
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৩৪
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০১৮
আজকের ভালো লাগাটা অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। হাঁটছি... দু’একটা ছোট্ট শিশু ছবি তোলার জন্য আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। আমি বাচ্চা দুটিকে তার মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম। শিশুগুলোর মায়ের অবাক নয়নের প্রশ্ন, বাবা, তুমি এহানে ক্যান আইসো?
আমি বললাম, চাচি, আমি আপনাদেরকে নিয়ে কিছু কাজ করতে এসেছি।
আমাদেরকে নিয়ে আবার কিসের কাজ?
আপনাদেরকে নিয়ে ডকুমেন্টরি ও নাটক বানাবো।
কী যে কও বাবা, কিচ্ছু বুঝি না। সারাক্ষণ পেটের চিন্তায় থাকি। তোমরা কে কী করতাছো কিচ্ছু বুঝি না। তয় ভালো কিছু হইলে করো।
জি চাচি।
আমরা চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্যদিকে এগুতে লাগলাম। আজকের সূর্যটা কেন জানি মনে হচ্ছে, এ পল্লীর মানুষদের জন্যই উদিত হয়েছে। সূর্যের আলোর প্রখরতা এত বেশি, সেই আলোতে ঝলমল করে উঠছে সমগ্র প্রমোদনগরী। নারীদের বিভিন্ন রূপসজ্জার ওপর ঠিকরে পড়ছে সূর্যের বিক্ষিপ্ত আলোক রশ্মি। সভ্য সমাজের দোহায় দিয়ে আমরা তাদেরকে যতই অন্ধকারের বেড়াজালে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন, তারা ঠিকই সূর্যের আলোক শিখায় আলোকিত হয়ে উঠছে নতুনভাবে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন তাদের উপর পতিত সূর্যের আলোকচ্ছটা সরিয়ে নিতে পারব না। আমরা তাদের বেঁচে থাকার সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি, কিন্তু সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত করতে পারব না। ওইটা আসে ওপর থেকে। ওপরের ক্ষমতা অপরিসীম। আমি আজকে আমার ডকুড্রামার নায়ক চরিত্রে অভিনয়কারী আনোয়ারকে আমার সাথে দেখা করতে বলেছিলাম। সে রাজবাড়ীতে এক বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় তার সাথে দেখা হবে না আজকে। আজ যাব এক বড় আপার বাসায়। যে আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। আপার বাড়িতে মোট ১২টা ঘর। প্রায় সব ঘরেই মেয়ে আছে। আপার ঘরগুলির প্রতি মেয়েদের আলাদা আকর্ষণ আছে। আপার বাড়িটি পল্লীর মেইনগেট থেকে অল্প কিছু ভিতরে এবং পল্লীর প্রধান গলির সাথে যুক্ত। প্রধান গলিটি প্রায় ১০/১৫ ফিট প্রসস্ত। এটি পল্লীতে প্রবেশের প্রধান রাস্তা। এর থেকে অজস্র গলিপথ-শাখা-প্রশাখা হিসেবে এগিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রান্তে। এ পল্লীর সকল নারীদের বেচাকেনার প্রধান জায়গা হচ্ছে এ প্রধান গলি। এখানেই দিনের ২৪ ঘণ্টা মেয়েরা বিভিন্ন রকম দেহের রূপসজ্জা নিয়ে দাঁড়ায়ে পড়ে খদ্দের ধরার জন্য। সকালের নতুন সূর্য উদিত হবার সময় থেকে প্রতি মুহূর্তে নিত্য নতুন চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয় এই প্রধান গলিটি। সকালে মানুষের যে পরিমান সমাগম থাকে ঠিক তেমনিই লোক সমাগম থাকে রাত ২/৩ টার দিকেও। এ যেন দৈহিক ক্ষণিক সুখ বেচাকেনার মহামেলা। আপার নাম আলেয়া। আপার স্বামী/বাবু দৌলতদিয়া ঘাটে শ্রমিকের কাজ করে। ঘাটে সে যথেষ্ট প্রভাবশালী। আমাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। আপার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি এসএসসি পাশ করে কারিগরি কলেজে ডিপ্লোমা পড়ছে। সে রাজবাড়ি কলেজ হোস্টেলে থাকে। মাঝে মধ্যে এসে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে যায়। আমার প্রতি তার আবদার, আমি যেন তার পড়ালেখা শেষ হলে তাকে একটা ভালো চাকুরি জোগাড় করে দেই। আমিও আশ্বাস দিয়েছি। মেয়েটির বয়স ৫-৬ বছর। আমি আপার বাসায় যাওয়া মাত্রই দৌড়ে এসে কোলে চড়ে বসত। আপা প্রচণ্ড রেগে যেত তার কাণ্ড দেখে। কারণ তার শরীরে থাকত গলির ধূলাবালি। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই সে আমার কোল থেকে নামতো না। তাকে নিয়ে গিয়ে পাশের দোকান থেকে চিপস্ ও জুস কিনে দিলে তবেই কোল থেকে নেমে যেত। যতবার তাদের বাড়িতে গিয়েছি ততবার সে একই কাজ করতো এবং কোল থেকে নামার সময় কখনও ভুল করতো না আমার গালে চুমু দিতে। অসাধারণ অনুভূতি। সেটা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একজন বেশ্যার বাড়িঅলি আমার বড় বোন হবে! ভাবা যায়!
আমি কি মানুষ? কি করে সম্ভব? কি করে পারি আমি? তারা সমাজের নোংরা কীট। তাদের শরীর নাপাক। তাদের সন্তান আমার গালে চুমু দেবে! ছি ছি... ভাবা যায়? কিন্তু আমি ভাবি, আমার জন্ম এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে না হয়ে এই পল্লীর কোনও নারীর গর্ভে হতে পারতো। হলে কি হতো? আপনি-আমি আমাদের এই জন্ম রুখতে পারতাম? জন্ম দেবার সকল ক্ষমতা কার হাতে? তাদেরকে ঘৃণাই যদি করি তাহলে বারবার আমরা ছুটে যাই কিসের নেশায় তাদের কাছে? তখন কি লজ্জা হয় না? উপর থেকে সকল লজ্জা কি তাদের জন্যই বরাদ্ধ করেছে? নাকি নির্লজ্জ করেছে আমাদেরকে?
চলবে...