মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবন্ধ ‘যার শেষ নেই’

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০২০

পাহাড়-পর্বত, আকাশ-অরণ্য, সমুদ্র, সমভূমিময় বিচিত্র প্রকৃতির কোলে মানুষ জন্ম নেয়; কর্মমুখর জীবনযাপন করে আবার একদিন পরলোকে যাত্রা করে। কিন্তু পাহাড় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে; সমুদ্র উল্লাসে তরঙ্গ ভাঙছে; সূর্য আলো ও তাপ ঢালছে; চাঁদে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে; নক্ষত্র জ্বলছে; অরণ্যে গাছপালা-লতাগুল্ম, শস্যক্ষেত্রে ফসল ফলছে। বিশ্ব সংসারের স্তরে স্তরে প্রকৃতির এই যে বিকশিত রূপ- এর শুরু কবে; কবে পূর্ণতালাভ এবং কার জন্যে? বিচিত্র প্রকৃতির রূপরস, আলো-হাওয়ায় বেঁচে থাকে যে মানুষ, তার মনে এ প্রশ্ন জীবনের কোনও না কোনও সময়ে জাগবেই।

যুগ যুগ ধরে বহু মনীষীর চিন্তা-চেতনাকে আলোড়িত করেছে এ প্রশ্ন। বহু দিনরাতের সাধনা ব্যয় হয়েছে এর উত্তর খুঁজে পাবার জন্যে। বলা বাহুল্য, দর্শনের জটিল যুক্তিজালে এর কোনও সদুত্তরই আজও ধরা পড়েনি। বলা হয়ে থাকে, আধুনিক বিজ্ঞান আজ চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে। মানুষের সৃষ্ট বিজ্ঞানে বা ‘বিশেষ জ্ঞানে’র আলোতে বিশ্ব জগতের সকল রহস্যই আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এসব কথার পেছনে যে যুক্তি নেই, বাস্তবতা নেই, তা তো নয়। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, বিজ্ঞানের সাধনা বলে মানুষ আজ অনেক রহস্যেরই দ্বার উদ্ঘাটন করছে। যে চাঁদ একদিন দুর্জ্ঞেয় রহস্য হয়ে বিরাজ করছিল, আজ তা মানুষের হাতের তালুতে অবস্থান করছে। আজ মহাকাশের-মহাবিশ্বের যত গ্রহ-নক্ষত্র মানুষের জ্ঞানের আওতায় ধরা পড়ছে, কিছুকাল আগেও সেসব ছিল যেমন অভাবনীয়, অকল্পনীয়, তেমনি অবিশ্বাস্যও বটে।

এই যে অনন্ত মহাশূন্য- খোলা চোখে তা শূন্য ছাড়া কিছুই নয়। অথচ বিজ্ঞানীরা এ মহাশূন্যকে অকল্পনীয় সৃষ্টি সম্ভারে পরিপূর্ণরূপে দেখতে পাচ্ছেন। সর্বাধুনিক মানমন্দির হতে তারা উচ্চশক্তিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে আজ পঞ্চাশ লাখ আলোকবর্ষ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। বিজ্ঞানে আজকের যুগে মানুষের এ সাফল্য নিঃসন্দেহে এক বিরাট ব্যাপার। অতীতে পণ্ডিত-মনীষীদের কাছে যা ছিল অজ্ঞেয়, আজ তাই একেবারে হাতের কাছের হয়ে উঠছে। তারা যা ভাবতেই পারেননি, তাই আজ ধরা পড়ছে মানুষের দৃষ্টিসীমায়।

এ পর্যন্ত মহাবিশ্বের যতটুকুকে বিজ্ঞান মানুষের দৃষ্টিগোচর করে তুলেছে, এরপরও যে আরও অভাবনীয় সৃষ্টিসম্ভার রয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। বিশ্ব-সংসারের আয়তন-পরিধি মানুষের জ্ঞানসীমার বাইরেই রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এর শেষ কোথায়? বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষের দিনেও এ প্রশ্নের উত্তর একটিই আমাদের জানা আছে, এর শেষ নেই। সামনে, আরও সামনে, যত সামনেই এগিয়ে যাওয়া হোক না কেন, সৃষ্টির পর সৃষ্টিই আমাদের অবলোকন করে যেতে হবে। যথার্থ শূন্য বলতে কিছুই নেই। বাস্তবিক পক্ষে, এ ব্যাপারে শেষ কথা বলতে মানুষের জ্ঞান তথা বিজ্ঞান অক্ষম।

এ তো গেল মহাবিশ্বের আয়তন-পরিধির কথা। এরপর আসে এ বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টির কথা। কবে এর শুরু? পুরাতত্ত্ব বা নৃতত্ত্ব বিদ্যার জ্ঞান যেমন তার সঠিক উৎস স্পর্শ করতে পারছে না, তেমনি বিজ্ঞান পারছে না এ প্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে। সৃষ্টির পর থেকে সূর্য এ পর্যন্ত কোনোদিনই পশ্চিমে উদিত হয়নি, অস্তও যায়নি পূর্বে। তাহলে কি সূর্য নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একই বিশেষ গতিপথে, যা থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়? অনেক সময়ই বিখ্যাত বিজ্ঞানীদেরও পূর্বাভাস দিতে দেখা যায় যে, অমুক সময়ে প্রদক্ষিণকালে অমুক গ্রহের সঙ্গে অমুক গ্রহের সংঘর্ষ ঘটবে। বিশ্ববাসী আতঙ্কে সাথে সেই নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্য করেছে- উল্লিখিত গ্রহদ্বয় যথানিয়মে আপন আপন কক্ষপথেই চলে গেছে। জ্যোতির্মণ্ডলে কোনও সংঘর্ষই ঘটেনি।

শুধু গ্রহ-নক্ষত্র নয়, সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিই সুনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে। অনেকেই বলে থাকে, প্রকৃতি নিজে নিজেই বিকশিত হচ্ছে। আপন শক্তিতেই এ বিশ্বপ্রবাহ প্রবাহমান। এ কথাকে যদি সত্যি বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে মানতে হবে, এ বিশ্ব প্রকৃতি সজ্ঞান। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে কি প্রকৃতির সজ্ঞানতার প্রমাণ মেলে? মেলে না। এছাড়া এ সজ্ঞানতাই প্রকৃতির শুরুকে সম্ভব করেছে কীনা, এ ব্যাপারেও সংশয়মুক্ত রায় দেয়া যায় না। প্রকৃতি যদি নিজে নিজেই আবর্তিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তাহলে এর কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চয়ই কোনও মহাশক্তির নিয়ন্ত্রণে। তা নাহলে একের সঙ্গে অপরের সংঘর্ষে এ বিশ্ব প্রকৃতি কোন কালেই বিধ্বস্ত হয়ে যেত। কিন্তু তা হচ্ছে না। কাজেই একথা মানতেই হয় যে, এই বিশ্ব প্রকৃতিকে চলতে হচ্ছে একই প্রবাহে, একটি বিশেষ মহা পদ্ধতিতে, যার শৃঙ্খলা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সংক্ষেপিত

ইসলামি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত লেখকের ‘সমকালীন জীবনবোধ’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো