
বেশ্যাকন্যা
শেষ পর্ব
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মে ০৯, ২০১৮
বাংলাদেশের নিষিদ্ধ পল্লী নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে ২০০৬ থেকে ধারাবাহিকভাবে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়। দিনের পর দিন... বছরের পর বছর ধরে আমি তাদেরকে নিয়ে কাজ করেছি। এর সবই করেছি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিয়েটিভ টাচ’ এর ব্যানারে। ২০১২ সালের পর থেকে বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততায় তাদেরকে নিয়ে কোনও কিছু করার আর সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তাদেরকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। আমার মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করে, দু’একটি এনজিও অথবা সরকারের সামান্য কিছু উদ্যোগেই যৌন পেশা সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। যে পেশাটিকে আমরা পৃথিবীর আদিপেশা হিসেবে জানি, সেটিকে ফুঁ দিয়েই তুলার মতো আকাশে উড়িয়ে দেয়া যাবে তাও আমি ভাবছি না। তবে যদি আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও শক্ত মন-মানসিকতা থেকে থাকে, তাহলে এই পেশাটিকে পুরোপুরি না হোক, অনেকাংশে নির্মূল করা যেতে পারে।
বেশ্যা কোনও ভিন গ্রহের প্রাণী নয়। এরা কোনও এক যুগে রাতের অন্ধকারে উড়ে এসে এই পৃথিবীতে জুড়ে বসেনি। এরা মানুষ। এরা নারী। এরা মায়ের জাতি। তাহলে এরা বেশ্যা হলো কেন? অনেক ইতিহাস রয়েছে। তবে যতটুকু জানা যায়, কোনও নারীই জন্মের পর থেকেই যৌনকর্মী হিসেবে জন্মলাভ করে না। জন্ম নেয়া প্রতিটি মেয়েশিশুই নিষ্পাপ মায়ের প্রতিচ্ছবি। একটি ছোট্ট মেয়েশিশু কখনও স্বপ্ন দেখে না, সে বড় হলে বেশ্যা হবে। তাহলে বেশ্যা হচ্ছে কারা? বেশ্যারা কোনও মেঘযুক্ত আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো দেখতে শিলাপাথর নয়।
তাহলে এখন জানতে হবে, সভ্য ও অসভ্য সমাজ ব্যবস্থা কাদের সৃষ্টি? আমরা, মানে পুরুষরা, বহুগামী পুরুষরা যতদিন পৃথিবীতে থাকব, ততদিন এই পৃথিবীতে বেশ্যাও থাকবে। বেশ্যা এবং বহুগামী পুরুষ একটি মুদ্রার এপিট-ওপিট। যারা জন্মগতভাবে বেশ্যার গর্ভে জন্ম নিয়ে বেশ্যা হচ্ছে, সেটি না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু যারা আমাদের সভ্য সমাজের সভ্য মানুষের সভ্য মায়ের গর্ভে জন্মলাভ করে বেশ্যা হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আমরা কি বলব? বেশ্যা... ছি: ছি: ছি: বেশ্যার নাম শুনতে আমাদের খারাপ লাগে। কিন্তু তাদের শরীরেরর ঘর্মাক্ত লোনাজল চেটে খেতে আমাদের ঘৃণা লাগে না। এর কারণ, আমরা পুরুষ। আমরা বেশ্যা বানাই। বেশ্যা হতে পারি না। পুরুষ মানুষ মাত্রয় বহুগামী হবে তার কোনও কারণ নেই। পুরুষ মানেই একজন বাবার প্রতিচ্ছবি, একজন আদর্শবান পুরুষ কখনও বহুগামী হতে পারে না।। বহুগামিতা একটি রোগ, বহুগামিতা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। বহুগামিতা মানেই একজন পুরুষ বেশ্যা।
বহু পুরুষ একজন নারীর কাছে যাচ্ছে যেহেতু সে, নারী বেশ্যা। বহু নারী একজন পুরুষের কাছে যাচ্ছে যেহেতু সে, পুরুষ বেশ্যা। বেশ্যা শব্দটি কেন মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কেন? পৃথিবীটা চলছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়। এখানে নারীদের তুলনায় পুরুষদের অধিকার বেশি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। সবাই বলে, বেশ্যারা ইচ্ছাকৃতভাবেই বেশ্যা হয়। কোনও বাবা-মার মেয়েসন্তান বড় হয়েই তার বাবা-মাকে কি বলে, আমি বেশ্যা হবো? কখনও এমন ঘটার সম্ভাবনা নেই। কোনও বাবা-মা-ই চায় না তাদের মেয়েসন্তানটি বেশ্যা হোক। কিন্তু কারা বানাচ্ছে বেশ্যা? কেউ কেউ বলে, এদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু কেন? তোমার মনের ভিতর লুকিয়ে রাখা পশুত্বকে তুমি মন থেকে উচ্ছেদ করতে পারছো না কেন? তুমি পুরুষ বলে? তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে কেন? আমরা কেন সকল পুরুষ একসাথে বলছি না, আমরা মরে যাব কিন্তু বেশ্যার কাছে যাব না। আমরা যদি বেশ্যার কাছে না যাই তাহলে তারা অর্থ-উপার্জন করবে কিভাবে?
