
ভুল বিশ্বাস প্রচারকারী মতবাদগুলো
পর্ব ২
মুযাফ্ফর বিন মুহসিনপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০১৮
ইসলামের নামে যুগ যুগ ধরে নানা মতবাদ ও আচার সমাজে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। বস্তুত যা কোরআন ও হাদিস বিরোধী। এসব বিষয়ে কোরআন ও হাদিস থেকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুযাফ্ফর বিন মুহসিন। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।
ব্রেলভি তরিকা
১৮৮০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলিতে ব্রেলভি মতবাদের জন্ম হয়। হানাফি মাজহাবের অনুসারী এবং সুফিবাদে বিশ্বাসী আহমাদ রেজা খান (১৮৫৬-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ) এ মতবাদের জনক। ব্রিটিশ আমলে আশেকে রাসুল নামে এ মতবাদটি পরিচিত ছিল। তারা হানাফি মাজহাবের অনুসারী হলেও তাদের বিশ্বাসের মূলে রয়েছে শিয়াদের ভুল বিশ্বাস।
তিনটি মৌলিক দর্শন থেকে এ মতবাদের জন্ম হয়। ক. প্রাচ্য দর্শন ভিত্তিক মাজহাব, যা দক্ষিণ এশীয় হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এসেছে। খ. খ্রিস্টানদের কাছ থেকে আসা দর্শন হুলুদ, এর অর্থ মানুষের দেহে আল্লাহর অনুপ্রবেশ। হিন্দু মতে, নবরূপে নারায়ণ। গ. হিন্দুদের থেকে আগত ইত্তেহাদ বা ওয়াহদাতুল ওজুদ, এর অর্থ অদ্বৈতবাদী দর্শন, যা হুলুলের পরবর্তী স্তর। অর্থাৎ আল্লাহর সত্তার মধ্যে বান্দার সত্তা বিলীন হয়ে যাওয়া। ফলে তারা বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল সবকিছুই আল্লাহর অংশ। আল্লাহ পৃথক কোনও সত্তার নাম নয়। নিচে এদের বিশ্বাসগুলো উল্লেখ করা হলো:
১.আহমাদ রেজা খান (১৮৫৬-১৯২১ খ্রিস্টাব্দ) বলেন, রাসুল (সা.) গায়েবের খবর রাখেন। লাওহে মাহফুজের যাবতীয় কিছু আল্লাহ তাকে দান করেন।
২. সৃষ্টির যাবতীয় কর্ম নবি মুহাম্মদ (সা.) উপস্থিত থেকে দেখছেন। তিনি নূরের তৈরি এবং সর্বত্র হাজির ও দ্রষ্টা। তিনি তার অবস্থানস্থল থেকেই দুনিয়ার সবকিছু দেখেন নিজ হাতের তালুর মতো। কাছের ও দূরের সব আওয়াজ তিনি শোনেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি পৃথিবী চক্কর দিতে পারেন ও বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করতে পারেন। তিনি আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দেন।
৩. আল্লাহর অলিরা রবের মর্যাদাতুল্য। সুতরাং তাদের থেকেও রহমত পাওয়া যায়। অর্থাৎ অলিদের কাছেও দোয়া করা যায়।
৪. নবি মুহম্মদ (সা.) এমনই ক্ষমতা অধিকারী যে, তিনি সারা দুনিয়া পরিচালনা করে থাকেন। তাদের একজন বড় নেতা আমজাদ আলী ব্রেলভি বলেন, রাসুল (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর সরাসরি প্রতিনিধি। সমস্ত বিশ্বজগৎ তার পরিচালনার অধীন। তিনি যা খুশি করতে পারেন এবং যাকে খুশি দান করতে পারেন। যাকে খুশি নিঃস্বও করতে পারেন। তার রাজত্বে হস্তক্ষেপ করা দুনিয়ার কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে অধিপতি হিশেবে যে মনে করে না, সে সুন্নত অনুসরণের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ভক্তির আতিশয্যে আহমাদ রেজা আরও লেখেন, হে মুহাম্মদ (সা.), আমি আপনাকে আল্লাহ বলতে পারছি না। কিন্তু আল্লাহ ও আপনার মাঝে কোনও পার্থক্যও করতে পারছি না।
৫. তাদের মতে, রাসুলের (সা.) সাথে অলি-আওলিয়ারাও দুনিয়া পরিচালনার কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আহমাদ রেজা বলেন, হে গাওছ (আব্দুল কাদের জিলানি), কুন মানে হয়ে যাও বলার ক্ষমতা মুহাম্মদ (সা.) লাভ করেছেন আল্লাহর কাছ থেকে, আর আপনি লাভ করেছেন তার কাছ থেকে। আপনার কাছ থেকে যা-ই প্রকাশিত হয়েছে, তা-ই দুনিয়া পরিচালনায় আপনার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। পর্দার আড়াল থেকে আপনিই আসল কারিগর।
৬. আল্লাহ একা, তাই একাই তার পক্ষে পুরো বিশ্বজগৎ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফলে তিনি তাঁর বিশ্ব পরিচালনার সুবিধার জন্যে আরশে মু’আল্লায় একটি পার্লামেন্ট কায়েম করেছেন। সে পার্লামেন্টের সদস্য মোট ৪৪১ জন। আল্লাহ তাদেরকে স্ব স্ব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর মদ্যে নাজিব ৩১৯ জন, নাক্বিব ৭০ জন, আবদাল ৪০ জন, আওতাদ ৭ জন, কুতুব ৫ জন এবং একজন হলেন গাওসুল আজম, যিনি মক্কায় থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবদাল ৪০ জন। তারা আল্লাহর মধ্যস্থতায় পৃথিবীবাসীর বিপাদাপদ দূর করে থাকেন। তারা আউলিয়াদের দ্বারা সৃষ্টজীবের হায়াত, রুজি, বৃষ্টি, বৃক্ষ জন্মানো ও মসিবত দূর করেন।
৭. আহমাদ রেজা বলেন, যার কাফনে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু... পূর্ণ কলেমা লেখা হবে, তার কবর যাবতীয় বিপদ থেকে মুক্ত থাকবে। তার কবরে মুনকার-নাকির আসবে না।
৮.তাদের কাছে সবচে বড় ঈদ হলো, ঈদে মিলাদুন্নবি। এদিন তারা মহা ধুমধামে জশনে জুলুসের আয়োজন করে এবং বিভিন্ন ভক্তিপূর্ণ গান পরিবেশন করে এবং আনন্দফুর্তি করে। আর নবি মুহম্মদের নামে মিথ্যে কাহিনি বর্ণনার জন্যে তারা তথাকথিত সিরাত মাহফিল আয়োজন করে।
পর্যালোচনা: মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কারণ তাদের বিশ্বাস যে একেবারেই জঘন্য, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) ও ভণ্ড পির-ফকিরদের একাকার করে ফেলেছে। তারা মুসলিম নামের কলঙ্ক। তাদের এসব কুফরি ফাঁদ থেকে সাবধানে থাকতে হবে। ইসলামের লেবাস পরে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে যেসব মতবাদ মানুষের ঈমান হরণ করছে, সেগুলোর মধ্যে ব্রেলভি তরিকা মূখ্য।
দেওবন্দি তরিকা
ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার একটি এলাকার নাম দেওবন্দ। এখানে মাওলানা কাসেম নানোতবি (মৃত ১৮৭৯) ১৮৬৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার আধ্যাত্মিক গুরু ভারতের ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির (মৃত ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ) কাছে মুরিদ হন। একইভাবে মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (১২৮০-১৩৬২ হিজরী) এবং মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহিও (মৃত ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ) মুরিদ হন। ওই মাদরাসা ও সেখানকার আলেমদের মাধ্যমে দেওবন্দি মতবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উপমহাদেশের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠি ওই তরিকার অনুসারী। বাংলাদেশে হাটহাজারি, পটিয়া, বগুড়ার জামিল মাদরাসা, নওগাঁর পোরশা মাদরাসা এবং পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ তরিকার প্রচারক। পাকিস্তানের তাকি উসমানি দেওবন্দি তরিকার সবচে পরিচিত ব্যক্তি। তবে সকলেই সুফি মতবাদে বিশ্বাসী। তাদের কাছে বায়েজিদ বোস্তামি ও মনসুর হাল্লাজ খুবই প্রিয় ব্যক্তিত্ব।
বলা দরকার যে, দেওবন্দি তরিকার দাওয়াতি শাখা হলো তাবলিগ জামায়াত। আমজনতার মাঝে সুফি ইমদাদুল্লাহর দর্শন প্রচারের ছদ্মবেশী তরিকা হলো এ তাবলিগ। এ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হলেন রশিহ আহমাদ গাঙ্গুহি দর্শনের পৃষ্ঠপোষক মাওলানা ইলিয়াস (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি বলতেন, মাওলানা আশরাফ আলী থানভি দ্বীনের প্রভূত খেদমত করেছেন। আমার আন্তরিক ইচ্ছে হলো, দ্বীনের শিক্ষা হবে তার এবং দাওয়াহর প্রায়োগিক প্রক্রিয়া হবে আমার, যাতে তার শিক্ষা প্রসিদ্ধি লাভ করে।
পর্যালোচনা: তাদের বক্তব্যেই সব বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই দেওবন্দিদের ব্যাপারে সাবধান থাকা এবং মানুষকে সতর্ক করা জরুরি। কারণ ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে উক্ত সুফিবাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
চলবে...
লেখকের ‘ভ্রান্ত আক্বীদা বনাম সঠিক আক্বীদা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো