মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘কীভাবে ঈদ সংখ্যার লেখক হবেন’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৪, ২০২৪

অনেক লেখকই ঈদ সংখ্যা ও ঈদ সংখ্যার লেখা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। কিছু তথ্য জানলে এই উষ্মা কমতে পারে। যেমন:

১. ঈদ সংখ্যা পত্রিকাগুলোর জন্য মূলত একটা উপরি আয়ের মাধ্যম। ঈদের আগে বিজ্ঞাপন বাবদ বাড়তি কিছু আয় করা ছাড়া ঈদ সংখ্যার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। পত্রিকা ভেদে ঈদ সংখ্যা থেকে ১ কোটি থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত লাভ হয়।

২. বিজ্ঞাপন টার্গেট করেই ঈদ সংখ্যার আয়োজন সাজানো হয়। লেখক তালিকায় যাদের নাম দেখলে বিজ্ঞাপনদাতারা উৎসাহিত হন বা যারা বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের লেখা ঈদ সংখ্যায় প্রাধান্য পায়।

৩. ঈদ সংখ্যা ছাপা হয় খুব কম সংখ্যায়। আজকের যুগে কোনো কোনো ঈদ সংখ্যা বাজারে প্রায় আসে না বললেই চলে। ‌বড় পত্রিকার ঈদ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ হাজার এবং ছোট পত্রিকার ঈদ সংখ্যা সর্বনিম্ন ৫০০ কপি ছাপা হতে পারে। তবে প্রকৃত গড় সংখ্যাটি আমার মতে, আড়াই হাজার।

৪. ঈদ সংখ্যা বিক্রির চিন্তা প্রকাশকদের মাথায় থাকে না। অল্প কিছু কপি বাজারে দেওয়া হয়। বাকিগুলো বিজ্ঞাপনদাতা ও কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। যাদের অধিকাংশই ঈদ সংখ্যার কোনো লেখাই পড়েন না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ঈদ সংখ্যা পান তাদের ৭০% সংখ্যাটি একবারের জন্যও খুলে দেখেন না।

আপনি ঈদ সংখ্যায় লিখতে চাইলে কী করবেন
১. বাংলাদেশে আরসব জায়গার মতো ঈদ সংখ্যা আয়োজনের দায়িত্বে যারা থাকেন তারা শেষ মুহূর্তে কাজ শুরু করেন। এমনিতে তারা রেগুলার কাজের ভারে থাকেন। ঈদ সংখ্যা যে খুব আনন্দ নিয়ে করেন, তাও নয়। কেননা এর কাজের ভলিউম অনেক বেশি। এবং এর জন্য তাদের সন্তোষজনক বাড়তি পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। খুব কম পত্রিকা আলাদা লোক নিয়ে আগে থেকে পরিকল্পনা করে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে।

এ তথ্যটি আপনার মাথায় রাখতে হবে। ঈদ সংখ্যা যিনি আয়োজন করেন তিনি ব্যাপক চাপে ও কাজের ভারে থাকা একজন ব্যক্তি। নাম যারই ছাপা হোক, এই ব্যক্তিটি মূল কাজটি করেন। তিনি দ্রুততম সময়ে কাজটি নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে, যাদের হাতে উপন্যাস গল্প প্রবন্ধ কবিতা রেডি থাকে, তিনি তাদের লেখা নিতেই পছন্দ করেন।‌ সাধারণত এক ফোনের পর লেখা পাঠিয়ে দিলে তার কাজ কমে। এভারেজে ১০০ লেখকের এরকম আয়োজনে একই লেখককে বারবার ফোন দেওয়ার মতো সময় ও সুযোগ তার থাকে না।

ফলে ঈদ সংখ্যায় লিখতে হলে আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি লিখবেন কিনা। রমজান আসার আগে যখন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রকোপ শুরু হবে, তখনই আপনাকে উপন্যাস মোটামুটি একটা শেপে আনতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, ঈদ সংখ্যায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার শব্দের উপন্যাস দিলে ভালো হয়। ১০০০০ শব্দের উপন্যাস ছোট, ২৫ হাজার শব্দের ওপরের উপন্যাস বড় বলে বিবেচিত হয়। ফলে আপনি এভারেজে ১৫-২০ হাজার শব্দের কয়েকটি উপন্যাস লিখে রেখে দিতে পারেন। আর আপনি যে এরকম একটা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, সেটা জানাজানি হয়েই যাবে। একান্ত সন্দেহ হলে, বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার খবর পড়ার পরপর ঈদ সংখ্যার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটিকে ফোন দিন। তাকে বলুন, এবার যেন তিনি আগেভাগে জানিয়ে দেন উপন্যাস লাগবে কিনা। আপনি প্রস্তুত।

