
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ২
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : মে ০৪, ২০১৮
ছোটবেলায় মা আমাকে বলতো, আমার কাছে একটা ডায়েরি আছে। সেখানে আমি সব কথা লিখে যাবো। আমি মরে যাওয়ার পর তুই পড়বি। শিশুমন একথা শুনে একইসঙ্গে ভীত ও অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়তো। মায়ের ডায়েরি বলে কথা, সেখানে না জানি কত না-বলা কথা লেখা আছে! কিন্তু মরে যাওয়ার পর কেন একথা ভেবে মন চঞ্চল হয়ে উঠতো? মায়ের মরে যাওয়ার পরটা ঠিক কেমন, একথা ভাবলে কেবল একটা অন্ধকার ঘর দেখতে পেতাম, যেখানে কোনও দরজা-জানলা নেই। সেখানে বসে কি ডায়েরি পড়া যায়?
একটু বড় হওয়ার পর আর সেই ডায়েরি পড়ার প্রয়োজন অনুভব করিনি আমি। আমার মায়ের হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুগত ডায়েরি আর কেই বা হতে পারতো আমি ছাড়া? অনেক লিখে অনেক শব্দে সে যা বলতে চায় আমি তা আড়চোখে দেখেই বুঝে যেতাম। কিন্তু আমি যা বুঝতাম তা বলিনি কাউকে, সে কেবল মনের ভেতর থিতিয়ে পলি পড়ে অদৃশ্য চড়ার মতো হয়েছিল, যেখানে নৌকো এসে ভিড়তো কোনও অলৌকিক নদীপথ পার করে। রাত্রিবেলা দাঁড় টানার শব্দ হতো। মনের ছইয়ে সারারাত হ্যারিকেন জ্বেলে রেখে আমি যেন কোনও অশরীরী নারীর কল্পনা করতাম, যে শুধু ডায়েরি লেখে। হাতে তার পালকের কলম আর একঢাল চুল ছড়িয়ে আছে বিছানার আদিগন্ত আকাশে।
শিশু সবচেয়ে আনন্দে থাকে যদি তার মা আনন্দে থাকে। যে গাছ সুস্থ সবল যে গাছের কোনও বিষাদ নেই। যার প্রশস্ত ডালপালা হাওয়া দিলে সাড়া দেয়, বৃষ্টিতে ভেজে অকাতরে, কত না জানি পাখিকে সে আশ্রয় দেয়। সকল ঝড়-ঝাপটায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ফুলদের আনন্দ আর ঔদ্ধত্যের সীমা থাকে না। তারা নিজের খুশিমতো ফোটে, নিজ ইচ্ছায় ঝরে মরে। কিন্তু আমি ফুল যে গাছের সে গাছটি তেমন ছিল না। সে যতই হাওয়ায় দুলুক, বৃষ্টিতে ভিজুক, আমি জানতাম সে উপড়ে যেতে পারে যেকোনও অলীক মুহূর্তে। সেই গাছ মায়ের মনের গভীরে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া তারে বেজে ওঠা বিধুর সুরের মূর্চ্ছনা আমার মনের ভেতরেই বাজতো সবচেয়ে গভীর হয়ে। ছোট ছিলাম। বলার ভাষা ছিল না। প্রকাশ করার শক্তি ছিল না। কিন্তু অনুভব তো ছিল। ক্লান্ত শ্রান্ত মা যে পথে চলে যেত, তার ফেলে যাওয়া পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পেতাম সেই গান: তুম ইতনা যো মুসকুরা রাহে হো/কেয়া গম হ্যায় জিসকো ছুপা রাহে হো/আঁখোমে নমি হাসি লবো পর/কেয়া হাল হ্যায় কেয়া দিখা রাহেহো...
কলকাতার হাসপাতালে আমার জন্ম হওয়ার পর বাবা এসেছিলেন হরলিক্সের শিশি নিয়ে। কলকাতা থেকে মা সোজা আমাকে নিয়ে এলেন কোন্নগরে দাদুর বাড়িতেই। সিজার করে বাচ্চা হওয়ার ধকল অনেক, পোস্ট অপারেটিভ রেস্ট এবং কেয়ার দুটোই দরকার হয়। কিন্তু মায়ের তেমন অবকাশ ছিল না। তাকে দ্রুত ফিরতে হয় ব্যস্ততম জীবনে। দুর্বল শরীর নিয়েই আবার শুরু হয় গানের স্কুল। আর আমি রয়ে যাই দিদিমার হেফাজতে। যদিও সেসময় মা একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল কোন্নগরে। একজন মেয়ে বিয়ে হতে না হতেই বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি এসে থাকছে, আজ থেকে ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে, কে-কী-কেন ইত্যাদি সামাজিক কৌতূহল ও নানা অনুষঙ্গ তো ছিল নিশ্চয়ই। ভাড়া বাসায় বাবার যাতায়াত থাকতো। কিন্তু কোনোদিনই তিনি মায়ের সাথে সেভাবে মিলতে পারেননি। এই যে থেকে যাওয়া কিন্তু মিলতে না পারা, একই ছাদের নিচে বসবাস কিন্তু ভালোবাসতে না পারা এবং তার ফলস্বরূপ যে চূড়ান্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব তা একজন মানুষের জীবনকে কিভাবে ভারাক্রান্ত ও জটিল করে তুলতে পারে, তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?
