বেশ্যাকন্যা

পর্ব ৬২

সরদার মেহেদী হাসান

প্রকাশিত : মে ০৪, ২০১৮

শুটিং করতে গিয়ে আমার সহকর্মীরা সবাই খুবই এক্সসাইটেড। সবাই যেন সমুদ্রে শুটিং করতে এসেছে, চারদিকে ঢেউ আর ঢেউ! আমার নির্দেশনা ছিল, সাগরের সৌন্দর্য দেখে কেউ যেন সাগরে লাফ দিতে যেও না। কেউ যদি ভুল করে দিয়েও থাকো, অবশ্যয় সেফগার্ড পরে নিও। পানির গভীর খুঁজতে যেয়ে যেন দুরে চলে যেও না। কিনারের পাশাপাশি থেকো। ছোট নৌকায় চড়তে যেও না। উল্টে পানিতে পড়ার ভয় থাকবে। বড় নৌকাতে চড়বা, তাড়াতাড়ি পাড়ে ফিরে আসবা। সাঁতারে যাবার আগে পকেটের দামি জিনিসপত্র অন্যের কাছে গচ্ছিত রেখে যাবে। নয়তো খোয়া যাবার ভয় আছে। বিপদে পড়লে স্মরণ করবা।

বিদ্যুৎ অফিস থেকে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে গেছে। আমরা ষষ্ঠ দিনে রাত প্রায় ২-৩টা পর্যন্ত শুটিং করেছি ঝিলের পাশে। এর মধ্যে মায়ার বাবু এসে আমার সাথে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে গেছে। রাতের দৃশ্যটি ছিল আমার ডকুড্রামার শেষ দৃশ্য। অনেকটা দুঃখ-রোমান্টিক ধাঁচের দৃশ্য এটি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল এই দৃশ্যটি শুটিং করতে। দৃশ্যটি বেশ বড় হওয়ায় মায়া ও আনোয়ার বারবার ভুল করছিল এবং হেসে ফেলছিল। যাই হোক, ভালোয় ভালোয় শুটিং শেষ করতে পেরেছি।

পঞ্চম দিন দুপুরে একটি জুসের দোকানে খৈইল করার উপর একটি দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে প্রায় ফেঁসেই গিয়েছিলাম। এখানকার লোকাল চার-পাঁচটি ছেলে নিয়ে শুটিং করছিলাম। শুটিংয়ে যে ছেলেটি দোকানদার ছিল তার বড় বোন কোথা থেকে খবর পেয়ে চিলের মতো ছোঁ মেরে তার হাত ধরে তুলে নিয়ে চলে গেল। শুরু হলো হট্টগোল। কিছু দৃশ্য অসমাপ্ত রেখেই শেষ করলাম সে শুটিং।

কত যে নাটক... নাটক করতে নতুন নতুন নাটকের জন্ম। নাটকে একটা দৃশ্যে চিকিৎসা কাজে দক্ষ একজন সিস্টার হিসেবে মায়ার অভিনয় করার কথা ছিল। সে সকাল থেকেই শুধু আসছে আসছে করছে কিন্তু আসার কোনো নামগন্ধ নেই। তার অনুপস্থিতিতে অন্যসকল দৃশ্যের শুটিংয়ের কাজ শেষ করে এগিয়ে যেতে থাকলাম। সন্ধ্যায় মায়ার রুমেই লাইট করে শুটিংয়ের জন্য রেডি করলাম। সিস্টার আসছে আসছে করেও আসলেন না। কে যেন তাকে বলেছে, শুটিং করলেই তার জীবন শেষ!

কী আর করার! মোবাইল বন্ধ করে সরে পড়েছে। আমরা সবার অপেক্ষার পালা যায় যায় অবস্থা। কাকে নেব এখন? প্রায় তিন-চার ঘণ্টা ধরে খেটে ঘরে লাইট করা হয়েছে। ঘর খুবই ছোট। খুব কষ্ট করে কাজকর্ম করতে হচ্ছে। অনেক মেয়ের নাম কানে আসছে। কিন্তু কাকে নেয়া হবে? কে পারবে? সাধারণ কাউকে নেয়া যাবে না, যে এই দৃশ্যে ডাক্তারের অভিনয় করবে। তাকেও যৌনকর্মী হতে হবে। এ দৃশ্যটি করার জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে হালকা কিছু ধারণা থাকা প্রয়োজন। লাইট জ্বলছে তো জ্বলছেই। সময় যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হঠাৎ করে একজনকে পাওয়া গেল, যে কীনা কিছুদিন একটি এনজিওর স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছে। সে শুটিং করতে রাজি নয়, কিন্তু বুঝানোর পর রাজি হলো।

আমার বুকে যেন পানি আসলো। নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে। শুটিং শুরু হলো। প্রথম থেকেই ভুল। টেক হচ্ছে আর ভুল হচ্ছে। এভাবে প্রায় দু’ঘণ্টা যাবার পর ক্যামেরাম্যান মামুন আমার কাছে মাপ চেয়ে ক্যামেরা ছেড়ে সিগারেট টানতে চলে গেল। অন্যদিকে মেয়েটি হাঁপিয়ে উঠেছে, আমি পানি খাবো, আমি পানি খাবো। তাকে পানি খাওয়ানো হলো। ঘরের শুটিং লাইট আধা ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখতে বললাম। লাইট বন্ধ হলো।

কয়েক কাপ চা দিতে বললাম। চা খেতে খেতে মেয়েটিকে ঠাণ্ডা মাথায় দৃশ্যটি বুঝিয়ে বললাম। সে বুঝার চেষ্টা করলো। আমি তাকে একেবারেই লোকাল ভাষায় কথা বলতে বললাম। সে এখন অনেকটা স্থির। আমরা শুটিংয়ের জন্য আবার প্রস্তুত হলাম। লাইট অন। মায়া অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে রয়েছে, সবাই বলাবলি করছে তার এইডস হয়েছে, বিষয়টি দেখার জন্যই ডাক্তার এসেছে। ক্যামেরা আবারও অন হলো। রেকর্ড চলছে। আবারও ভুল হচ্ছে। আমি হেসে হেসে তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, চিন্তা নেই। এবার হয়ে যাবে।

মনে হলো, সেও মনবল ফিরে পেল। শেষমেষ অনেক কষ্ট হলেও রাত ১২টার সময় সঠিকভাবে শুটিং শেষ করতে পারলাম। ইউনিটের সবাই মানসিক ও কায়িকভাবে ক্লান্ত। আজকের মতো শুটিং বন্ধ।

চলবে