বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২

বাংলা আধুনিক কথাসাহিত্যের স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজ ১২৮তম জন্মদিন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আইনস্টাইন কেন যে দার্জিলিং যাইতে যাইতে রানাঘাটে নামিয়াছিলেন বা সেখানে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে ‘On…ইত্যাদি ইত্যাদি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে উৎসুক হইয়াছিলেন—এ কথা বলিতে পারিব না। আমি ঠিক সেইসময়ে উপস্থিত ছিলাম না। কাজেই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আমি আপনাদের নিকট সরবরাহ করিতে অপারগ, তবে আমি যেরূপ অপরের নিকট হইতে শুনিয়াছি সেরূপ বলিতে পারি।

আসল কথা, নাৎসি জার্মানি হইতে নির্বাসিত হওয়ার পর হইতে বোধ হয় আইনস্টাইনের কিছু অর্থাভাব ঘটিয়াছিল, বক্তৃতা দিয়া কিছু উপার্জন করার উদ্দেশ্যে তাঁর ভারতবর্ষে আগমন। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়া বেড়োইতেছিলেনও এ কথা সকলেই জানেন, আমি নূতন করিয়া তাহা বলিব না।

কৃষ্ণনগর কলেজের তদানীন্তন গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় একজন উপযুক্ত লোক ছিলেন। সেনেট হলে আইনস্টাইনের অদ্ভুত বক্তৃতা ‘On the Unity & Universality of forces’ শুনিয়া অন্য পাঁচজন চিন্তাশীল ব্যক্তিদিগের মতো তিনিও অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার কলেজে আইনস্টাইনকে আনাইয়া একদিন বক্তৃতা দেওয়াইবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু প্রিন্সিপাল আপত্তি উত্থাপন করিলেন।

তিনি বলিলেন—“না রায় বাহাদুর, আমার অন্য কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এমন দিনে একজন জার্মান—”
রায়বাহাদুর উত্তেজিত হইয়া বলিলেন (যেমন ধরনের উত্তেজিত হইয়া তিনি উঠিতেন সন্ধ্যায় রামমোহন উকিলের বৈঠকখানায় ভাগবত পাঠের সময়, অন্য কেহ যদি কোনো বিরুদ্ধ তর্ক উত্থাপন করিত)—”সে কী মহাশয়! জার্মান কী? জার্মান? আইনস্টাইন জার্মান? ওঁদের মতো মহামানবের, ওঁদের মতো ঋষি বৈজ্ঞানিকের দেশ আছে? জাতের গণ্ডি আছে? আমি বলিলাম।

প্রিন্সিপাল বলিলেন—”আমিও বলছিনে যে তা আছে। কিন্তু বর্তমানে যেমন অবস্থা—” দুই প্রবীণ অধ্যাপকে ঘোর তর্ক বাধিয়া গেল।
প্রিন্সিপাল দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিত, তিনি মধ্যযুগের স্কলাস্টিক দর্শনের প্রধান আচার্য জন স্কোটাসের উদাহরণ দেখাইলেন। আয়ার্লন্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াও নবম শতাব্দীর গোঁড়াদিগের দ্বারা উৎপীড়িত হইয়া ফ্রান্সে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হন। আয়ার্লন্ডে আর ফিরিতে পারিয়াছিলেন কি? আসল মানুষটাকে কে দেখে! তাঁর মতামতেরই মূল্য দেয় লোকে।

যাহা হউক, শেষপর্যন্ত যখন প্রিন্সিপাল রাজি হইলেন না তখন রায়বাহাদুরকে বাধ্য হইয়া নিরস্ত হইতে হইল। ইতিমধ্যে তাঁহার কানে গেল আইনস্টাইন শীঘ্রই দার্জিলিং যাইবেন। ভারতবর্ষে আসিয়া অবধি নানাস্থানে বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত থাকার দরুন তিনি হিমালয় দেখিতে পারেন নাই, এইবার এত কাছে আসিয়া আর দার্জিলিং না-দেখিয়া ছাড়িতেছেন না।

রায়বাহাদুর ভাবিলেন দার্জিলিঙের পথে রানাঘাটে নামাইয়া লইয়া সেখানে এক সভায় আইনস্টাইনকে দিয়া বক্তৃতা দেওয়াইলে কেমন হয়?

রায়বাহাদুর গ্র্যান্ড হোটেলে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করিলেন।
আইনস্টাইন বলিলেন, “ভারতবর্ষের দর্শনের কথা আমায় কিছু বলুন।”

রায়বাহাদুর প্রমাদ গণিলেন। তিনি গণিতের অধ্যাপক; দর্শন, বিশেষত ভারতীয় দর্শনের কোনো খবর রাখেন না, তবু ভাগ্যে গীতা মাঝে মাঝে পড়া অভ্যাস ছিল, সুতরাং অকূল সমুদ্রে গীতারূপ ভেলা (কোনো আধ্যাত্মিক অর্থে নয়) অবলম্বন করিয়া দু-এক কথা বলিবার চেষ্টা করিলেন। ‘বাসাংসি জীর্ণানি’ ইত্যাদি।

আইনস্টাইন বলিলেন, “ম্যাক্সমুলারের বেদান্তদর্শনের উপর প্রবন্ধ পড়ে একসময়ে সংস্কৃত শেখবার বড়ো ইচ্ছে হয়। দর্শনে আমি স্পিনোজার মানসশিষ্য। স্পিনোজার দর্শন গণিতের ফর্মে ক্রমানুসারে সাজানো। স্পিনোজার মন গণিতজ্ঞ স্রষ্টার মন, সেজন্য আমি ওঁর দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু বেদান্ত সম্বন্ধে ম্যাক্সমুলারের প্রবন্ধ পড়ে আমি নতুন এক রাজ্যের সন্ধান পেলাম। ইউক্লিডের মতো খাঁটি বস্তুতান্ত্রিক মন স্পিনোজার, সেখানে কূটতর্কও বাঁধা পথে চলে। আমি কিন্তু ভেতরে ভেতরে কল্পনাবিলাসী—I’

রায়বাহাদুর অবাক হইয়া আইনস্টাইনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘‘আপনি!”

আইনস্টাইন মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “কেন, আমার কালের সঙ্গে ক্ষেত্রের একত্র মিলনকে আপনি কল্পনার ছাঁচে ঢালাই-করা বিবেচনা করেন না নাকি?”

রায়বাহাদুর আরও অবাক। আমতা আমতা করিয়া বলিলেন “নতুন ডাইমেনশানের সন্ধানদাতা আপনি, নিউটনের পর নববিশ্বের আবিষ্কারক আপনি আপনাকে কল্পনাবিলাসী বলতে—”

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান যুগের এই শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীর কবিসুলভ দীর্ঘ কেশ ও স্বপ্নভরা অপূর্ব চোখের দিকে চাহিয়া রায়বাহাদুরের মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। কল্পনা প্রখর না–হইলে হয়তো বড়ো বৈজ্ঞানিক হওয়া যায় না, রায়বাহাদুর ভাবিলেন। কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, আইনস্টাইন পাশের ছোটো টেবিল হইতে চুরুটের বাক্স আনিয়া রায় বাহাদুরের সম্মুখে স্থাপন করিলেন। নিজের হাতে একটা মোটা চুরুট বাহির করিয়া ছুরি দিয়া ডগা কাটিয়া রায়বাহাদুরের হাতে দিলেন। রায়বাহাদুরের বাঙালি মন সংকুচিত হইয়া উঠিল। অত বড়ো বৈজ্ঞানিকের সামনে সিগার ধরাইবেন তিনি, জনৈক হেঁজিপেজি অঙ্কের মাস্টার? তা ছাড়া সাহেবও তো বটে, সেটাও দেখিতে হইবে তো। সাহেব জাত কাঁচাখেকো দেবতার জাত। রায়বাহাদুর একটা সিগার তুলিয়া বলিলেন—”আপনি?”

”ধন্যবাদ। আমি ধূমপান করিনে।’
”ও!”
”আমি একটা কথা ভাবছি।”
”কী, বলুন। “
”রানাঘাটে সভা করলে কেমন লোক হবে আপনার মনে হয়? কেমন জায়গা রানাঘাট?”
”জায়গা ভালোই। লোকও হবে।”
”কিছু টাকা এখন দরকার। যা ছিল জার্মানিতে রেখে এসেছি। ব্যাঙ্কের টাকা এক মার্কও তুলতে দিলে না, একরকম সর্বস্বান্ত।”
”আমি রানাঘাটে বিশেষ চেষ্টা করছি, সার।”
’ওখানে বড়ো হল পাওয়া যাবে কি?”
”তেমন নেই। তবে মিউনিসিপ্যাল হল আছে, মন্দ নয়, কাজ চলে যাবে।” রায়বাহাদুর কিছুক্ষণ পরে বিদায় লইতে চাহিলেন, ভাবিলেন এত বড়ো লোকের সময়ের ওপর অত্যাচার করিবার দরকার নাই।

আইনস্টাইন বলিলেন—’’আমার কিছু ছাপা কাগজ ও বিজ্ঞাপন নিয়ে যান। যে বিষয়ে বক্তৃতা হবে, সে আপনাকে পরে জানাব, টিকিটের দাম কত করব?”
’খুব বেশি নয়—এই ধরুন—”
”তিন মার্ক—দশ শিলিং?”
”আজ্ঞে না সার। সর্বনাশ! এসব গরিব দেশ। দশ শিলিং আজকাল দশ টাকার কাছাকাছি পড়বে। ও-দামে টিকিট কেনবার লোক নেই এদেশে, সার।’’
”পাঁচ শিলিং?”
”আচ্ছা, তাই করুন। ছাত্রদের জন্যে এক শিলিং।”

আইনস্টাইন হাসিয়া বলিলেন, “ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। আমি নিজেও স্কুল-মাস্টার। আমার ওপর তাদের দাবি আছে। বম্বে ও বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতেও তাই হয়েছিল। ছাত্রদের টিকিট কিনতে হবে না। এই নিয়ে যান ছাপা হ্যান্ডবিল ও কাগজপত্র—”

রায়বাহাদুর হ্যান্ডবিল হাতে পাইয়া পড়িয়া দেখিতে গিয়া বিষণ্ণমুখে বলিলেন —”এ কী সার? এ যে ফরাসি ভাষায় লেখা!”
”ফরাসি ভাষায় তো বটেই। প্যারিসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ছাপিয়েছিলাম। কেন, ফরাসি ভাষা বুঝবে না কেউ? আমি তো সেদিন শুনলাম এখানে ইউনিভার্সিটিতে ফরাসি পড়ানো হয়?”
’’আজ্ঞে না। সে হয়তো এক-আধজন বুঝতে পারে। সেভাবে ফরাসি ভাষা পড়ানো হয় না। এখানে ইংরেজিটাই চলে। কেউ বুঝবে না সার।”
’তাই তো! আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিয়ে ওখানে কোনো প্রেসে ছাপিয়ে নেবেন দয়া করে?”
’তা—ইয়ে…তা—আচ্ছা স্যার।”

রায়বাহাদুর মনে মনে ভাবিলেন—এখান থেকে বালিগঞ্জে গিয়ে বিনোদের শরণাপন্ন হইগে। ছোকরা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে। কাঁহাতক আর একজন এত বড়ো লোকের সামনে ‘জানিনে মশাই’ বলা যায়! বিনোদ চৌধুরী তাঁর বড়ো শালা। পণ্ডিত লোক। অনেকরকম ভাষা তার জানা আছে। সে উৎসাহের সঙ্গে হ্যান্ডবিলগুলির বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ করিয়া দিয়া বলিল—”আমি চাটুয্যেমশায়, রানাঘাট যাব সেদিন। আমার থিওরি অব রিলেটিভিটির সঙ্গে পরিচয় অবিশ্যি লিন্ডেন বুলটনের পপুলার বই থেকে। তবুও আইনস্টাইনকে আমি এ যুগের ঋষি বলে মানি। সত্যকার দ্রষ্টা ঋষি। সত্যকে যাঁরা আবিষ্কার করেন, তাঁরাই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। লম্বা লম্বা লাঙল মার্কা ইকোয়েশন বুঝতে না-পারি, কষতে না-পারি, কিন্তু কে কী দরের সেটুকু— ।”

