বেশ্যাকন্যা

পর্ব ১০

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০১৮

ঘরের ভেতর আসবাবপত্র খুবই নগন্য। ছোট্ট ঘরের বাম পাশের টিনের বেড়া ঘেঁষে বসানো রয়েছে চৌকি। তার ওপর সাজানো রয়েছে সাদা কভারের চারটি বালিশ। সাথে লাল কভারের লেপ। ওপরের দিকে ঝুলন্ত দরিতে অগোছালো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়। ঘরের ডান কোণে বসানো রয়েছে ছোট্ট কাঠের টেবিল। তাতে কী জানি খোঁজার চেষ্টা করছে একটি মেয়ে।

বেশ্যা বলেই কি তাদের সাজতে নেই? তারা সাজে জীবিকার জন্য। সাজে খদ্দের ধরার জন্য। আর আমরা? গলির মাঝে ঢালা খুলে বসেছে ফেরিওয়ালা। তাকে ঘিরে আছে কয়েকজন মহিলা। মুখ বানানোর কসমেটিক কিনছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আনন্দে আত্মহারা। ভিডিও হচ্ছে বলে কথা, কী দারুণ দেখতে... আহা! দুষ্টু তিনটি ছেলে নাংটো শরীরে পোজ দেবার জন্য দাঁড়িয়ে গেল ক্যামেরার সামনে। ছোট দুটি ছেলে নিঃস্বপ্রাণ থাকলেও বড়টি কিন্তু মিটিমিটি হাসছে।

হয়তো ভাবছে, যা ছবি তোলার এই বয়সেই নাংটো হয়ে তুলে নেই। বড় হলে তো এই সুযোগ আর পাব না। হি হি হি। একি, বাচ্চাদের মুখের ওপর ধোঁয়া আসল কোথা থেকে? ও আচ্ছা, তাদের পাশে বসে থাকা এক মাঝবয়সী মহিলা সুখের টানে গা ভাসিয়ে দিয়েছে জলন্ত সিগারেট মুখে নিয়ে। ধোঁয়া সেখান থেকে আসছে। ধোঁয়া... ধোঁয়া... ধোঁয়া...। সূর্য ডোবার আগমুহূর্তে দোকানের দরজার সামনে পানি ছিটানো, ধূপকাঠি/আগরবাতি জ্বালানো একটি পুরনো রেওয়াজ। মাটির ঘরের মেঝেতে গরুর গবর মিশ্রিত গোলা নিয়ে পাটের তৈরি ত্যানা/নোতা দিয়ে লেপ-পোচ আমরা অনেকেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। পল্লীর এই জায়গাটি এত নোংরা হলে কি হবে, তাদের মনেও যে ভালো লাগার অনুভূতি কিছুটা কাজ করে, তা ওই মাঝবয়সী মহিলার কাজকর্ম দেখলেই বুঝা যায়।

খালা কি করেন?
ঘরদোর মোছ করি।
কি দরকার এত কষ্ট করার?
তুমি গোসল করো ক্যা?
শরীর পরিষ্কার করার জন্য।
এবার বুচ্ছো...।
হ্যাঁ বুঝলাম, প্রতিদিন মোছেন?
হ্যাঁ বাবা, ছোট বেলার অভ্যাস। ঘরের দরজার সামনে পানি ছিটিয়ে, পানি দিয়ে ঘরের সানবান্ধা সিঁড়ি ধুয়ে দিয়ে, ঘরে একটি আগরবাতি জ্বালালে মনে শান্তি লাগে।
আসলেই তাই। আমাদের ঘরের ভিতর-বাইরে জমিয়ে থাকা ময়লার মতো দিনের পর দিন আমাদের মনের ভিতরও ময়লা জমে গেছে। ওই বেটা ওই, তালের শাস খাবি? ওই, তোরে ডাকতাছি হোনস না? এমনই পিছু-ডাকে সারা না দিয়ে দু’খদ্দের মুখ ফিরিয়ে হাসি দিয়ে অন্যগলি দিয়ে ভিতরে ঢুকল। মেয়েটি বলে উঠল, চুত, ভালো মাল খাইতে শিখলি না।

ক্যামেরা কিন্তু থেমে নেই। কামেরা চলছেই... পরনে পেটিকোট ও ব্লাউজ, বুকের উপর আলতে করে গামছা ফেলানো, পিছন থেকে দেখছি বলে মেয়েটির চেহারা চোখে পড়ছে না। মেয়েটির বাম হাতে খিলিকরা পান। ডান হাতের আঙুলে চুন। মেয়েটির শরীরের অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড রেগে গেছে। মুখ থেকে বেশ শ্রবণ অযোগ্য শব্দ বেরুচ্ছে। তর্ক করছে মাঝবয়সী এক পুরুষ খদ্দেরের সাথে। ক্যামেরা তার দিকে এগিয়ে যেতেই মেয়েটি আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েই, ছি ছি বলেই দিল ভো-দৌড়।

প্রতিদিনের তুলনায় আজকে খদ্দের কিছুটা কম। জানাজানি হয়ে গেছে পল্লীতে, আমরা ক্যামেরা নিয়ে কাজ করছি। বিকেল হতে শুরু করেছে। এখনও আমরা দুপুরের খাবার খেতে পারিনি। আমি আজকের মতো পল্লীতে শুটিং প্যাক-আপ করে খাবারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। কারণ খাবার শেষ করেই শুটিংয়ের জন্য রওনা দেব সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমে।

চলবে...