এমন পরিস্থিতিতে উচিত সে সম্পর্ক থেকে নিজেকে সার্বিক অর্থে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া। একটা অসার সিস্টেমের মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে না রেখে কোনও নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মুখে বলা যতটা সহজ কাজে করে দেখানো ততটা সহজ ছিল না সেসময়। কাজেই অর্থহীন লৌকিকতার একটা প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিল। তাছাড়া একটা প্রশ্ন ছিল, যেটাকে সে সময় খুব বড় প্রশ্ন ভাবা হতো, ‘মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে। তখন শ্বশুরবাড়ির লোককে কি বলবো? যদি মেয়েকে না নেয়?’ অর্থাৎ মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেলে মেয়েরও বিয়ে হবে না এমনই অন্ধবিশ্বাস কাজ করতো। কিন্তু হতবাক হয়েছিলাম, যখন আজ প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি পড়ে, আমারই এক বিবাহ বিচ্ছিন্না বান্ধবী ডিভোর্স প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সেই একই কারণ দর্শেছিল, `মেয়ের বিয়ে!`
সমাজ বদল বলে কিছু হয় না। সমাজ কোনও ইনডিপেন্ডেন্ট ক্রিয়েচার নয়, তা বেশ কিছু মানুষের আচার আচরণ ও বিশ্বাসের আয়না মাত্র। যদি একে একে সেই মানুষগুলো বদলায় তাদের বিশ্বাস বদলায় তবেই ধীরে ধীরে তাদের যুগ্ম প্রতিফলনও একদিন বদলে যায়, অর্থাৎ যে প্রতিচ্ছবিকে আমরা সমাজ বলি মানুষের ভাবনাতেই তার বদল সম্ভব। তাই কবে সমাজ বদলাবে তারপর আমি বদলাবো তা নয়, আগে আমাকে বদলাতে হবে যে। সেদিন সেই বন্ধুটিকে খুব জোরের সাথেই বলেছিলাম, তেমন মানুষকে তোর মেয়ে বিয়ে করবে কেন যে তোর ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট চাইবে?
যাই হোক, মাকে শক্তি দেয়ার মতো তেমন কেউ ছিল না সেসময়। দাদু রিটায়ার্ড, মাসি নিজের সাংসারিক আবর্তে রণক্লান্ত, আর মামা যে কীনা বিরাট বড় ইঞ্জিনিয়ার বছরে দুবার দিদিমাকে দুটো বিছানার চাদর কিনে দিয়ে দায়িত্ব সারতো। ফলত, মা হলেন গানের দিদিভাই। বাবার উদ্ধত যাতায়াত লেগে থাকলো আর আমি চলে এলাম দিদিমার কোলে। সে সঙ্গ এতই ওতপ্রোত ছিল যে, প্রায় দু বছর বয়স অবধি আমার প্রতীতি ছিল যে, আমার দিদিমাই আমার জন্মদাত্রী মা। আর মাকে ডাকতাম এক অদ্ভুত নামে `কৃষ্ণা মা` অর্থাৎ মা, কিন্তু যেন পুরোপুরি মা নয়।
সারাদিনটা কাটতো দিদিমার সাথে। মা ব্যস্ত থাকতো গানের ক্লাসে। সকাল-সন্ধ্যা নাওয়া-খাওয়ার সময়ের কোনও হিসেব থাকতো না তার। এখনো মনে আছে, তখন সিঁড়ি ধরে ধরে সবে উঠতে শিখেছি, গুটি গুটি পায়ে মাঝে মাঝেই দাদুর বাড়ির দোতলায় গানের ঘরে গিয়ে উঁকি মারতাম তানপুরা কোলে মগ্ন মীরাবাঈয়ের মূর্তি দেখাবো বলে। এসবের মাঝখানে একজন, কোনও অলৌকিক ভোরে প্রায় ঈশ্বরের মতোই আমার মাথায় হাত রেখেছিল। বাবুই। শুধু যাকে নিয়েই একটা গোটা বই লেখা যায়।
চলবে