রায়বাহাদুর দেখিলেন চতুর শ্যালকটি তাঁহাকে ঠেস দিয়া কথা বলিতেছে। হাসিতে হাসিতে বলিলেন,—”অর্থাৎ সেই সঙ্গে আমার দরটাও বুঝি ঠিক করে ফেললে বিনোদবাবু? বেশ, বেশ।”
”রামোঃ! চাটুয্যেমশায়, ছি ছি, তেমন কথা কী আমি বলি?”
”বলো না?”
”স্পেস-টাইম—কনটিনিউয়ামের মোহজালে পড়ে কোনটা কখন কী অবস্থায় বলেছি, তা কী সবসময় হলফ নিয়ে বলা যায় চাটুয্যেমশায়? এবেলা এখানে থেকে যাবেন না?”
”না না, আমার থাকবার জো নেই। অনেক কাজ বাকি। যাতে দু-পয়সা হয় ভদ্রলোকের, সে ভার আমার ওপর। দেখি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের একটু ধরাধরি করিগে। ঘুঘু সব। হলটা যদি পাওয়া যায়—”
”কী বলেন আপনি চাটুয্যেমশায়! আইনস্টাইনের নাম শুনলে হল না-দিয়ে কেউ পারবে? আহা শুনলেও কষ্ট হয়, অত বড়ো বৈজ্ঞানিককে আজ এ বৃদ্ধ বয়সে পয়সার জন্যে বক্তৃতা করে অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে—দি ওয়ার্লড ডাজ নট নো ইটস গ্রেটেস্ট’।
”তুমি এখনও ছেলেমানুষ বিনোদ। ওই যা শেষকালে বললে ওই কথাটাই ঠিক। অনেক ধরাধরি করতে হবে। পাঁচটা চল্লিশের ট্রেনেই যাই।

ইহার পরের কয়েকদিন রায়বাহাদুর অত্যন্ত ব্যস্ত রহিলেন। রানাঘাট মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, স্কুলের হেডমাস্টার, উকিল, মোক্তার, সরকারি কর্মচারী ও ব্যাবসাদারগণের সঙ্গে দেখা করিয়া সব বলিলেন। আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করিলেন, সকলেরই যথেষ্ট উৎসাহ, সকলেরই যথেষ্ট আনন্দ। যেন সবাই আকাশের চাঁদ হাতে পাইতে চলিয়াছে।

বৃদ্ধ মোক্তার অভয়বাবু বলিলেন, “কী নামটি বললেন মশাই সাহেবের? আ —কী? আইন স্টাই—ন? বেশ বেশ। হাঁ, বিখ্যাত নাম। সবাই জানে সবাই চেনে। ওঁরা হলেন গিয়ে স্বনামধন্য পুরুষ—নাম শোনা আছে বই কী।”

রায়বাহাদুর রাগে ফুলিয়া মনে মনে বলিলেন—তোমার মুণ্ডু শোনা আছে, ড্যাম ওল্ড ইডিয়ট! এ তুমি কাপুড়ে মহাজন শ্যামচাঁদ পালকে পেয়েছ? স্বনামধন্য! তিনজন্ম কেটে গেলে যদি এ নাম তোর কানে পৌঁছায়। মিথ্যে সাক্ষী শিখিয়ে তো
জন্ম খতম করলি, এখন আইনস্টাইনকে বলতে এসেছে স্বনামধন্য পুরুষ! ইডিয়োসির একটা সীমা থাকা চাই।

নির্দিষ্ট দিনে রায়বাহাদুর কৃষ্ণনগর কলেজের কয়েকটি ছাত্র সঙ্গে লইয়া সকালের ট্রেনে রানাঘাটে নামিলেন। তাঁর শালা বিনোদ চৌধুরী দুঃখ করিয়া চিঠি লিখিয়াছে, বিশেষ কার্যবশত তাহার আসা সম্ভব হইল না, আইনস্টাইনের বক্তৃতা শোনা কী সকলের ভাগ্যে ঘটে, ইত্যাদি। সেজন্য রায়বাহাদুরের মনে দুঃখ ছিল, ছোকরা সত্যিকার পণ্ডিত লোক, আজকার এমন সভায় বেচারির আসিবার সুযোগ মিলিল না। ভাগ্যই বটে।

রানাঘাট স্টেশনের বাহিরে আসিয়া সম্মুখের প্রাচীরে নজর পড়িতে রায়বাহাদুর থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। এ কী ব্যাপার! প্রাচীরের গায়ে লটকানো ঢাউস এক দুই-তিন-রঙা বিজ্ঞাপন। তাতে লেখা আছে…

বাণী সিনেমা গৃহে (নীল)
আসিতেছেন! আসিতেছেন!! (কালো)
আসিতেছেন!!! (কালো)
কে?? (কালো)
কবে?? (কালো)

সু প্রসিদ্ধি চিত্রতার কা ইন্দুবালা দেবী (লাল)
অদ্য রবিবার ২৭শে কার্তিক সন্ধ্যা ৫৷৷ টায় (নীল)
জনসাধারণকে অভিবাদন করিবে!! (কালো)
প্রবেশমূল্য ৫, ৩, ২ ও ১ টাকা (কালো)
মহিলাদের ৫ ও২ টাকা (কালো)
এমন সুযোগ কেহ হেলায় হারাইবেন না। (লাল)

কী সর্বনাশ!
রায়বাহাদুর রুমাল বাহির করিয়া কার্তিক মাসের শেষের দিকের সকালেও কপালের ঘাম মুছিলেন। তাহার পর একবার ভালো করিয়া পড়িলেন তারিখটা। না, আজই। আজ রবিবার ২৭শে কার্তিক।

অন্যমনস্কভাবে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিলেন আর একখানা সেই বিজ্ঞাপন। ক্রমে যতই যান, সর্বত্রই সেই তিনরঙা বিজ্ঞাপন। মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান মহাশয়ের বাড়ি পর্যন্ত যাইতে অন্তত ছত্রিশখানা সেই বিজ্ঞাপন আটা দেখিলেন বিভিন্ন স্থানে।

ভাইস-চেয়ারম্যান শ্রীগোপালবাবু ফুলবাগানের সামনে ছোটো বারান্দায় বসিয়া তেল-ধুতি পরনে তেল মাখিতেছিলেন। রায়বাহাদুরকে দেখিয়া ভালো হইয়া বসিলেন। হাসিয়া বলিলেন—”খুব সৌভাগ্য দেখছি। এত সকালে যে? — নমস্কার!”

’নমস্কার, নমস্কার! স্নানের জন্যে তৈরি হচ্ছেন? ছুটির দিনে এত সকালে যে?”
”আজ্ঞে হ্যাঁ, স্নানটা সকালেই করি।”
”বাড়িতে?”
”আজ্ঞে না, চুর্ণীতে যাই। ডুব দিয়ে স্নান না-করলে—অভ্যেস সেই ছেলেবেলা থেকেই। বসুন, বসুন। আজ যখন এসেছেন তখন দুপুরে গরিবের বাড়িতেই দুটো ডাল-ভাত—”
”সেজন্য কিছু না। নো ফরম্যালিটি। আমার মাসতুতো ভাই নীরেনের ওখানে–গেলে রাগ করবে। সেবার তো যাওয়াই হল না।’’
’’তাহলে চা চলবে তো?”
’’তাতে আপত্তি নেই। সে হবে এখন। আসলে যে জন্যে আসা—তা এ এক কী হাঙ্গামা দেখছি? কে ইন্দুবালা দেবী আসছে বাণী সিনেমাতে আজই।”
হ্যাঁ, তাই তো দেখছিলাম বটে।”
”দিন বুঝে আজই?”
”তাই তো—আমিও তাই ভাবছিলাম। ক্ল্যাশ করবে কিনা?”

”এখন তো আমরা দিন বদলাতে পারি না। সব ঠিকঠাক। আমাদেরও হ্যান্ডবিল বিলি, বিজ্ঞাপন বিলি, সব হয় গিয়েছে। আইনস্টাইন আসবেন এই দার্জিলিং মেলে।”
”আমিও তো ভেবেছি। তাই তো—”
“তবে আমার কী মনে হয় জানেন? যারা সিনেমাতে ইন্দুবালাকে দেখতে যাবে, তারা সাহেবদের লেকচার শুনতে আসবে না। সাহেবদের সভায় যারা আসবে, তারা ঠিকই আসবে।”

আইনস্টাইনকে ‘সাহেব’ বলিয়া উল্লেখ করাতে রায়বাহাদুর মনে মনে চটিয়া গেলেন। এমন জায়গাতেও তিনি আনিতে চলিয়াছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনকে! এ কী পাট কলের ম্যানেজার, না রেলের টি. আই. যে ‘সাহেব’ ‘সাহেব’ করবি? বুঝেসুঝে কথা বলতে হয় তো!
মুখে বলিলেন,-”হ্যাঁ, তা বটে।”

ভাইস-চেয়ারম্যান শ্রীগোপালবাবু তাঁর অমায়িক আতিথেয়তার জন্যে রানাঘাটে প্রসিদ্ধ। চা আসিল, সঙ্গে এক রেকাবি খাবার আসিল। রায়বাহাদুর চা-পানান্তে আরও নানা স্থানে ঘুরিবেন বলিয়া বাহির হইলেন। অনেকের সঙ্গে দেখা করিতে হইবে, অনেক কিছু ঠিক করিতে হইবে।
যাইবার সময় বলিলেন—”মিউনিসিপ্যাল হলের চাবিটা—”।

শ্রীগোপালবাবু বলিলেন—’’আমাদের হলের চাকর রাজনিধিকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বাসার চাকরও যাবে। ওরা হল খুলে সব ঠিক করবে। সেখানে ফ্রি রিডিং রুম আছে, সকালে আজ ছুটির দিন খবরের কাগজ পড়তে লোকজন আসবে। তাদের মধ্যে যারা ছেলে–ছোকরা তাদের ধরে চেয়ার বেঞ্চি সাজিয়ে নিচ্ছি। কিছু ভাববেন না।”

শ্রীগোপালবাবু স্নান করিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিতেই তাঁহার বড়ো মেয়ে (শ্রীগোপালবাবু আজ তিন বৎসর বিপত্নীক, বড়ো মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি হইতে আসিয়াছে, সে-ই সংসার দেখাশোনা করে) বলিল—”বাবা, আমাদের পাঁচখানা টিকিট করে এনে দাও।”
”কীসের টিকিট?”
”বা রে, বাণী সিনেমায় ও-বেলা ইন্দুবালা আসছে—নাচ-গান হবে। সবাই যাচ্ছে আমাদের পাড়ার।”
”কে যাচ্ছে?”
”সবাই! এই মাত্তর রানু, অলকা, টেপি যতীন কাকার মেয়ে চেঁড়স—এরা এসেছিল। ওরা সব বক্স নিচ্ছে একসঙ্গে—বক্স নিলে মেয়েদের আড়াই টাকা করে রিজার্ভ টিকিট দিচ্ছে। আমাদের জন্যে একটা বক্স নাও।”

শ্রীগোপালবাবু বিরক্তির সুরে বলিলেন,—”হ্যাঁ ভারি—আবার একটা বক্স! বড্ড টাকা দেখেছিস আমার। সেই ১৯০৩ সাল থেকে জোয়াল কাঁধে নিয়েছি, সে জোয়াল আর নামল না। কেবল টাকা দাও আর টাকা দাও—”
অপ্রসন্ন মুখে দেরাজ খুলিয়া মেয়ের হাতে একখানা দশ টাকার নোট ও কয়েকটি খুচরা টাকা ফেলিয়া দিলেন।
একটু পরে প্রতিবেশী রাধাচরণ নাগ আসিয়া বৈঠকখানায় উঁকি মারিয়া বলিলেন —”কী হচ্ছে শ্রীগোপালবাবু?”
’’আসুন ডাক্তারবাবু, খবর কী? যাচ্ছেন তো ও-বেলা?”
“হ্যাঁ, তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছি। আপনারা যাচ্ছেন তো?”
”যাব বই কী। রানাঘাটের ভাগ্যে অমন কখনো হয়নি। যাওয়া উচিত নিশ্চয়।”
’আমিও তাই বলছিলাম বাড়িতে। টাকা খরচও তো আছেই। কিন্তু এমন সুযোগ—বাড়ির সবাই ধরেছে। দিলাম দশটা টাকা বের করে। বলি বয়েস তো হল ছাপ্পান্নর কাছাকাছি, কোনদিন চোখ বুজব, তার আগে—”
”নিশ্চয়। জীবনে ওসব শোনবার সৌভাগ্য ক-বার ঘটে? আমাদের রানাঘাটবাসীর বড়ো সৌভাগ্য যে উনি আজ এখানে আসবেন।”
”আমিও তাই বলছিলাম বাড়িতে। বয়েস হয়ে এল, দেখে নিই, শুনে নিই —গেলই না-হয় গোটাকতক টাকা।”
’’তা ছাড়া, অত বড়ো বিখ্যাত একজন—”
”সে আর বলতে! আজকাল সব জায়গায় দেখুন ইন্দুবালা দেবী, সাবানের বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালা, গন্ধতেলের বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালা, শাড়ির বিজ্ঞাপনে ইন্দুবালার ছবি! তাকে চোখে দেখবার সৌভাগ্য—বিশেষ করে রানাঘাটের মতো এঁদোপড়া জায়গায়—সৌভাগ্য নয়? নিশ্চয় সৌভাগ্য!”

