অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

বাসর

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : মে ২০, ২০১৮

তানু মিয়া আইছে গাজীপুর, চাচার বাড়ি। চাচতো ভাই আনুর বিয়ার কথা চলতাছে। তানুর মনে হালকা খচ্খচ্, সে অহনো বিয়া করে নাই। ছোট ভাইয়ের আক্তে কি যাওয়াডা ঠিক হইবো! আনু অর সাড়ে চাইর বছরের ছোড, হেরপরেও এই ভাইডারে লইয়া এমন কুনো আকাম নাই যে হেয় করে নাই। আজ চাচার বাড়ির ছাদে মদের বন্দোবস্ত করবো অরা, আপাতত গাঞ্জা দিয়া শুরু।
ভাই, তোমারে থুয়া বিয়া করতাছি। ভাল্লাগে না ভাই।
আরে তুই দেহি চাচির লাহান মাইগ্যা প্যাঁচাল শুরু করলি। আমি তো জিন্দেগিতেও বিয়া করুম না।
এইডা কুনো কথা না ভাইজান, কী এক বালের প্রেম করছিলা, হেইর লিগা সারাজীবন...
এই প্যাঁচাল বন্ধ রাখ। বিড়ির গুড়াডি বাইর কর। আর কারে পাডাইছস্ মাল আনতে? এহনো আহে না ক্যা!

কথা শেষ না হইতেই তানুর চাপা ঝুইলা পড়ে, ছাদে লাল বাল্টি লইয়া এক মাইয়া উপস্থিত। শাড়ির কুচি কায়দা কইরা তুইলা কোমরের এক পাশে গুঁইজা থুইছে। ফকফকা হাটুর একটাতে কহরের মতো ছোট্ট কালা দাগ। তানু মিয়া মুখ ফিরানের আগেই মাইয়াডা ঝাড়া মাইরা কাপড় সামলাইতে গিয়া আরো কিছু দেহাইয়া ফালায়।
চাপা গলায় ভাইরে জিগায় তানু, ওই আনোয়াইরা! মালডা কে?
ভাই, পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়া আইছে।
তগো ছাদে কী!
ভাই, হের ছোড বাচ্চা, উডানে রইদ নাই। মার কাছে কইয়া ছাদে কাপড় রইদ দেয়।
তানু আড়চোখে দেহে, মাইয়া তো চান্দের মতো। নাকে একটা কী পরছে, এইডারে নথ কয় নাকি নোলক! জাম কালারের কম্বল রইদে দিতাছে। হাতের মুঠে একটা লাল ব্রা আস্তে কইরা লুকাইয়া কম্বলের তলে গুঁইজা দিয়া চিকন চোখে তানু মিয়ার দিকে তাকায় রইলো।
এই যে আপা, আপনে ওই তারে কম্বলডা দেন, কম্বলের পানি আইয়া তো আমগো বহনের জায়গা ভিজায় দিলো।
আপনে কেডা! কিছু কইলে আনু ভাই কইবো।
আরে, এই মাইয়া দেহি একটা বেদ্দপ।
আর আপ্নে খুব ভালা? ছোড ভাইরে মদ গাঞ্জা খাওয়া শিখাইবেন!

তানু মিয়ার মাথা ঘুরতাছে। এই মাইয়া কী কইতাছে কিছুই কানে যাইতাছে না তার। পৌষ মাসের শীতেও মাইয়ার নাক ঘাইমা অস্থির। চিকচিক করতাছে নাকের নোলক না নথটা জানি। কথা না শেষ কইরাই সে ঝাঁমটা মাইরা চইলা গেল। কেমন কইরা জানি খোঁপা খুইলা চুলগুলি ছড়ায়া গেল পিঠে। তানু মিয়ার বুক ব্যথা শুরু হয়া গেল।
কী রে আউন্যা, তর বন্ধু কো? আহেনা ক্যা!
ভাই, এ মাইয়ার কথায় দুখ নিও না। হেয় বড় দুখি। জামাই বিদেশ গিয়া আর খোঁজ লয় না। ছোড বাচ্চা নিয়া মা-বাপের ঘাড়ে।
কছ্ কী!
হ, ভাই! মোবাইল আইছে, মনে হয় দোস্তে মাল লইয়া গলির মোড়ে। আমি নিয়া আহি।

ছাদে পৌষ মাসের রইদে খারাপ লাগতাছে না তানুর। জাম কালারের কম্বলের কোনা দিয়া লাল ফিতা বাইর হয়া রইছে। তানু উইঠা গিয়া কম্বলের নিচ থিকা ব্রাডা বাইর করলো। সাইজ আটত্রিশ।
আপ্নে কী মনে কইরা আমার কাপড়ে হাত দিলেন?
এ্যাঁ  এ্যাঁ... আসলে এইডা তো কম্বলের তলে শুকাইবো না, তাই বাইর কইরা দিতে আইছিলাম।
আপনের এত মাতুব্বরি করতে হইবো ক্যান? আপনে কি আমার সোয়ামি লাগেন!
তানু মিয়ার মাথা ভনভন করতাছে। মাইয়াডা দুই হাতে তিনডা আচারের শিশি বুকে চাইপা ধইরা আছে। বুকের কাপড় সইরা গিয়া ব্লাউজের হুক দেখা যাইতেছে। তাড়াহুড়া কইরা মাইয়াডা শিশিগুলি রাইখা সিঁড়ি দিয়া নাইমা গেলগা। নামডাও জানা হইলো না। এত সুন্দর মাইয়াও দুইন্যায় আছে!

দুই মিনিট না যাইতেই আরো একটা আচারের শিশি লইয়া হে উপস্থিত। তানু মিয়া ঠিক করছে, একবারও চাইবো না ওর দিকে। সারা জীবন মাইয়াগো থিকা দশ হাত দূরে থাকছে। আইজ কী হইতাছে এইসব!
এই যে, হুনছেন? এই যে, ঘুমায় গেলেন গা!
কী চান?
আপ্নে কি রাগ হইলেন?
না, রাগ হমু কেন?
এইডা কী সিগরেট?
বাংলা ফাইব।
আমার না সিগরেটের ঘেরান খুব ভালা লাগে। কিন্তু আমার সোয়ামি বিড়িটিড়ি খাইতো না।
আপনের সোয়ামি শুধু বিড়ি না, আরো অনেক কিছুই খাইতো না। আপনেরে দেখলে বুঝা যায়।
মুখ সামলাইয়া কথা কন।
আইচ্ছা কমুনে, এহন আহেন, আমার লগে দুইডা টান দেন।
হিহিহি! কী কন! আমি তো জিন্দিগিতে এসব খাই নাই।
না খাইলে নাই। তাজ্জব বিষয়। হেয় খায় না, হের জামাই খায় না... মাগার হের বিড়ির ঘেরান ভাল্লাগে।
ওই কী কন বিড়বিড় কইরা?
তানুর মাথা গরম হয়া যাইতাছে। মনডা চাইতাছে ওরে দেয়ালে জাইত্যা ধইরা দুইশো চুমা লাগায়।
ভাই! মাল আনতে দেরি হইবো একটু।
ও আনু! মাইয়াডার নাম কীরে!
ভাই, বিষয় কি? এই মাইয়া ছাদে কী করে এতক্ষণ? ভা...ই! পছন্ হইলে কও, আম্মারে কইয়া আহি। চাচারে ফোন দেই। আইজ রাইতেই বিয়া।
তর মাথা খারাপ? চিনি না জানি না, আইজ রাইতেই...! ওই হারামি, এ মাইয়ার নাম কি?
চম্পা।
চম্পা... চ... ম্...পা! সুন্দর নাম। মাইয়া পছন্দ হয় নাই, তয় নাম পছন্দ হইছে।
ভাই রে! বুঝছি, বিয়া লাগায় দিলাম তইলে। যাই মারে গিয়া কই চাচারে ফোন দিতে।
ধুর! আরেকটু ভাইবা লই। মাইয়াতো তেমন সুন্দরও না, কী কছ্?
ভাই, দোস্তের ফোন, এইবার মাল কনফার্ম।
না রে আউন্যা, গাঞ্জা খাওন যাইবো না। তোর ভাবির মনে হয় পছন্দ না।
কী কও ভাই! ভাবি কেডা! হাহাহা। বুঝছি ভাই, আইজ রাইতেই বিয়া। আনু মিয়ার এক জবান।

বিকাল হয়া গেল, তানু মিয়া ছাদে বসা। চম্পা এহনো কম্বল নিতে আইলো না, ব্রাও শুকায়া মচমচা হয়া গেছে। দুপুরে গলা দিয়া ভাত নামে নাই তার। এতো অস্থির লাগতাছে ক্যান! সে কি মইরা যাইবো?
এই যে, কি শুরু করছেন এইসব!
কি করছি?
আপ্নে কেমনে ভাবলেন, আপনের লাহান একটা বুইড়া, জিংলা বেডারে আমি বিয়া করুম? আপ্নে চোখেও তো কম দেহেন, চশমা দেকতাছি!
বুইড়া মানে! আমার এই চুল দাড়ি বাই এ পাকছে, আমার বয়স মাত্র ৩৮। আর জিংলা মানে? তুমি কি? তোমার এই ওজন কি ভালো? আমি ক্যান, দুনিয়ার কেউ তোমারে আলগাইতে পারবো না।
কী কইলেন?
তানু মিয়া হ্যচকা টানে চম্পারে দেয়ালে চাইপা ঠোঁট কামড়াইয়া ধরে। চম্পা একবার ধাক্কা দেয়, একটু পরেই আবার খামচায়া ধরে তানু মিয়ারে।
শোনেন! আমি এমনে বিয়া করুম না। আমার অনেক দিনের শখ, ভাইগ্যা গিয়া বিয়া করুম। আর আমার বাচ্চা আছে ২ বছরের, অরে আপনা কইরা লইবেন।
সমস্যা নাই, আমরা অহনি ভাইগ্যা যামু। আর তোমার বাচ্চা ছাড়া তো আর গতি নাই আমার। এই বুড়া বয়সে তো আর আমার হেই ক্ষমতা নাও থাকবার পারে।
চম্পা তানুর গালে একটা ঠোকনা মারে, তানু আবার জাইত্যা ধরে চম্পারে।

চারদিন পর

তানু মিয়া উঠানে লাউ গাছের ঝাঁকা বানতে আছে, তার চোখ রান্ধন ঘরে। চুলার আগুনে চম্পার নাকের নথ ঝিকঝিক করে। তানু মিয়ার বিশ্বাস হইতে চায় না। ঘরের নিমকাঠের উঁচা চৌকাঠ পার হইতে গিয়া চম্পার কাপড় হাঁটুতে উইঠা যায় বারবার। তানু মিয়া হা কইরা দেহে, তানু মিয়ার মাথা খালি ঝিমঝিম করে। সন্ধ্যার পর চম্পা বাচ্চার মুখে দুধ দিয়া ঘুম পাড়াইতে পাড়াইতে তানু মিয়ার চোখের দিকে চায়, মনে হয় একটা কালা চিতা ওৎ পাইতা বইসা রইছে। তানু মিয়ার হাতে বাংলা ফাইব... চম্পা জানে বিড়ির আগুন নিভলে... তানু কোন আগুনে ঝাপায়া পড়বো!