বেশ্যাকন্যা

পর্ব ৬১

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০১৮

সময়ের কাঁটা চলমান। এর মধ্যে সাতদিনের শুটিংয়ের ডেট করে ফেললাম। আমার সঙ্গে দুটি ক্যামেরা ইউনিটের প্রায় ১৬ জন সহযোদ্ধা ছিল। আমি আমার শুটিং ইউনিট নিয়ে শিউলির বাড়ির একটি ঘরে উঠে পড়লাম। এ ঘরে শুটিংয়ের যাবতীয় উপকরণ রাখা হবে। সারাদিন শুটিং শেষে আমরা সবাই গিয়ে বিশ্রাম নেব পল্লীর মেইন গেটের সামনে অবস্থিত একটি হোটেলে।

আমি টাঙ্গাইলে যেভাবে শুটিং করেছি তারচেয়েও সহজ-সরলভাবে এবং নির্বিঘ্নে শুটিং পর্ব শেষ করলাম। মোট সাতদিন ডে-নাইট শুটিং করে আমি দুটি ডকুমেন্টরি ও একটি ডকুড্রামা তৈরি করতে পেরেছিলাম। আমার শুটিংয়ের প্রথম দিন সকল সহকর্মীর জন্য রান্নার ব্যবস্থা করেছিল শিউলি তার নিজ বাড়িতে। আমি বারবার অনুরোধ করেছিলাম, এতগুলো মানুষ (আমার সহকর্মী ১৬ জন+ শিউলির বাড়ির দশজন+ অভিনয় শিল্পীসহ (লোকাল) স্থানীয় পোলাপান ২২জনসহ মোট প্রায় ৪৮ জনের রান্না শিল্পী নিজ হাতে করেছিল। ডাল, ভাত, সবজি, মুরগির গোস্ত ও রুই মাছ ভাজা। সঙ্গে যোগ হয়েছিল আমার জন্য স্পেশাল ইলিশ মাছের ডিমভাজা। আমি অভিভূত!

খরচের সমুদয় অর্থ আমার পকেট থেকে যাচ্ছে, কিন্তু এখানকার মানুষদের ঐকান্তিক ভালোবাসার ছোঁয়া আমাদের ইউনিটের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছিল। শুটিংয়ের ফাঁকে যে যার সময়মতো খাবার খেয়ে নিচ্ছে। শুটিং চলাকালীন সময়ে বিকালের কোনও এক মুহূর্তে শিউলি একটি প্লেটে খারার সাজিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেল। তখন আমি ক্যামেরার প্রিভিউ মনিটরের সামনে বসে দৃশ্য ধারণের কাজে ব্যস্ত। শিউলি নিজে না খেয়ে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছিল। দু’তিন বছরের অভিজ্ঞতা বলে দেই, এরা ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের বরখেলাপ কখনও করে না।

শুটিংয়ের প্রতিরাতে আমাদের ইউনিটের যাবতীয় যন্ত্রপাতি শিউলির একটা ঘরে রেখে চলে যেতাম। শিউলির আস্থা কোনও সমস্যা হবে না। সত্যি সত্যি কোনও সমস্যা হতো না। আলেয়া আপার বাসায় কখনোও এসে খাবার খাই নাই। শুটিংয়ের চতুর্থ দিন তিনি আমাদের জন্য নিজ খরচে পাঁচ কেজি গরুর মাংসসহ দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমরা শুটিংয়ের ব্যস্ততায় খেতে যেতে না পারাই তিনি ও তার বাড়ির মেয়েরা প্রচণ্ড রাগ করে। তাদের রাগ ভাঙানোর জন্য বাধ্য হয়ে রাত আটটার দিকে গিয়ে আমরা কয়েকজন খাবার খেয়ে এসেছি।
তিনি বললেন, ভাই শুটিং করবে, বড় বোনের বাসায় খাবে না তা কী করে হয়!
আমি মুগ্ধ।

শুটিংয়ের দ্বিতীয় দিন। পল্লীর মেইন গলিতে শুটিং করব, সকাল ৭টায় আমরা সকল ইউনিট রেডি। আমার সিলেক্টকৃত চায়ের দোকান পুরোটাই খালি। সেখানে ট্রলি বসানো হয়েছে। মেইন গেট লোকাল পোলাপান দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দুপাশে প্রায় ৫০০-৭০০ মানুষ আটকে রয়েছে। প্রচণ্ড হট্টগোল হচ্ছে। কিন্তু সামনের দিকে আসার সাহস পাচ্ছে না। খুব দ্রততার সাথে এখানকার শুটিংপর্ব শেষ করে ফেলতে হবে। দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে এখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকবে। তখন শুটিং করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। ট্রলিতে ক্যামেরা বসিয়ে মামুন রেডি। চা দোকানের বিপরীত পাশের একটি পানের দোকানের থরে থরে সাজানো পানের সজ্জার দৃশ্য আমি নিতে চাই। পানের দোকানদার শুটিং করতে দেবে না। বাধ্য হয়ে তার দোকানের সকল পানের দাম দিয়ে তাকে রাজি করানো হলো। তার দোকানের সাথে লাগানো বাড়ির লোহার ক্লফসের গেইটের ভিতর থেকে আমাদের ক্যামের শর্ট নিতে হবে। বাড়ির মালিক গেটে তালা দিয়ে রেখেছে। আমি প্রথমে ভদ্র ভাষায় অনুরোধ করলাম, কিন্তু তা না শুনাতে আমার সঙ্গে থাকা ছেলেগুলো তাকে মারতে এগিয়ে গেলে বাধ্য হয়ে তালা খুলে দিয়ে শুটিং করতে দেয়। মেইন গলিতে মায়া ও সাগর দাঁড়িয়েছে শট দেবার জন্য। হঠাৎ কোথা থেকে যেন উড়ে এসে ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়াল সাগরে বড় বোন। সে তাকে শুটিং করতে দেবে না। কিন্তু সাগর শুটিং করবে। এটা নিয়ে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা চলল আমার ও সাগরের বোনের সাথে। সাগর শুটিং না করলে আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে যাবে। এর মধ্যে সাগরের মা এসে তার মেয়েকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো কিন্তু সে সরল না। আমি শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সাগরের বোনকে ক্যামেরার সামনে রেখেই শুটিং করে ফেলব। মামুনকে ক্যামেরা অন করতে বললাম, তাকে নির্দেশনা দিলাম সাগরের বোনের ক্লোজ শট নেবার জন্য। ক্যামেরা অন করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে মুখে ওড়না চেপে দৌড়ে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি আমার বহুকষ্টে এখানকার শুটিংপর্ব শেষ করলাম। অনেক অনেক রেগে আছে সাগরের বোন আমার উপর। আমি অনেকটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি এখানকার শুটিং শেষ করতে পেরে।

চলবে