প্রেমের পথই একমাত্র রাজপথ

শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন

প্রকাশিত : অক্টোবর ১১, ২০২০

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন বঙ্গীয় গবেষণা জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক। পুঁথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা ছিল তাঁর আমৃত্যু ব্রত। পুঁথিচর্চাকে তিনি কেবল যান্ত্রিক কর্মজ্ঞান না করে তাকে সৃজনশীল মাত্রায় উন্নীত করেছেন। ১৮৭১ সালের ১১ অক্টোবর তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার জন্মদিন।  তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন এক বহুমাত্রিক গবেষক, অসীম ধৈর্যশীল সাধক। মেধা, শ্রম, ঐকান্তিকতা, অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অজানা অথচ অপরিহার্য ইতিহাস পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল পেরিয়ে গেছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গবেষণায় তার আবিষ্কৃত পুঁথিগুলোর অনিবার্যতা এখনো অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানের স্বরূপ সন্ধানের সমান্তরালে বিশ শতকের বাঙালির আত্মসন্ধান ও আত্মবিশ্বাসের অবারিত উৎসও তিনি নির্দেশ করেছিলেন। মধ্যযুগের বিপুলসংখ্যক পুথি সংগ্রহ ও সম্পাদনায় তাঁর তথ্যাভিজ্ঞ ও তত্ত্বপূর্ণ গবেষকদৃষ্টি বাংলা সাহিত্য গবেষণায় সৃষ্টি করেছে নতুন ধারার। বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তা জাগরণে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের আবিষ্কৃত পুথিসগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যেমন খণ্ডিত ধারণা থেকে মুক্ত হয়েছে, তেমনি তাঁর পাঠ-পাঠোদ্ধার ও টীকাটিপ্পনীসমৃদ্ধ বিপুলসংখ্যক প্রবন্ধ উত্তরকালের সাহিত্য-গবেষকদের জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। তথ্য অনুসন্ধানে নিরপেক্ষতা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সাহিত্যবিশারদকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ও প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ। অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ-সমন্বয়বাদী চিন্তাচেতনার ধারক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিয়ে আরও বহুমাত্রিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি প্রায় আড়াই হাজার হাতের লেখা পুথি সংগ্রহ করে সেসব পুঁথির পাঠোদ্ধারে নিরলস শ্রম দিয়েছেন। তিনি বহু পুথি সম্পাদনার করেছেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায় ছয়শো গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন।

তার উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত পুঁথিসমূহের মধ্যে আলী রাজার জ্ঞানসাগর, শেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষ বিজয়, রতি দেবের মৃগলব্ধ, সারদা মুকুল ইত্যাদি অন্যতম। তার সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে নবনূর, সওগাত, পুজারীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য অনন্য অবদানের জন্য তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশেই শুধু নয়, ভারত উপমহাদেশের জ্ঞানসাধকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর নাম ড. সুনীতি কুমার, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নামের সঙ্গে কৃতী গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

সাহিত্য বিশারদ কেবল পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন না, সৃজনশীল, চিন্তাশীল লেখকও ছিলেন। অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ, পরিচিত, অপরিচিত সবগুলো পত্রিকায়। তাঁর লেখা যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল। তার মানস আধুনিক, অগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট। বাঙালির সেক্যুলার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি একজন পথিকৃৎ। জীবনসায়াহ্নে মানুষ হয় প্রতিক্রিয়াশীল। সাহিত্য বিশারদ হয়েছিলেন প্রগতিশীল। তাঁর সায়াহ্নকালীন অভিভাষণগুলো বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতাবিরোধী খরদীপ্ত উচ্চারণে বলিষ্ঠ। এজন্যই তিনি মনীষী, মহাপুরুষ।

বাঙালি লেখকেরা যখন পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে ও অনুরাগে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তখন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুথি সংগ্রহ, পুথির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুথি সম্পাদনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মূলত পুথি সংগ্রহ, পুথির রক্ষণাবেক্ষণ ও পুথি সম্পাদন ছিল তার জীবনের ব্রত। আজীবন, দরিদ্র ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সামান্য কেরানিগিরি করতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে ম্যাট্রিক পাস অবশ্য কম কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণেই আর অগ্রসর হতে পারেননি একাডেমিক শিক্ষায়। এরপরও সাধনার বলে, নিষ্ঠার জোরে তিনি জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। তিনি যে কাজটি করে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তা ছিল নিদারুণ কষ্টসাধ্য, এমনকি ব্যয়সাপেক্ষও। এর সঙ্গে প্রতিভা ও মেধার প্রশ্নও জড়িত ছিল, আর ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর গাঢ় ভালোবাসা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, যাকে বলে পুথি, তার আবিষ্কারক। নিজ খরচে, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে পল্লীগ্রামে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করে করে অবহেলায় পরে থাকা পুঁথি উদ্ধার করেছেন।

সেখানেই ক্ষান্ত হননি, পুথির হস্তলিপি পর্বে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, তার সম্পাদনা করেছেন, তারপর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় তা পাঠাতেন। সসম্মানে ছাপা হতো।

আমরা জানি, সাহিত্যের প্রধান উপকরণ মানুষ। মানুষের অন্তরে যিনি প্রবেশ করতে পারেন, তিনিই সাহিত্যিক, তিনিই স্রষ্টা। মানুষের অন্তরে প্রবেশের একমাত্র রাজপথ, প্রেমের পথ। ভালোবাসা ও প্রীতির পথ। তাই সাহিত্যিকের প্রথম ও প্রধান ধর্ম, মানুষের প্রতি দরদ, ভালবাসা-প্রাণঢালা ভালবাসা। দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, মানুষের প্রতি, চতুর্দিকের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি যার অন্তরে বিরাজ করে অফুরন্ত ভালবাসা ও প্রীতি। সাহিত্য বিশারতের মধ্যে এ প্রীতি ছিল। নিরলসভাবে তিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে আলোরই সন্ধান করেছেন, সে পথেই হেঁটেছেন আজীবন।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। তাই দেখি যে, তিনি পুথি অনুসন্ধানে নেমে জাত-পাত মানেননি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল কবিদের পুথি উদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন।

স্বদেশ ও স্বভাষার প্রশ্নের দ্বিধান্বিত মুসলমান সমাজকে সাহিত্যবিশারদ গ্লানির হাত হতে মুক্ত করেছেন। সাহিত্যবিশারদ বাঙালি মুসলিমকে আত্মবিনাশী মরীচিকা-মোহ থেকে উদ্ধার করেছেন, বাংলা ভাষায় মুসলিম রচিত সাহিত্যের সন্ধান দিয়ে। তিনি বাঙালি মুসলমানকে আত্মবিশ্বাসী করে তুললেন; তারা উপলব্ধি করল, তারা রিক্ত, নিঃস্ব ও প্রবাসী নয়। এদেশ তাদের মাতৃভূমি এবং বাংলা তাদের মাতৃভাষা। গভীর সমাজ বাস্তবতাবোধের বহির্প্রকাশ হিসেবে সাহিত্যবিশারদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, অভিভাষণ ও সাহিত্যপ্রয়াসের মূল্য বা অবদান অপরিসীম।

মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পথ-প্রদর্শক ও প্রেরণার উৎস হিসেবে বিশেষ মূল্যায়নের দাবি রাখেন। হিন্দু-মুসলমান ও বিভিন্ন সম্প্রদায় সমাজে যে উন্নতি ও জ্ঞান বিস্তার করছে তা আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের মনোযোগের বিষয় ছিল। তিনি মূলত পুরো বাঙালি জাতির মননের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেছেন। আবিষ্কৃত উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলোতে যেহেতু ইংরেজের কূটপ্রভাব স্পর্শ করেনি, সেহেতু সেসবে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার সজীবতা, হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা।

তার রচনা থেকে জানা যায়, ‘প্রাচীন সাহিত্য সমালোচনা হইতে আমরা আর একটি তথ্য সংগ্রহ করিয়াছি যে প্রাচীন সময়ে একই বৃক্ষের শাখাস্বরূপ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সখ্য ভাবমিশ্রিত এক দৃঢ়তর ঐক্যের বন্ধন ছিল। এই ভাবের অভিব্যক্তি তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে তা প্রস্ফুটিত ছিল। সাহিত্যক্ষেত্রে পর্যাপ্ততার প্রতিবিম্ব অঙ্কিত রহিয়াছে। কালের ধর্মগুণে আজ যুগ-যুগান্তরের সেই পবিত্র প্রীতিবন্ধন আমাদের মধ্যে শিথিল হইয়া উঠিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান বিশাল বঙ্গসমাজ বৃক্ষের দুই শাখা এবং পরস্পরের প্রতি এতো নির্ভরযোগ্য যে, কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া এক পদ অগ্রসর হওয়ার যো নাই। এই দুই শাখার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও বল সঞ্চয় না হইলে বঙ্গসমাজ কস্মিনকালেও প্রকৃত উন্নতি লাভ করিতে সক্ষম হইবে না। উন্নতি করিতেছি বলিয়া আমরা সগর্বে অঙ্গুলি দিয়া চিৎকার করিলেও অন্তত সভ্য জগৎ আমাদের সেই উন্নতির কোন অর্থ আছে মনে করিতে দ্বিধাবোধ করিবেন।’ (জ্ঞানপ্রদীপ: নির্বাচিত রচনা, পৃ. ৪-৫)

উনিশ শতকের শেষভাগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক পশ্চাৎপদ আবহে মুসলিম শিক্ষার অনগ্রসরতা লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রযুক্ত হতে না পারায় মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষার প্রসারতা এ সময় ঘটেনি। ১৮৬০ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম মানসে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময় মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদান রাখে। একদিকে জীবিকা অর্জনের জন্যে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়া, অন্যদিকে পুথি-সাহিত্য পাঠ, দেশজ শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতি তারা অনুরক্ত হয়ে ওঠে।

পুথি সাহিত্য সংগ্রহ একটি জটিল কাজ। যেখানে প্রকাশিত তথ্যের অভাব রয়েছে সেখানে জনশ্রুতি ও সাধারণ মানুষের স্মৃতি কেন্দ্র করে অগ্রসর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বহমান জীবন চর্চায় যে ভাষারীতিতে পদ শ্লোক ও সংগীত সাধারণ মানুষ ধারণ করে তার সঠিকতা যাচাই করে পুঁথি সাহিত্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। সঠিকতা যাচই করে নির্মোহভাবে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পুথি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাচীন পুথি সম্পাদনার কাজে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন পুঁথির বিবরণ গ্রন্থে ছয়শোটি পুঁথি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তার পিতার নাম মুনশী নূরউদ্দীন (১৮৩৮-৭১)। তার মাতা মিস্রীজান প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল বাড়ির দহলিজেই। সেখানেই তিনি আরবি-ফারসি ও বাংলায় পড়া শুরু করেন। এরপর তিনি সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এক বছর পড়াশোনা করে তিনি পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৯৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম কলেজে দু’বছর এফএ পড়ার পর পরীক্ষার আগে তিনি টাইফয়েড এ আক্রান্ত হন। ফলে তার আর এফএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এখানেই তার উচ্চ শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

জন্মের কয়েক মাস আগে পিতার মৃত্যু এবং ১৭ বছর বয়সে মাতৃহীন আবদুল করিম দাদা-দাদি ও চাচা-চাচির স্নেহছায়ায় এন্ট্রান্স পাস করেন এবং সচেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সঙ্গত কারণেই উনিশ শতকে এন্ট্রান্স পাস করতে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানেও পারদর্শী হতে হতো।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাল্যকাল থেকেই পুঁথিপত্রের প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। সারা জীবন তার নেশা ছিল দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাকি-মাসিক ইত্যাদি পত্রিকা পাঠ করা এবং সংগ্রহ করা। কলেজে পড়ার সময় আবদুল করিম চট্টগ্রামের মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে সীতাকুন্ড ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম প্রথম জজ আদালতে প্রথমে এপ্রেন্টিস বা শিক্ষানবিস পদে এবং পরে ১৮৯৭ সালে পটিয়া মুন্সেফ আদালতে তিনি বদলি হন।

অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত মাসিকপত্র ‘পূর্ণিমা’য় আবদুল করিমের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে কবি নবীনচন্দ্র সেনের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কবি নবীনচন্দ্র সেন চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেয়ার পর আবদুল করিম করনিক হিসেবে চট্টগ্রাম ফিরে এসে পুঁথি সংগ্রহ ও গবেষণায় যুক্ত হন। কালীশঙ্কর চক্রবর্তী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘জ্যোতিঃ’ পত্রিকায় আবদুল করিম পুঁথি সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এতে তার চাকরিজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।

নবীনচন্দ্র সেনকে কুমিল্লায় বদলি ও আবদুল করিমকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আবদুল করিম আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর অব স্কুলস এর আগ্রহে ইন্সপেক্টর অব স্কুলস কার্যালয়ে দ্বিতীয় করণিক হিসেবে আবদুল করিম যোগদান করেন। ১৯৩৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসর গ্রহণ করেন। চাকরির সূত্র ধরে আবদুল করিম পুঁথি সংগ্রহে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে আবদুল করিম পুঁথি সংগ্রহ করতেন।

সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত প্রথম বই ‘রাধিকার মানভঙ্গ’। এই বইয়ের ভূমিকা লেখেন ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেন, “শ্রী আবদুল করিম চট্টগ্রামের একটি বাঙ্গালা বিদ্যালয়ের পণ্ডিত। তাহার অবস্থা ভাল নহে। তথাপি তিনি সাহিত্যসেবায় অকাতরে পরিশ্রম করিয়া থাকেন। বাঙ্গালা সহিত্যের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহায়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন—সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন ‘জার্মান এডিটর’ এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।” (পৃ. ১৬)

সাহিত্য, পূর্ণিমা ইত্যাদি পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ শিক্ষিত সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে কবিবলভ এঁর সত্যনারায়ণের পুঁথি (১৯১৫), দ্বিজ রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৯১৫), রামরাজার মৃগলুব্ধ সম্বাদ (১৯১৫), দ্বিজ মাধবের গঙ্গামঙ্গল (১৯১৬), আলীরাজার জ্ঞানসাগর (১৯১৭), বাসুদেব ঘোষের শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস (১৯১৭), মুক্তারাম সেনের সারদামঙ্গল (১৯১৭), শেখ ফয়জুলাহর গোরবিজয় (১৯১৭), আলাওলের পদ্মাবতী (খণ্ডাংশ, ১৯৭৭) ইত্যাদি। তিনি আলাওলের পদ্মাবতী (খণ্ডাংশ) সম্পাদনা করেছিলেন, কিন্তু জীবিতকালে তা পুস্তকাকারে দেখতে পাননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য সমিতি তার মৃত্যুর অনেক পরে ১৯৭৭ সালে তা প্রকাশ করে।

‘ইসলামাবাদ’ সাহিত্যবিশারদের একটি মৌলিক গ্রন্থ। ইতিহাস ঘেঁটে চট্টগ্রামকেই তিনি ইসলামাবাদ বলেছেন। কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগে আউলিয়া, পীর, বুজর্গানেরা চট্টগ্রামে এসে, সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। উল্লিখিত গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন তিনি, “আমাদের এই দেশ ধর্মজগতে একটা পরম শ্লাঘ্য স্থান অধিকার করিবার দাবি করিয়া আছে। পৃথিবীর চারিটি মহাধর্ম শক্তি আসিয়া এখানে সম্মিলিত হইয়াছে। ইহা হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ—এই তিন মহাজাতিরই একটা পরম পবিত্র তীর্থরূপে পরিগণিত। হিন্দুর হিন্দুত্ব ও মুসলমানের মুসলমানত্ব একমাত্র এই দেশেই আজও সম্পূর্ণ বজায় আছে। এক গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিয়া এক পুকুরের জল খাইয়া আমরা হিন্দু-মুসলমান দুইটি জাতি স্মরণাতীত কাল হইতেই স্ব-স্ব ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া পরম প্রীতিতে চলিয়া আসিতেছি, জাতি-ধর্ম লইয়া এ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনোদিন একটা টুঁ শব্দ পর্যন্তও হয় নাই, ইহা আমাদের চট্টগ্রামের একটা বিশিষ্ট গুণ।” (পৃ. ২০)

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংকলিত ও রচিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে, (১) বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির বিবরণ, ১ম ও ২য় সংখ্যা (পরিষৎ পত্রিকা) ১৯১৩, (২) বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির বিবরণ ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যা  (গ্রন্থাকারে ১৯১৪), (৩) পুথি পরিচিতি (আহমদ শরীফ সম্পাদিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত, Descriptive Catalogue of Bengali Manuscripts নামে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন অনূদিত এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত, (৪) প্রাচীন পুঁথির বিবরণ (হিন্দু রচিত পুঁথির বিবরণ, রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়াম কর্তৃক প্রকাশিতব্য), (৫) ইসলামাবাদ (চট্টগ্রামের সচিত্র ইতিহাস, ১৩২৫-২৭ সনে সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত) সৈয়দ মুর্তাজা আলী সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত, আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগে রচিত) ১৯৩৫ সালে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত আরো কিছু পুথি রয়েছে। যেমন, মুসলমান বৈষ্ণব কবি (১৯০৪), রাধিকার মানভঙ্গ (১৯০৫), নারায়ণদেবের পাঁচালী (১৯০৬), লক্ষ্মীচন্দ্র পাঁচালী (১৩১৭ বঙ্গাব্দ)। কালকেতুর চৌতিশা, গঙ্গামঙ্গল (১৯১৬) তা ছাড়া মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তার প্রায় ছয়শত মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন মূলত পুথি সংগ্রাহক। মুহম্মদ আবদুল হাই তার সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন, “পুঁথি সংগ্রহ তাঁকে নেশার মত পেয়ে বসেছিল। নানা জায়গায় বিপ্তি পুঁথিগুলো অযত্নে ও অবহেলায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলে বাংলার প্রাচীন সাহিত্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপাদান নিঃশেষিত হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে মধ্যযুগের বাঙালী মুসলমানদের সাহিত্যের স্বরূপও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, সম্ভবত এ চিন্তাই জাতি-প্রাণ আবদুল করিমকে পুঁথি সংগ্রহে অনুপ্রাণিত করেছিল। কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার পুঁথি সংগ্রহের কাজে আবদুল করিমকে এক কপর্দকও সাহায্য করেননি, তবু এ অপরাজেয় বৃদ্ধ নিজের অর্থে নিজের পরিশ্রমে আড়াই হাজারের অধিক পুঁথি সংগ্রহ করে গেছেন। এগুলোর মধ্যে এক হাজারেরও বেশি পুঁথি বাংলার মুসলমানদের দ্বারা রচিত। প্রাচীন বাংলার মুসলমানদের বাংলা সাহিত্য-সাধনার প্রত্য উদাহরণস্বরূপ এত বড় সংগ্রহ আজ পর্যন্ত অন্য কোনো লোক বা শিা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সম্ভব হয়নি। আবদুল  করিমের জীবনের এই-ই এক অমর কীর্তি।”

তার দেশপ্রেম, জনকল্যাণ চিন্তা ও গবেষণা চেতনায় সামগ্রিকতা ধারণ করে। চট্টগ্রামে ১৯৫১ সালে ১৬ মার্চ সংস্কৃতি সম্মেলনে আবদুল করিম মূল সভাপতির ভাষণে সেই প্রতীতী তুলে ধরেন: ঐতিহ্যের সহিত দেশের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, লৌকিক আচার, বায়ু, গাছপালা, এমনকি তরুলতা পর্যন্ত জড়িত। বুকে দেশপ্রেম না থাকিলে তাহা কাহাকেও বুঝাইয়া দেওয়া মুশকিল। অনেকে সবগুলি মানেন না। দেশের কোন একটি বিশেষ অঙ্গের উপর জোর দেন। এমন ক্ষেত্রে দেশ অঙ্গস্ফীতি পীড়ায় ভুগিবে। কোন একটি অঙ্গের উপর জোর দিলে তা হয়তো মোটা দেখাইতে পারেÑ অন্যগুলি শুষ্ক হইয়া যাইবে। ইহা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, স্বাস্থ্যের অভাবের লক্ষণ। (আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ: আহমদ শরীফ, পৃ. ২৪-২৫)।

বর্তমানে পুথি সাহিত্য ও মধ্যযুগের সাহিত্য সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে, গবেষণাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সবই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের পুথি সংগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যবিশারদ রচিত প্রাচীন পুথির বিবরণের ভূমিকায় ব্যোমকেশ মুস্তফী লিখেছেন, “পুথি অনুসন্ধান করিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইবার অবসর ও ব্যয় নির্বাহের মত আর্থিক সচ্ছলতা তাঁহার নাই, মূল্য দিয়া তিনি পুঁথি ক্রয় করিতে পারেন, এমন অর্থ তাহার নাই-ই, তথাপি কেবল মাতৃভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভক্তিবশত তিনি জীবনের দীর্ঘকাল এই পুঁথি সংগ্রহে যথাসাধ্য ব্যয় করিয়াছেন।… তিনি মুসলমান, কোন হিন্দুর আঙ্গিনায় তাঁহার প্রবেশাধিকার নাই, কিন্তু হিন্দুর ঘরে পুঁথি আছে শুনিয়া তিনি ভিখারীর মত তাহার দ্বারে গিয়া পুঁথি দেখিতে চাহিয়াছেন। পুঁথি সরস্বতী পূজার দিন পূজিত হয়। অতএব মুসলমানকে ছুঁইতে দেওয়া হইবে না বলিয়া অনেকে তাঁহাকে দেখিতেও দেন নাই। অনেকে আবার তাহার কাকুতি মিনতিতে নরম হইয়া নিজে পুঁথি খুলিয়া পাতা উল্টাইয়া দেখাইয়াছেন, মুন্সী সাহেব দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া হস্তস্পর্শ না করিয়া কেবল চোখে দেখিয়া নোট করিয়া সেই সকল পুঁথির বিবরণ লিখিয়া আনিয়াছেন। এত অধ্যবসায়, এত আগ্রহে, এমন করিয়া কোন হিন্দু অন্তত তাঁহার নিজের ঘরের পুঁথিগুলির বিবরণ লিখিতে বা অন্য কোন কার্যে হাত দিয়াছেন কিনা, জানি না। মুন্সী সাহেবের নিকট বাংলা সাহিত্য সমাজের কৃতজ্ঞতার পরিমাণ যে কত বেশি, তাহা ইহা হইতেই অনুমান করা যায়।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাংলা সাহিত্যের অপূর্ণতা দূর করেছেন। তার উদ্ধারকৃত প্রকাশিত ও সম্পাদিত পুথি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে। পুথির মধ্য দিয়ে আসলে তিনি জনমানসের পরিচয়ের ধারাক্রমকে লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে তার অবদান ছিল ঐতিহাসিক। সেই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে অনেক পণ্ডিত মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী। তার লেখা থেকেই তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, তিনি লিখেছেন, “হিন্দু ও মুসলমানের ধর্ম, আদর্শ ও ঐতিহ্য ভিন্ন হইতে পারে। তাহাদের সৃষ্ট সাহিত্য ও স্ব স্ব ধর্ম, আদর্শ ও ঐতিহ্য অনুরূপ হইতে পারে, কিন্তু পদ্ম, যুঁই, শেফালিকার পার্শ্বে গুলাব, নার্গিস, হাস্নাহেনার বাগান গড়িয়া উঠিলে শোভা দ্বিগুণ বর্ধিত হইবে বই কমিবে না। কোকিল ও বুলবুলের পরস্পর জানাজানির মধ্যে মিলনের সুর পাওয়া যাইবে, হিন্দু ও মুসলমানের ভাবের মিলনের মধ্যে এক মহাবাণী ফুটিয়া উঠিবে। হিন্দু মুসলমান ও পাশ্চাত্য ভাবধারা মিলিয়া বঙ্গ সাহিত্যে ভাবের ত্রিবেণী-সঙ্গম সৃষ্ট হইবে। (বঙ্গ সাহিত্য পরিক্রমা)

বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় সাহিত্যকর্মী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো নিষ্ঠাবান পুথি সংগ্রহকারী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর একজনও নেই। আবদুল করিমের এই নিরলস সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রামের পণ্ডিতসমাজ তাকে ‘সাহিত্যবিশারদ’এবং নদীয়ার পণ্ডিতসমাজ  তাকে ‘সাহিত্যসাগর’উপাধি দিয়েছেন। তার গবেষণা, পুঁথিসাহিত্য সংরক্ষণ ও প্রবন্ধ রচনায় মৌলিকত্ব ও বহুমাত্রিকতা আজো বিপুল পাঠককে আলোড়িত করে। তার কীর্তি আজো প্রাসঙ্গিক। সিপাহী বিপ্লবের পর মুসলিম মানসে যে জাগৃতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একাগ্রতা প্রত্যক্ষ করা যায় তাতে পুরোধা ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্বশিক্ষিত হয়েও সমাজ এবং মানুষকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। পুঁথি সাহিত্য, দেশীয় সংস্কৃতি ও আবহমান বাংলার জীবনাচরণকে অবলম্বন করে তিনি যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর দিশা দেবে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সাহিত্য পাঠ ও অনুশীলন আত্ম আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবে তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে আরোহণ করেছেন। তার রচিত সাহিত্য অবশ্যই সুপাঠ্য।