মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫৪

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০২১

তখন তো বর্ষা মানেই এক অবরুদ্ধকাল। বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। কবে থামবে কেউ জানে না। মনে হতো আমরা কখনো শীত দেখিনি, গ্রীষ্ম দেখিনি, বসন্ত দেখিনি; আজন্ম কেবল বর্ষাই দেখছি। দেখতে থাকব অনন্ত কাল। আর কখনো সূর্য  উঠবে না, আর কখনো রোদ দেখব না। বৃষ্টির জলে তলিয়ে যাবে এই ধরিত্রী। ইস্রাফিল বাজাবে মহাপ্রলয়ের শিঙা।

বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তো প্রান্তর ডুবে যেত জলের নিচে। কাচের মতো স্বচ্ছ জল। এক হাত জলের নিচে দেখা যেত ঘাস, পোকামাকড়, ব্যাঙাচি আর শামুকদের। কোথা থেকে যে আসত তারা! হয়ত মাটিতেই লুকিয়ে থাকত তাদের ডিম্বাণু। বছরের প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা জন্ম নিত। কে তাদের জন্ম দিত? তাদের বাবা-মা তো আছে নিশ্চয়ই। বাবা-মায়েরা কি সন্তানদের চিনত? কিংবা সন্তানেরা কি চিনত বাবা-মায়েদের?

প্রথম বৃষ্টিতে যেসব জলজপ্রাণ জন্ম নিত, হয়ত তারা চিনত না। তাদের জন্ম সম্পর্কে তারা থাকত উদাসীন। নিজেদের জন্ম নিয়ে হয়ত তারা কখনো প্রশ্ন তুলত না। কিন্তু তারা যখন বড় হতো, যখন যৌবনপ্রাপ্ত হতো, তখন তারা নির্বাচন করে নিত সঙ্গী বা সঙ্গিনী। মেতে উঠত প্রেমে, সঙ্গমে।

আহা ব্যাঙেদের সঙ্গম! বর্ষার রাতে, কিংবা দিনের বেলায় আকাশ একটু মেঘলা হলেই ব্যাঙের দল ডাকতে শুরু করে গ্যাঙর গ্যাঙ। কেন ডাকে? তারা কি সঙ্গিনীকে আহ্বান করে? কিংবা সঙ্গিনী তার সঙ্গীকে কাছে ডাকে? হয়ত। পরস্পরের ডাকে তারা সাড়া দেয়। মেতে ওঠে প্রেমে, সঙ্গমে, সৃজনমুখরতায়। স্ত্রী ব্যাঙটির পিঠের ওপর চড়ে বসে পুরুষ ব্যাঙটি। পুরুষ শামুকটি চড়ে বসেছে স্ত্রী শামুকটির পিঠে। সে কী নয়নাভিরাম দৃশ্য!

কিন্তু তখন তো আমাদের নয়ন এসব দেখতে দেখতে ছিল ত্যাক্ত-বিরক্ত। তখন তো সেই দৃশ্যে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পেতাম না। কেননা সৌন্দর্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের ভেতরে তখনো তৈরি হয়নি। তখন তো আমরা প্রেম কিংবা সঙ্গম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। ভাবতাম, তারা বুঝি খেলছে, আমরা যেমন খেলি।

রেলসড়ক থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে আমরা ছুঁড়ে মারতাম সঙ্গম-নিরত ব্যাঙেদের দিকে। তারা ছর-ছর করে ছুট দিত। ছুটতে ছুটতে  চলে যেত বহুদূর। আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে। আবার মেতে উঠত সঙ্গমে। এখন, এত বছর পর মনে হয় সেই পাথর ছোঁড়াটা ছিল আমাদের পাপ। পৃথিবীতে পাপ-পুণ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে বড় পাপগুলোর একটি হচ্ছে প্রেম বা সঙ্গম-নিরত যুগলকে বিরক্ত করা। আমরা সেই পাপটি করতাম।

অবশ্য ঠিক পাপ বলা যাবে না। কারণ তখন তো পাপ-পুণ্যের জ্ঞান ছিল না আমাদের। তারাও অবুঝ, আমরাও। জ্ঞানগত দিকে থেকে আমরা ও তাদের মধ্যে তো বিশেষ কোনো ফারাক ছিল না। কোনো ব্যাঙ যখন মরে রাস্তায় চিৎ হয়ে কিংবা থেঁতলানো দশায় পড়ে থাকত, দেখে আমাদের মনে হতো, পৃথিবীতে এর চেয়ে কুৎসিৎ দৃশ্য আর কিছু নেই, আর কিছু হতে পারে না। ঘৃণায় আমাদের নাক কুঁচকে যেত, থুতু বেরিয়ে আসত। খেতে বসলে মনে পড়ে যেত সেই থেঁতলানো ব্যাঙটির কথা। তখন গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইত না। নাড়িভুঁড়ি বিদ্রোহ শুরু করে দিত। মনে হতো, খোদা কেন যে ব্যাঙ সৃষ্টি করল! কোনো দরকার তো ছিল না। তখন সদা গম্ভীর, সদা মৌন, সদা ধ্যানস্থ হয়ে থাকা পিতার মুখে হাসি ফুটত। তিনি বলতেন, জগতের কোনো কিছুই বিনা কারণে সৃষ্টি হয়নি, বেটা। একটি গল্প শোনো তবে।

এক লোক খোলা পায়খানায় গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে। সে নাক সিঁটকাল। থুতু ফেলে বলল, এসব পোকা কেন সৃষ্টি করা হলো? কী কাজ এদের? একদিন লোকটি অন্ধ হয়ে গেল। কত কবিরাজ, কত ডাক্তার দেখাল, অথচ তার অন্ধত্ব দূর হয় না। সে হাল ছেড়ে দিল, অন্ধত্বকেই মেনে নিল নিয়তি হিসেবে। একদিন এক বড় কবিরাজের সন্ধান পেয়ে তার কাছে গেল। কবিরাজ বলল, এই অন্ধত্ব দূর করার একটা উপায় আছে। কী সেই উপায়? পায়খানার পোকাগুলোকে রোদে শুকিয়ে পাটায় পিষে গুঁড়ো করে যদি সুরমার মতো চোখে লাগানো হয়, তবেই দূর হবে অন্ধত্ব। কবিরাজের কথামতো লোকটি তাই করল। সত্যি সত্যি তার অন্ধত্ব দূর হয়ে গেল।

আমারা সত্যি সত্যি এই গল্প বিশ্বাস করেছি। ভেবেছি, সত্যি সত্যি পায়খানার পোকা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে সুরমার মতো চোখে লাগালে অন্ধত্ব দূর হয়। আমরা ভেবে রাখি, বয়স বাড়লে একদিন যখন আমাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে যাবে, আমরাও তাই করব। আসলে কি পায়খানার পোকায় অন্ধত্ব দূর হয়? বিজ্ঞান তো তা বলে না। তবে কেন সেই গল্প তৈরি হলো? তৈরি হলো এই পৃথিবীতে সর্বপ্রাণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। কোনো প্রাণই যে তুচ্ছ নয়, সেই কথা শিক্ষা দিতে। কী অসাধারণ গল্প! কে যে লিখেছিলেন! হয়ত কেউ লেখেননি, মুখে মুখেই চালু হয়েছে। সর্বপ্রাণাবদী কোনো মহাপুরুষ বলেছিলেন, তার মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সবার মুখে মুখে।

ব্যাঙের কথা থাক। শামুকদের ওপরও কি আমরা কম অত্যাচার করেছি? আমাদের বাড়িতে হাঁস ছিল। হাঁসেদের প্রিয় খাবার শামুক। সেই খাবার জোগাড়ের দায় আমাদের। প্রতিদিন একটা ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম শামুক কুড়াতে। জমিনের আলের ধারে মাটি বা ঘাষ কামড়ে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো বসে থাকত ছোট ছোট শামুকেরা। কেন যে তারা ওভাবে বসে থাকত! বসে থেকে কী যে ভাবত! হয়ত তারা এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে থাকত। বিশালের সম্মুখে তারা নার্ভাস বোধ করত। ভাবত, এই ব্রহ্মাণ্ডে তাদের কী কাজ?

আর বড় শামুকদের কেউ লম্বা জিব বের করে হেঁটে বেড়াত। হেঁটে বেড়াত খাদ্যের অন্বেষণে। হাঁটতে হাঁটতে কেউ আমাদের দেখা মাত্র জিবটি খোলের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলত। আমরা একটি একটি করে শামুক ধরে ঝুড়িতে ভরে নিতাম। ভরতে ভরতে যখন আমাদের ঝুড়িতে একটুও জায়গা থাকত না, তখন ফিরে যেতাম বাড়ি। কুড়িয়ে আনা শামুকগুলোর খোল ভেঙে মাংসটা খেতে দিতাম হাঁসেদের।

ছোট ছোট শামুকগুলোকে যে আমরা ধরে আনতাম, তাদের বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই তাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হতো। গোটা প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে সন্তানদের তারা খুঁজে বেড়াত। বড় শামুকদের খুঁজে বেড়াত তাদের স্ত্রী বা প্রেমিকা বা স্বামী বা সন্তান। খুঁজে না পেয়ে শোকে কাতর হতো। তারা কি আমাদের অভিশাপ দিত? তারা কি জানত মানুষেরাই যে তাদের সন্তানদের ধরে নিয়ে গেছে? হয়ত জানত না। কিংবা জানত। আসলে তাদের বোধ নিয়ে তো আমাদের কোনো ধারণা নেই। কোনো বৈজ্ঞানিক এখনো কি আবিষ্কার করেছে শামুকের জ্ঞান, চেতনা কিংবা হাসি-কান্না দুঃখ-সুখের ধরন? জানি না।

শামুকদের ধরে আনা হয়ত আমাদের কোনো অপরাধ ছিল না। কেননা হাঁস খাবে শামুক, মানুষ খাবে হাঁস―এটাই জগতের নিয়ম। মানুষকে কে খায়? খায় এই মহাপ্রকৃতি। একদিন সব মানুষকেই প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হয়। তখন এই মানবদেহকে পোকামাকাড়েরা খায়, ব্যাঙেরা খায়, কেঁচো আর শামুকেরা খায়। খাওয়ার এই চক্র প্রকৃতিতে চলছে নিরন্তর। চলবে

৬ মে ২০২১