শ্রীগোপালবাবু হাঁ করিয়া নাগ মহাশয়ের দিকে চাহিয়া রহিলেন, প্রথমটা তাঁর মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না। ঝাড়া মিনিট-দুই পরে আমতা আমতা করিয়া বলিলেন,—”আমি কিন্তু সে-কথা বলছিনে। আমি বলছি সায়েবের লেকচারের কথা, মিউনিসিপ্যাল হলে।’
রাধাচরণবাবু ভুরু কুঁচকাইয়া বলিলেন,-”কোন সায়েব?”
”কেন, আপনি জানেন না? আইনস্টাইন—মিঃ আইনস্টাইন!’’

রাধাচরণবাবু উদাসীন সুরে হঠাৎ মনে পড়িয়া যাওয়ার ভঙ্গিতে বলিলেন, —”ও, সেই জার্মান না ইটালিয়ান সায়েব? হ্যাঁ—শুনেছি, আমার জামাই বলছিল। কী বিষয়ে যেন লেকচার দেবে? তা ওসব আর আমাদের এ বয়সে—লেখাপড়ার বালাই অনেকদিন ঘুচিয়ে দিয়েছি। ওসব করুকগে কলেজের ইস্কুলের ছেলে ছোকরারা—হ্যাঁঃ!”
শ্রীগোপালবাবু ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে কি বলিতে যাইতেছিলেন, রাধাচরণবাবু পুনরায় বলিলেন—”তা আপনি কী করবেন শুনি?”

“আমার বাড়ির মেয়েরা তো যাচ্ছে সিনেমায়। তবে আমাকে যেতেই হবে সায়েবের বক্তৃতায়। রায়বাহাদুর নীলাম্বরবাবু এসে খুব ধরাধরি করছেন”—
”কে রায়বাহাদুর? নীলাম্বরবাবু কে?’
”কৃষ্ণনগর কলেজের প্রোফেসর। তাঁরই উদ্যোগে সব হচ্ছে। তিনি এসেঃবিশেষ—

রাধাচরণবাবু চোখ মিটকি মারিয়া বলিলেন—’আরে ভায়া, একটা কথা বলি শোনো। একটা দিন চলো দেখে আসা যাক। ছবির ইন্দুবালা আর জ্যান্ত ইন্দুবালাতে অনেক ফারাক। ইহজীবনে একটা কাজ হয়ে যাবে। ওসব সায়েব টায়েব ঢের দেখা হয়েছে। দু-বেলা রানাঘাটে ইস্টিশানে দাঁড়িয়ে থাকা দার্জিলিং মেল শিলং মেলের সময়ে—দেখো না কত সায়েব দেখবে। কিন্তু ভায়া এ সুযোগ–বুঝলে না?”
শ্রীগোপালবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন,—”তা—তা—কিন্তু, তবে রায়বাহাদুরকে কথা দেওয়া হয়েছে কিনা, তিনি কী মনে করবেন—”।

রাধাচরণবাবু মুখ বিকৃত করিয়া খিঁচাইবার ভঙ্গিতে বলিলেন, “হ্যাঁঃ! কথা দেওয়া হয়েছে রায়বাহাদুরকে! ভারি রায়বাহাদুর! এত কী ওবলিগেশন আছে রে বাবা! বলো এখন, বাড়ির মেয়েরা সব গেল তাই আমায় যেতে হল। তারা ধরে বসল তা এখন কী করা। বলি কথাটা তো নিতান্ত মিথ্যে কথাও নয়!”
শ্রীগোপালবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন—”তা—তা—তা তো বটেই।সে কথাতো—”
রাধাচরণবাবু বলিলেন,-”রায়বাহাদুর এলে বলো এখন তাই। তাঁকেও অনুরোধ করো না বাণী সিনেমায় যেতে।–”
’চললেন?”
”চলি। ওবেলা আসব ঠিক সময়ে।”
রায়বাহাদুর স্থানীয় জমিদার নীরেন চাটুয্যের বাড়িতে বসিয়া সভা সম্বন্ধে পরামর্শ ও আয়োজন করিতেছিলেন।

নীরেনবাবু রায়বাহাদুরের মাসতুতো ভাই, স্থানীয় জমিদার ও উকিল। উকিল হিসাবে হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু জমিদারির আয় ও পূর্বপুরুষ সঞ্চিত অর্থে রানাঘাটের মধ্যে অনেকেই তাঁহার সঙ্গে পারিয়া উঠেন না। শিক্ষিত লোকও বটে।

রায়বাহাদুর গুরুভোজন করিয়া উঠিয়াছেন মধ্যাহ্নে। ধনী মাসতুতো ভাই-এর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন রীতিমতো গুরুতর। দু-একবার নিদ্রাকর্ষণ হইতেও ছিল, কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে শুইতে পারেন নাই।
নীরেনবাবু বলিলেন,-”আচ্ছা দাদা, বক্তৃতায় মোটকথাটা কী হবে আজকের?”
”তা ঠিক জানিনে। On the unity of forces এই বিষয়বস্তু। এ থেকে ধরে নাও।”
”উনি Space-এর অবস্থা শোচনীয় করে তুলেছেন, কী বলুন?”
’অর্থাৎ?”
’space বলছেন সীমাবদ্ধ। আগেকার মতো অসীম অনন্ত space আর নেই।”
”তোমার ম্যাথমেটিকস ছিল এম. এসসি.-তে? Geometry of Hyperspaces পড়েছ?
”মিক্সড ম্যাথমেটিকস ছিল। আপনি যা বলছেন, তা আমি জানি।”

খুব খুশি হলুম দেখে নীরেন যে শুধু জমিদারি করো না, জগতের বড়ো বড়ো বিষয়ে একটু-আধটু সন্ধান রাখখা। খুব বেশি সন্ধান হয়তো নয়, তবুও The very little that you know is unknown to many”.
’আচ্ছা দাদা, উনি কি আজই চলে যাবেন?”
”সম্ভব। দার্জিলিং যাবেন বলছিলেন। দার্জিলিঙের পথে এখানে নামবেন। যাতে ওঁর দু-পয়সা হয়, সেদিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
”আজ সভার পরে আমার বাড়িতে আসুন না একবার দাদা? এখানে রাতের জন্যে রাখতেও আমি পারি। আজ দার্জিলিঙের গাড়ি নেই। রাত্রে এখানে থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না।”
”বেশ, বলব এখন।”
”যাতে থাকেন তাই করুন। কালই খবরের কাগজে একটা রিপোর্ট করিয়ে দেব এখন। ফ্রি প্রেসের আর আনন্দবাজারের রিপোর্টার এখানে আছে।”

রায়বাহাদুর বুঝিলেন তাঁর মাসতুতো ভাইটি দরদ কোথায়। সেসব কথা বলিয়া কোনো লাভ নাই, এখন কোনোরকমে কার্যসিদ্ধি হইলেই হয়। কোনোরকমে আজ মিটিং চুকিলে বাঁচেন।
বাড়ির ভিতর হইতে নীরেনবাবুর মেয়ে মীনা আসিয়া বলিল,-”ও জ্যাঠামশায়, বাবাকে বলে আমাদের টিকিটের টাকা দিন।”
নীরেনবাবু ধমক দিয়া বলিলেন,—”যা যা বাড়ির মধ্যে যা, এখন বিরক্ত করিসনি। ব্যস্ত আছি।”
মীনা আবদারের সুরে বলিল,-”তোমাকে তো বলিনি বাবা, জ্যাঠামশাইকে বলছি।”
রায়বাহাদুর জিজ্ঞাসা করিলেন,–”কীসের টিকিটরে মিনু?”

মীনা বলিল,-”আপনি কোথায় থাকেন যে সবর্দা! আমাদের পাশের বাড়ির সবিতা আপনাদের কলেজে পড়ে, সে বলে আপনি নাকি পথ চলতে চলতে অঙ্ক কষেন। সত্যি, হ্যাঁ জ্যাঠামশাই?”

নীরেনবাবু পুনরায় ধমকের সুরে বলিলেন,—’আঃ, জ্যাঠা মেয়ে! যা এখান থেকে। জ্বালালে দেখছি। কীসের টিকিট জানেন দাদা, ওই যে ইন্দুবালা নাকি আজ আসছে আমাদের এখানকার বাণী সিনেমাতে, নাচ-গান হবে, কী নাকি বক্তৃতাও দেবে, তাই পাড়াসুদ্ধ ভেঙেছে দেখবার জন্যে। মেয়েরা তো সকাল থেকে জ্বালালে।”

’তা দাও না ওদের যেতে। আইনস্টাইনের লেকচারে আর ওরা কী যাবে। তবে দেখে রাখলে একটা বলতে পারত সারাজীবন। কীরে মিনু, কোথায় যাবি?”

”আমরা জ্যাঠামশাই সিনেমাতেই যাই। ‘মিলন’ ফিলমে ইন্দুবালাকে দেখে পর্যন্ত বড় একটা ইচ্ছে আছে ওকে দেখব। রানাঘাটে অমন লোক আসবে—’
রায়বাহাদুর বাকিটুকু জোগাইয়া বলিলেন,—”স্বপ্নের অগোচর! তাই না মিনু? টিকিটের দাম দিয়ে দাও মেয়েকে, ওহে নীরেন।”

মীনা এবার সাহস পাইয়া বলিল,—’’আপনাকে আর বাবাকে যেতে হবে আমাদের নিয়ে। সে শুনছিনে। বাবার মনে মনে ইচ্ছে আছে জ্যাঠামশায়। শুধু আপনার ভয়ে—”।
নীরেনবাবু তাড়া দিয়া বলিলেন,—’তবেরে দুষ্টু মেয়ে—“
মীনা হাসিতে হাসিতে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল।
যাইবার সময় বলিয়া গেল,—”বাবা, তোমাকে যেতেই হবে আমাদের নিয়ে। ছাড়ব না বলে দিচ্ছি।”

দার্জিলিং মেলের সময় হইয়াছে। বেলা সাড়ে পাঁচটা। রা য়বাহাদুর ও কয়েকজন ছাত্র, নীরেনবাবু ও শ্রীগোপালবাবু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু—এ কী?

এত ভিড় কীসের? প্ল্যাটফর্মের চারিদিকে এত ছোকরা ছাত্র, লোকজনের ভিড়! সত্যই কী আজ আইনস্টাইনের উপস্থিতিতে এখানকার সকলের টনক নড়িয়াছে? ইহারা সকলেই দার্জিলিং মেলের সময় আসিয়াছে তাঁহাকে নামাইয়া লইতে? অত বড়ো বৈজ্ঞানিকের উপযুক্ত অভ্যর্থনা বটে! লোকে লোকারণ্য প্ল্যাটফর্ম। হইহই কাণ্ড। রায়বাহাদুর পুলকিত হইলেন। সশব্দে মেল ট্রেন আসিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করিল।

একটি সেকেন্ড ক্লাস কামরা হইতে ছোটো একটি ব্যাগ হাতে দীর্ঘকেশ আয়তচক্ষু আইনস্টাইন অবতরণ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশের একটি ফার্স্ট ক্লাস কামরা হইতে জনৈক সুন্দরী তরুণী, পরনে দামি ভয়েল শাড়ি, পায়ে জরিদার কাশ্মীরি স্যান্ডাল—হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলাইয়া নামিয়া পড়িলেন। তরুণীর সঙ্গে আরও দুটি তরুণী, দুটিই শ্যামাঙ্গী—দুজন চাকর, তারা লাগেজ নামাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
কে একজন বলিয়া উঠিল, ‘‘ওই যে নেমেছেন! ওই তো ইন্দুবালা দেবী—“
মুহূর্ত মধ্যে প্ল্যাটফর্মসুদ্ধ লোক সেদিকে ভাঙিয়া পড়িল। সেই ভীষণ ভিড়ের মধ্যে রায়বাহাদুর অতিকষ্টে আইনস্টাইনকে লইয়া গেটের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

আইনস্টাইন অত বুঝিতে পারেন নাই, তিনি ভাবিলেন তাঁহাকেই দেখিবার জন্য এত লোকের ভিড়। রায়বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—”এরা সবই কী স্থানীয় ইউনিভার্সিটির ছাত্র? এদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন না মিঃ মুখার্জি?’
রায়বাহাদুর এই উদার সরলপ্রাণ বিজ্ঞানতপস্বীর ভ্রম ভাঙাইবার চেষ্টা করিলেন।
রানাঘাটে আবার ইউনিভার্সিটি! হায়রে, এ দেশ কোন দেশ তা ইনি এখনও বুঝিতে পারেন নাই। সবই ইউরোপ নয়।

নীরেনবাবু চাহিয়া-চিন্তিয়া স্থানীয় প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ধনী গোপাল পালেদের পুরোনো ১৯১৭ সনের মডেলের গাড়িখানি জোগাড় করিয়াছিলেন। তাহাতেই সকলে মিলিয়া চড়িয়া মিউনিসিপ্যাল হলের দিকে অগ্রসর হইলেন। গাড়িতে উঠিবার সময় দেখা গেল তখনও বহুলোকে স্টেশনের গেটের দিকে ছুটিতেছে। একজন কে বলিতেছিল,—”গাড়ি অনেকক্ষণ এসেছে, ওই দেখো লেগে আছে। প্ল্যাটফর্মে। শিগগির ছোটো।” ভিড়ের মধ্যে কে উত্তর দিলে,—”এখান দিয়েই তো বেরুবেন, আর ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দরকার নেই। বড্ড ভিড়। ও তো চেনা মুখ। দেখলেই চেনা যাবে। কত ছবিতে দেখা আছে। সেদিনও ‘মিলন’ ফিলমে—”

আইনস্টাইন কৌতুকের সঙ্গে বলিলেন,—”এরাও ছুটেছে স্টেশনে বুঝি? ওরা জানে না যাকে দেখতে চলেছে সে তাদের সামনেই গাড়িতে উঠেছে। বেশ মজা, না? মিঃ মুখার্জি, এখানে ইউনিভার্সিটি কোন দিকে?”

সৌভাগ্যক্রমে ভিড়ের মধ্যের একটা লোক আইনস্টাইনের গাড়ির সামনে আসিয়া চাপা পড়-পড় হওয়াতে হঠাৎ ফুটব্রেক কষার কর্কশ শব্দের ও ‘এই এই ‘গেল গেল’ রবের মধ্যে তাঁহার প্রশ্নটা চাপা পড়িয়া গেল। স্টেশন ও ভিড় ছাড়াইয়া কিছুদূর অগ্রসর হইতেই মোড়ের মাথায় শ্রীগোপালবাবু ও নীরেনবাবু নামিয়া গেলেন। রায়বাহাদুর বলিলেন,—”এখুনি আসবেন তো?”

শ্রীগোপালবাবু কী বলিলেন ভালো বোঝা গেল না। নীরেনবাবু বলিলেন, “ওখানে ওদের পৌঁছে দিয়েই আসছি। আর কেউ বাড়িতে লোক নেই মেয়েদের নিয়ে যেতে। টিকিটে এতগুলো টাকা যখন গিয়েছে—“

ওই সামনেই মিউনিসিপ্যাল হল। স্টেশনের কাছেই। কিন্তু এ কী? সাড়ে পাঁচটা সময় দেওয়া ছিল। পৌঁনে ছ-টা হইয়াছে, কেউ তো আসে নাই। জনপ্রাণী নয়। কেবল মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি জীবন ভাদুড়ি একটা ছোটো টেবিলে অনেকগুলি টিকিট সাজাইয়া শ্রোতাদের কাছে বিক্রয়ের জন্য অপেক্ষা করিতেছে।

মোটর হলের সামনে আসিয়া দাঁড়াইতে আইনস্টাইনের হাত ধরিয়া নামাইলেন রায়বাহাদুর। মুখে হাসি ফুটাইবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন,—”হে বৈজ্ঞানিক শ্রেষ্ঠ, সুস্বাগতম। আমাদের রানাঘাটের মাটিতে আপনার পদার্পণের ইতিহাস সুবর্ণ অক্ষরে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করুক—আমরা রাণাঘাটবাসীরা আজ ধন্য!”

চকিত ও উদবিগ্ন দৃষ্টিতে শূন্যগর্ভ হলের দিকে চাহিয়া দেখিলেন সঙ্গে সঙ্গে। লোক কই? রানাঘাটবাসীদের অন্যান্য প্রতিনিধিবর্গ কোথায়?

আইনস্টাইন বিস্মিত দৃষ্টিতে জনশূন্য হলের দিকে চাহিয়া বলিলেন,—”এখনও আসেনি কেউ? সব স্টেশনে ভিড় করছে। মিঃ মুখার্জি, একটা ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবস্থা করতে হবে যে। বক্তৃতার সময় ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকবার দরকার হবে।”

আর ব্ল্যাকবোর্ড! রায়বাহাদুর স্থানীয় ব্যক্তি। নাড়িজ্ঞান আছে এ জায়গার। তিনি শূন্য ও হতাশ দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন।

জীবন ভাদুড়ি কাছে আসিয়া চুপি চুপি বলিল,-”মোটে তিন টাকার বিক্রি হয়েছে। তাও টাকা দেয়নি এখন। কী করব বলুন সার? আমাকে কতক্ষণ থাকতে হবে বলুন। আমার আবার বাসার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাণী সিনেমায় যেতে হবে। কলকাতা থেকে ইন্দুবালা এসেছেন—বাড়িতে বড্ড ধরেছে সব। পঁয়ত্রিশ টাকা মোটে মাইনে—তা বলি, থাক গে, কষ্ট তো আছেই। এঁদের মতো লোকে রোজ কলকাতা থেকে আসবেন না। যাক, পাঁচ টাকা খরচ হলে আর কি করছি বলুন। আমায় একটু ছুটি দিতে হবে সার। এ সায়েব কে? এ সায়েবের লেকচারে আজ লোক হবে না—কে আজ এখানে আসবে সার!”

জীবন ভাদুড়ি ক্যাশ বুঝাইয়া দিয়া খসিয়া পড়িল। হলের মধ্যে দেখা গেল চেয়ার বেঞ্চির জনহীন অরণ্যে মাত্র দুটি প্রাণী—আইনস্টাইন ও রায়বাহাদুর।

আইনস্টাইন ব্যাগ খুলিয়া কী জিনিসপত্র টেবিলের উপর সাজাইতে ব্যস্ত ছিলেন, সেগুলি তাঁহার বক্তৃতার সময় প্রয়োজন হইবে—সেই সুযোগে রায়বাহাদুর একবার বাহিরে গিয়া রাস্তার এদিক-ওদিক উদবিগ্নভাবে চাহিতে লাগিলেন।

লোকজন যাইতেছে, ঘোড়ার গাড়িতে মেয়েরা সাজগোজ করিয়া চলিয়াছে, দ্রুতপদে পথিকদল ছুটিয়াছে—সব বাণী সিনেমা লক্ষ্য করিয়া।

রায়বাহাদুরের একজন পরিচিত উকিলবাবু ছড়িহাতে দ্রুতপদে জনসাধারণের অনুসরণ করিতেছিলেন, রায়বাহাদুরকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন,—”এই যে! সাহেব এসেছেন? লোকজন কেমন হয়েছে ভেতরে? আজ আবার আনফরচুনেটলি ওটার সঙ্গে ক্ল্যাশ করল কিনা? অন্যদিন হলে—না, আমার জো নেই—বাড়ির মেয়েরা সব গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কেউ নেই। বাধ্য হয়ে আমাকে—কাজেই—’

রায়বাহাদুর মনে মনে বলিলেন—হ্যাঁ, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও।
আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল। সাড়ে ছটা। পৌঁনে সাতটা। সাতটা।
জনপ্রাণী নাই। বাণী সিনেমাগৃহ লোকে লোকারণ্য। টিকিট কিনিতে না-পাইয়া বহুলোক বাহিরে দাঁড়াইয়া জটলা করিতেছে। একদল জোর-জবরদস্তি করিয়া ঢুকিবার চেষ্টা করিয়া বিফলমনোরথ হইয়াছে। মেয়েদের বসিবার দুই দিকের ব্যালকনির অবস্থা এরূপ যে আশঙ্কা হইতেছে ভাঙিয়া না-পড়ে। স্টেজে যবনিকা উঠিয়াছে। চিত্রতারকা ইন্দুবালা সম্মুখে দাঁড়াইয়া গান গাহিতেছেন—তাঁরই গাওয়া ‘মিলন’ ছবির কয়েকখানি দেশবিখ্যাত, বালক বৃদ্ধ যুবার মুখে মুখে গীত গান—’জংলা হাওয়ায় চমক লাগায়’, ‘ওরে অচিন দেশের পোষা পাখি’, ‘রাজার কুমার পক্ষীরাজ’ ইত্যাদি।

এমন সময়ে রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় ভিড় ঠেলিতে ঠেলিতে টকিহলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই সম্মুখে শ্রীগোপালবাবুকে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। পাশেই অদূরে নীরেনবাবু বসিয়া। বলিলেন—”বা রে, আপনিও এখানে!”।

হঠাৎ ধরাপড়া চোরের মতো থতমতো খাইয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে শ্রীগোপালবাবু বলিলেন—’’আসার ইচ্ছে ছিল না, কী করি, কী করি—মেয়েরা— ওদের আনা—ইয়ে—সাহেবের লেকচার কেমন হল? লোকজন হয়নি?”
”কী করে হবে? আপনারা সবাই এখানে। লোক কে যাবে?”
”সায়েব কোথায়? চলে গেলেন?”
”এই যে—”
রায়বাহাদুরের পিছনেই দাঁড়াইয়া স্বয়ং আইনস্টাইন। শ্রীগোপালবাবু শশব্যস্তে উঠিয়া আইনস্টাইনের হাত ধরিয়া খাতির করিয়া নিজের চেয়ারে বসাইলেন।

একটি খবরের কাগজের কাটিং রাখিয়াছিলাম। সেটি এখানে জানাইয়া দেওয়া গেল— এখানে আলুর দর ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে। ধানের দর কিছু কমের দিকে। ম্যালেরিয়া কিছু কিছু দেখা দিয়াছে। স্থানীয় সুযোগ্য সাবডিভিশনাল অফিসার মহোদয়ের চেষ্টায় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হইয়াছে।

গত সপ্তাহে স্থানীয় বাণী সিনেমা গৃহে সুপ্রসিদ্ধ চিত্রতারকা ইন্দুবালা দেবী শুভাগমন করেন। নৃত্যকলা-নৈপুণ্যে ও কিন্নরকণ্ঠের সংগীতে তিনি সকলের মনোহরণ করিয়াছেন। বিশেষত ‘কালো বাদুড় নৃত্যে তিনি যে উচ্চাঙ্গের শিল্প সংগতি প্রদর্শন করিয়াছেন, রানাঘাটবাসীগণ তাহা কোনোদিন ভুলিবে না। এই উপলক্ষ্যে উক্ত সিনেমাগৃহে অভূতপূর্ব জনসমাগম হইয়াছিল—সেও একটি দেখিবার মতো জিনিস হইয়াছিল বটে। লোকজনের ভিড়ে মেয়েদের ব্যালকনির নীচে বরগা দুমড়াইয়া গিয়াছিল। ঠিক সময়ে ধরা পড়াতে একটি দুর্ঘটনার হাত হইতে সকলে বাঁচিয়া গিয়াছেন।

বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন গতকল্য দার্জিলিং যাইবার পথে এখানে মিউনিসিপ্যাল হলে বক্তৃতা দিতে নামিয়াছিলেন। তাঁহাকেও সেদিন বাণী সিনেমা গৃহে ইন্দুবালার নৃত্যের সময় উপস্থিত থাকিতে দেখা গিয়াছিল।