২. কমিউনিকেশন খুব বড় জিনিস। আপনি ভালো লেখেন। কিন্তু আপনি যদি যোগাযোগের মধ্যে না থাকেন, তবে সম্পাদকরা আপনার কথা ভুলে যাবে। অন্তত যখন তাড়াহুড়া করে তারা নাম ঠিক করে, কাকে কাকে ফোন দেবে তা ভাবে তখন যেন আপনার কথা তাদের মনে থাকে। এখন অনেক সুবিধা হয়েছে। বড় বড় লেখক সবাই পরপারে চলে গেছেন। এই সময়ে কারা বড় লেখক এ নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ফলে যে কোন পত্রিকা যে কোন লেখককে বড় লেখক হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারে। উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে পারলে আপনি আপনার জায়গা সহজেই পেতে পারেন।

আগে কবি সাহিত্যিকরা সম্পাদকদের মদের বোতল উপহার দিতেন। এখন এসব কিছুই লাগে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পাদকদের দাম কমিয়ে দিয়েছে। আন্তরিকভাবে হাই হ্যালো করলে কাজ হয়ে যায়। কিন্তু এই সমাজতন্ত্রের যুগে আপনি যদি মনে করেন, আপনি একটা মুই কি হনু আর সম্পাদক একটা কিছুই না তাহলে আপনি ভালো করতে পারবেন না।

২. আপনার কাছে তথ্য থাকতে হবে। আপনি যদি এ অঙ্গনে নতুন হন তবে এবারের বিভিন্ন ঈদ সংখ্যা কালেক্ট করুন। এই ঈদ সংখ্যায় যে লেখকরা লিখেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলুন। ঈদ সংখ্যার লেখকদের নিজেদের মধ্যে একটা শক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে। আপনি ঈদ সংখ্যার কয়েকজন লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। তাদের কাছ থেকে জেনে নিন, কোন ঈদ সংখ্যায় কে ভাইটাল ভূমিকা পালন করেন। তার সাথে একটা হাই হ্যালোর সম্পর্ক গড়ে তুলুন। তবে কখনো সরাসরি তার ঈদ সংখ্যায় লেখার প্রস্তাব দেবেন না। বলবেন, এবার আসলে ব্যস্ততায় কোন ঈদ সংখ্যার জন্য লিখতে পারেননি। তবে সামনের বার আগে থেকেই উপন্যাস ও গল্প নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন।

৩. আগের কালে ঈদ সংখ্যার সম্পাদকরা উপন্যাস না পেলে আত্মহত্যার হুমকি পর্যন্ত দিতেন। হুমায়ূন আহমেদের বাসার সামনে নগদ চার লাখ টাকা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন। অন্য লেখকরা বলতেন হুমায়ুনকে যদি চার লাখ দিতে পারো তবে আমাকে এক লাখ দেবে না কেন। বাকি লেখকরা বলতেন অমুক লেখককে যদি এক লাখ দিতে পারো তবে আমাকে ২৫০০০ দিতে পারবে না কেন। এখন সেই যুগ নেই।

এখন উল্টো লেখকরাই ২৫ হাজার ৫০ হাজার ১ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন নিয়ে ঈদ সংখ্যার দপ্তরে হাজির হন। সঙ্গে তার লেখা থাকে। ব্যাপারটা এত খোলামেলা না হলেও আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিলে অর্থটা এরকমই দাঁড়ায়। তবে যারা লেখক তারা যেন এই কাজটি না করেন।

আপনি নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখুন। মানুষের সঙ্গে আন্তরিক কথাবার্তা হাই হ্যালো খোঁজখবর খারাপ কিছু নয়। বরং এটা ভালো ব্যাপার। এটার চর্চা করুন। সামনের বছর প্রত্যেকটা ঈদ সংখ্যা আপনার লেখায় সেজে উঠুক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক