মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৩৭

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২০

একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ। পরীক্ষাটি দেওয়ার দরকার ছিল না তার, সে নিজেই এ পরীক্ষাকে আহ্বান করে এনেছে। সেই পরীক্ষা সম্পর্কে বলার আগে একটি সাইনবোর্ডের কথা বলি। টাঙ্গাইলে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজারে কখনো যাওয়া হয়নি। সেদিন প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক ফিরোজ আহমেদের ফেসবুক ওয়ালে একটি সাইনবোর্ড দেখলাম। মাওলানা ভাসানীর মাজারের পাশে একটি গাছে টাঙানো সেই সাইনবোর্ডে লেখা শায়খ আবুল হাসান খারকানীর একটি বাণী— আমার দরগায় যে কেউ আসবে তাকেই রুটি দাও (আপ্যায়ন করো)। তার ঈমান আকিদা কী, তা জিজ্ঞেসই করবে না। কারণ, আমার প্রভুর কাছে যার জীবনের মূল্য আছে তার তুলনায় আমার রুটির মূল্য অত্যন্ত নগণ্য ও তুচ্ছ।

শায়খ আবুল হাসান খারকানী কে? ইরানের একজন বিশিষ্ট মরমীবাদী সুফি। তিনি ছিলেন খাজা বায়েজিদ বোস্তামির আধ্যাত্মিক শিষ্য। কখনো বোস্তামিকে দেখেননি, তবু বোস্তামি ছিলেন তার গুরু। খারকানীর বাণীটি কেন ভাসানীর মাজারের একটি গাছের সঙ্গে টাঙানো? মাওলানা ভাসানী কি তার অনুসারী ছিলেন? সরাসরি তার অনুসারী না হলেও ভাসানী যে মরমী ধারার মুসলমান ছিলেন, তা লেখার আবশ্যকতা নেই। তিনি ছিলেন ইসলামের ‘সর্বভারতীয় রূপে’র সাধক।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ইসলাম তো ইসলামই, তার আবার ‘সর্বভারতীয় রূপ’ কী? সংক্ষেপে বলি, ইসলামের বহু রূপ আছে। এক রূপ আরবে। সেই রূপ বড় রুক্ষ্ম, বড় কঠোর; যদিও এখন সেই কঠোরতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সৌদি আরব। আরেক রূপ ছিল ইরাক-ইরানে। এই রূপ কিছুটা আর্দ্র, অপেক্ষাকৃত উদার, সহজিয়া। ইরাক-ইরানের সহজিয়া রূপটি ভারতবর্ষে এসেছিল পীর-আওলিয়াদের হাত ধরে। এই রূপটি সমন্ববাদী, উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী। এই রূপের রূপবান ছিলেন ভারতবর্ষের সুলতান ও মুঘলেরা (আওরঙ্গজেব ছাড়া)। সে কারণেই তাদের দরবারের হিন্দুরা ছিল বড় বড় পদের অধিকারী। তারা ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেননি, ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি।

ইসলামের এই `সর্বভারতীয় রূপ` অতীতের মতো বর্তমানেও বাংলাদেশ ও ভারতের মরমীবাদী পীর-আউলিয়াদের মাজার-দরগাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এসব মাজার-দরগা হিন্দু-মুসলমানের ভেদ করে না। যে যাবে সে-ই রুটি পাবে। সব ধর্মের জন্য এসব মাজার-আখড়া উন্মুক্ত। (ইসলামের এই সহজিয়া রূপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়া যেতে পারে ‘বাংলার ইসলাম: রক্ষণশীল ও সহজিয়া ধারা’/আঠারো দুয়ার খুলে/স্বকৃত নোমান/পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.)

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইসলামের এই `সর্বভারতীয় রূপে`র অনুসারী ছিলেন বলেই বামধারার রাজনীতিকে গ্রহণ করতে তার অসুবিধা হয়নি। মাও সেতুং-এর আদর্শ ধারণ করতে অসুবিধা হয়নি। এ কারণেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘রাজনীতি হইতেছে এমন একটি মহৎ কর্মপ্রয়াস, যাহার লক্ষ্য সমাজ হইতে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটাইয়া জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রশস্ত করা; সমাজের ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা তথা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা।’

ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত চারটি কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ওই বছর একটি বিশেষ কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সভাপতি পদে ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। মাওলানা তর্কবাগীশের ধর্মীয় ভাবাদর্শও ছিল সে একই, মাওলানা ভাসানীর মতো উদার, সমন্বয়বাদী, সহজিয়া, অসাম্প্রদায়িক। তার বাবাও ছিলেন সুফি, তিনি নিজেও ছিলেন সুফি তরিকার অনুসারী।

আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের এই দুজন সভাপতির ধর্মীয় ভাবাদর্শের প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরও। তিনিও ছিলেন আধ্যাত্মবাদী সুফি ঘরানার মুসলমান। পূর্বজ দুই সভাপতির মতো তার কাছেও ধর্মের নামে কোনো রকমের কট্টরপন্থার স্থান ছিল না। আওয়ামী লীগের শুরুর দিকের এই তিন প্রধান নেতার ধর্মীয় ভাবাদর্শের প্রভাব পড়েছিল গোটা আওয়ামী লীগ সংগঠনটির ওপর। উদার, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মুসলমানরাই এই দলের পতাকাতলে দলে দলে শামিল হয়েছিল। প্রত্যাখ্যান করেছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামের কট্টরপন্থাকে। জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। তাদের কাছে মরমী ইসলাম গুরুত্বহীন, রাজনৈতিক ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ। ফলত তারা ঘোর সাম্প্রদায়িক, কট্টরপন্থী। এ দুটি দলই বিরোধিতা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের।

দীর্ঘ সত্তর বছরের পথপরিক্রমায় আওয়ামী লীগ তার ধর্মীয় ভাবাদর্শ থেকে খানিকটা সরে গেছে। ইসলামের উদার ও অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দূরে ঠেলে দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছে কট্টরপন্থীদের। জামায়াতকে কোণঠাসা করলেও কাছে টেনে নিয়েছে হেফাজতকে। এই হেফাজত যে সেই নেজামে ইসলামেরই উত্তরসুরী, আওয়ামী লীগ তা বেমালুম ভুলে গেছে। আওয়ামী লীগ তার পথের সব কাঁটাকে একে একে উপড়াতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, জামায়াতকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে, বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। বাকি রইল হেফাজত। আওয়ামী লীগ ভেবেছিল রেলের জমি দিয়ে, কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়ে হেফাজতকে তুষ্ট রাখা যাবে। কিন্তু গেল কি? গেল না। হেফাজত গং এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। মামুনুল, বাবুনগরী, ফয়ুজল গং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। ধর্মকে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য আওয়ামীল লীগের পতন।

গত প্রায় সাত বছর ধরে হেফাজতের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ। সেই হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের পতনের জন্য সক্রিয়। এখন হেফাজতের ওপর যদি জামায়াত-বিএনপি ভর করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়, তাতে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। হেফাজতের ওপর যদি বিদেশি শক্তি ভর করে (হয়ত করেছেও), তাতেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।

এখন আওয়ামী লীগ কী করবে? কীভাবে মোকাবেলা করবে এই অপশক্তিকে, এই সংকটকে? হেফাজতের সঙ্গে কি আপস করবে? তা হবে ভয়ংকর আত্মঘাতী। আপস অনেক হয়েছে, আর নয়। হেফাজতকে যদি আর সামান্যতম প্রশ্রয়ও দেয় আওয়ামী লীগ, এর চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হবে না। এদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ফিরে যেতে হবে তার ঐতিহ্যে। অতীত থেকে শক্তি আহরণ করতে হবে। ফিরে যেতে হবে মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় ভাবাদর্শে। পুনর্জাগরণ ঘটাতে সর্বভারতীয় সেই উদার-অসাম্প্রদায়িক ইসলামের। এই উগ্রপন্থীদের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ করতে হবে আধ্যাত্মীবাদী মুসলমানদের। জাগিয়ে দিতে হবে মাজার ও আখড়া কেন্দ্রিক উদারবাদকে। ধারণ করতে হবে লালন সাঁইর মানবতাবাদী বীজমন্ত্রকে। নইলে আওয়ামী লীগের পক্ষে এই সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে না।

এই অপশক্তির নির্মূল করতে না পারলে শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে গোটা বাংলাদেশের। আফগানের তালেবান, মধ্যপ্রাচ্যের আইএস বা মুসলিম ব্রাদার হুডের ভাবাদর্শের সঙ্গে বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের ভাবাদর্শের কোনো ফারাক নেই। বিন্দুমাত্রও নয়। যেসব দেশে তালেবান, আইএস, ব্রাদ্রার হুড শক্তিশালী, সেই দেশগুলোর কী দশা, তা তো দেখাই যাচ্ছে। বাংলাদেশেও যদি হেফাজতকে আর বাড়তে দেয়া হয়, তবে একই দুর্দশার কবলে পড়ে যাবে এই দেশ। থমকে যাবে সমস্ত উন্নয়ন। আওয়ামী লীগ এ যাবৎ যত ভালো কাজ করেছে, যত উন্নয়ন করেছে, সবই ম্লান করে দেবে হেফাজত।

শুধু তাই নয়, এই অপশক্তির মোকাবেলায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে নেপথ্যে থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। ছাত্র লীগকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তৎপরতা চালাতে হবে। সারা দেশে গড়ে তুলতে হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রজন্ম। নইলে হেফাজতি অপশক্তি মোকাবেলা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এই অপশক্তি মোকাবেলায় এখুনি তৎপরতা শুরু করতে হবে আওয়ামী লীগকে। আর দেরি নয়। এক দিনও নয়। চলবে