম কীভাবে সংগঠিত হলো সে বর্ণনায় না গিয়ে ভাবতে থাকি যে, ওরা এখন প্রেমিক-প্রেমিকা। সম্প্রতি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে উভয় পরিবারের অসম্মতি হেতু গোপনে তারা বিয়ে করে ফ্যালে। সেই সঙ্গে আমাদের যেন মনে থাকে সজল স্নাতক ফলপ্রার্থী ও রুহি চতুর্থ বর্ষের ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সজল আগে থেকেই একটা বায়িং হাউসে চাকরির ব্যবস্থা করে রেখেছিল; ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে দুজনে মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করতে লাগল।
গল্পটি এখানে শেষ করা গেলে ভালো হতো, কিন্ত তাতে গল্পটি আর গল্প থাকতো না। তাই আমরা আরেকটু ভাবতে থাকি।
যেহেতেু বিয়ের কারণে রুহি অনার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা দিতে পারেনি, যেহেতু সজল বায়িং হাউসে এন্ট্রি লেবেলে চাকরি করে, তাই আপাতত রুহির পক্ষে পড়াশোনা আর চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। আমরা এখন তাদের সংসারের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। সজল খুব ভোরে অফিসে চলে যায়, ফেরে বেশ রাতে। ফলে রুহির সঙ্গে কর্মক্লান্ত সজলের খুব একটা কথাবার্তা হয় না; যেটাকে অন্তত সাংসারিক খুনসুটি বলা যেতে পারে। বলা চলে রুহিকে সময় দেয়ার মতো সময় সঙ্গত কারণে আর সজলের নাই। ফলে রুহি বন্দি হয়ে পড়ে দীর্ঘ একাকিত্ব ও আলস্যের গহ্বরে।
প্রথম প্রথম এটা কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও একসময়ে রুহি ভেতরে ভেতের হাঁপিয়ে ওঠে। দুজনের ইচ্ছা সত্ত্বেও কেন রুহি কন্সিভ করছে না, সে বিষয়ে না ভেবে যদি ওদের বেডরুমের জানালা দিয়ে গলির দিকে তাকাই, তাহলে আমরাও একটি নির্জন রাস্তা দেখতে পাব।
ঢাকা শহরে এরকম একটা আলোকিত কিন্তু নির্জন গলি থাকতে পারে, রুহির জানা ছিল না। রাস্তাটি দুইটা ৯০ ডিগ্রি স্পষ্ট মোড় নিয়ে খানিকটা আঁকাবাঁকা হয়ে ডিআইটি রোডে মিশেছে। রুহিদের বাসার সমানে দিয়ে গলির রাস্তাটা অবশ্য সোজাসুজি। পিলারের সঙ্গে লাগানো সবগুলো বাতি ঠিকঠাক জ্বলছে। অবশ্য স্বস্তির কথা এই, মাঝখানের একটি পিলারের আলো নেই। বাতি নষ্ট। সেখানটায় অন্ধকার; বেশ অন্ধকার। কাব্যিক ভাষায় বললে, একখণ্ড অন্ধকার জমে আছে যেন রাস্তার ধারে। চোখের ভ্রম কীনা, সেই অন্ধকারে দু’একটি জোনাক পোকার টিপটিপ আলোও আছে!
শুনেছি নৈঃসঙ্গ্য বিধুর; নৈঃসঙ্গ্যময় অপেক্ষা মধুর। তবে পুনঃপৌণিকভাবে ঘটতে থাকলে তা মাধুর্য হারিয়ে ফেলে। এসব ভাবতে ভাবতে আমরা লক্ষ্য করবো রুহি এখন ফোনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করে। সেটা যে সজল নয়, তা অনুমান করা কঠিন নয়; কিন্তু রুহি-সজলের কয়েকদিন আগের কনভার্সেশন থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব যে, তারা পরস্পরকে নিয়ে সুখি। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। অথচ রুহি কখনো আধশোয়া হয়ে, কখনো পা নাড়িয়ে, কখনো চেয়ারে হেলান দিয়ে, কখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সকাল সন্ধ্যা ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলে।
এর মধ্যে এক বিকেলে আমরা আবিষ্কার করবো রুহি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই বাইরে যাওয়া অন্যান্য দিনের মতো নয়; মানে বাজারসদাই বা প্রয়োজনীয় টুকিটাকির জন্য যে রকম সে বাইরে যেত। রুহি আজ কিছুটা নার্ভাস। আবার ভেতরে ভেতরে উৎফুল্লও। ফোনের অন্যপ্রান্তের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে রুহির দিনগুলো ভালোই কাটছে। বিরামহীন অবসর ও একাকিত্বের যন্ত্রণা নেই। সাজসজ্জা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। রুহির চোখেমুখে আনন্দের শিশির।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। রাত গভীর হতে শুরু করেছে। গলির নির্জন রাস্তাটি একবুক আলো নিয়ে পড়ে আছে। সেই আলোর মধ্যে একখণ্ড অন্ধকার কয়েকটা জোনাকপোকা নিয়ে পড়ে আছে। এ অন্ধকারও গভীর হচ্ছে, ধীর-ধীরে আরও স্পষ্ট হচ্ছে জোনাকপোকা।
রুহি বেরিয়ে পড়েছে। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। গলির অন্ধকার খণ্ডটির কাছাকাছি আসতেই আমরাও দেখতে পাই দুই চোখ বিস্ময় নিয়ে সজল দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে সে স্থির তাকিয়ে আছে রুহির দিকে। রুহিও দেখতে পেয়েছে সজলকে।
রুহির সামনে সজল ও অন্ধকারটি, যার ভেতর জ্বলছে নিভছে জোনাক আলো; ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা নেমে আসে গলির মধ্যে। রুহির মনে হতে থাকে চরাচরে আর কিছু নেই, কোথাও আর কেউ নেই; সে দেখে আলোর হাতছানি দিয়ে অন্ধকার তাকে ডাকছে; প্রথম প্রেমের বেদনার মতো ভরে ওঠে তার মন। সে সেদিকে পা বাড়ায়।