অর্থ না পেলে তারা খাবে কি? তারা খাবার না পেলে এমনিতেই মরে যাবার কথা। তারা যদি না খেয়ে মরে যায় তাহলে তাদেরকে উচ্ছেদ করারই প্রয়োজন পড়ছে না। তাহলে কেন উচ্ছেদ করার কথা ভাবছেন? কারণ আপনি-আমি পুরুষ। আমরা বহুগামী। আমরা বেশ্যা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। আমরা ঘরের বউ ছাড়তে পারি কিন্তু বেশ্যা ছাড়তে পারব না। সমস্যা পুরুষের কিন্তু দোষ হচ্ছে নারীর। পৃথিবীর সকল পুরুষ বেশ্যাদের দিকে না তাকালে তারা কাদের জন্য সাজবে? কোনও পুরুষ রাতের অন্ধকারের তাদের কাছে না গেলে তারা কাদের জন্য মেইনগেটে দাঁড়াবে? কোনও পুরুষ তাদের কাছে না গেলে কে তাদের গর্ভে অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়েশিশুর জন্ম দেবে? কোনও পুরুষ যদি খদ্দের হয়ে তাদের কাছে না যায় তাহলে কে যাবে? কোনও পুরুষ তাদের কাছে না গেলে তারা কি নারীতে নারী সেক্স করবে? করলে করুক। আমাদের সমস্যা কোথায়? সমস্যা ঘুরেফিরে একটাই, আমরা পুরুষ। আমাদের রক্তের মধ্যে বহুগামিতার রক্তস্রোত বইছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুরুষ বেশ্যা রয়েছে, আমাদের দেশে থাকবে না কেন? থাকবে কিন্তু গোপনে। কারণ বেশ্যা নারীর ভূষণ, লজ্জা পুরুষের ভূষণ। আমরা বেশ্যা নিয়ে কাজ করি কেন? ভালো কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারি বলে? পারি না। পৃথিবীতে বেশ্যার চেয়ে ভালো কোনও বিষয় আছে? বেশ্যা শব্দটা আমাদের শুনতে ভালো লাগে বলেই তো আমরা যুগের পর যুগ ধরে বেশ্যা শব্দটি শুনে আসছি। বেশ্যা আমাদের জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। একেবারেই কনডমের মতো। জীবনের আমৃত্যু পর্যন্ত কনডম আছে, সাথে আছে বেশ্যা। আমরা বিখ্যাত। কারণ আমাদের বেশ্যাদের উপর লেখা উপন্যাস আছে। আমরা বেশ্যাদের জীবনকাহিনি পড়ে যতটা মজা পাই, অন্য কারও জীবনকাহিনি পড়ে ততটা পাই না। আমরা দেবদাস পড়ি। আমরা দেবদাস দেখি। হামলে পড়ি ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে। বেশ্যা শব্দটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতো প্রাথমিক রোগের মহাঔষধ। আমরা কোনও নারীকে ধর্ষণ করেছি, সমস্যা নেই। ঠাণ্ডা মাথায় নারীটির শরীরে বেশ্যার প্রলেপ লাগিয়ে দেব। দেখা যাবে, প্রথম ধাপেই আপনি ধর্ষণ মামলা থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়ে গেছেন। সুতরাং আমরা কখনও মনের দিক থেকে চাইব না, বেশ্যাপল্লী উঠে যাক।
রাজা-বাদশাহের হেরেমখানা থেকে শুরু করে আজকের নিষিদ্ধপল্লী, সবই নারী দেহের উদ্দাম লীলাখেলার চলনচিত্র। আমরা কোনও একজন যৌনকর্মীকে চেষ্টা করলে সভ্যজগতের মানুষ হিসেবে ফিরিয়ে আনতে পারি। অপরদিকে একজন যৌনকর্মী চেষ্টা করলেই সভ্যজগতের কোনও একজন নারীকে যৌনকর্মী বানাতে পারে। আমরা চেষ্টা করলে যৌনকর্মী কমবে, তারা চেষ্টা করলে যৌনকর্মী বাড়বে। আমাদের সকলের যৌথ চেষ্টা আজকে কিছু সংখ্যক যৌনকর্মীকে ভালো পথের সন্ধান দিলে দিনের পর দিন বছরের পর বছর যুগের পর যুগ কালের পর কাল পরে যৌন পেশার বিলুপ্তি ঘটবে, তা আমরা ভাবতেই পারি। আমাদের সুন্দর ভাবনাই পারে, আমাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে।