মিতালী দেবনাথের গল্প ‘চৈতালী’

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২৩

চৈত্রের শেষ দুপুর আজ। কেমন যেন ঘুমঘুম একটা ভাব পেয়ে বসে শতরুপাকে। গাড়িতে উঠলেই ঘুম এসে যায় ওর। এটা বহুদিনের অভ্যাস। তার গাড়ি এমুহুর্তে ছুটে চলছে গ্রামের পথ ধরে। এ পথে কতবার যে গেছে ও, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আজ পথটা অনেক অচেনা লাগছে। এই ক’বছরে বেশ পাল্টে গেছে পথঘাট। ঢুলুঢুলু চোখে এদিক সেদিক দেখে সময় পার করে দিচ্ছে শতরূপা সেন।

 

হঠাৎ ওর চোখদুটো আটকে গেল মেঘশূন্য নীল আকাশটায়। ইশ! ঠিক যেন নীলাঞ্জনের চোখের মতো নীল! কল্পনায় সে চোখে চোখ রেখে এক সেকেন্ড পরেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল শতরূপা। যেন সত্যি সত্যিই নীলাঞ্জন তাকিয়ে আছে তার দিকে। টিস্যু দিয়ে চোখের জল আড়াল করতে করতে নিজেকে বেশ বকে দিল শতরূপা, বড্ড ন্যাকামো হচ্ছে এ বয়সে!

 

অফিসের ঝামেলাগুলো মিটিয়ে কেবল কফির মগটা হাতে নিতেই ঘড়িতে চোখ চলে গেল। ১টা বেজে ৪৫! জানালার পাশে দাঁড়াল নীলাঞ্জন, উঁকি দিল নিচের রাস্তাটায়। এ তার বহুকালের অভ্যাস। কতদিন এ পথে ঠিক এ মুহুর্তে শতরূপাকে আসতে দেখেছে ও। এখান থেকে দেখতে শতরূপার সিঁথির লাল সিঁদুর, ওর লাল শাড়িটা কী অদ্ভুত লাগত। লাল রঙে আসলেই ওকে বড় দারুণ দেখাত, কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগা!

 

আর বৈশাখের ঠিক আগের দিনটা ও লাল শাড়ি পরবেই পরবে। এসএমএসের টুং টুং শব্দটা ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। শুধু শুধু কেন যে সময় নষ্ট করে, এই ভেবে ভ্রু কুঁচকে এসএমএসে মন দিল নীলাঞ্জন।

 

দুই.
যাবে না যাবে না করেও দিপার অনুরোধটুকু ফেলতে পারলো না শতরূপা। আসতেই হল আর্ট এক্সিবিশানে, কী ঝামেলা! একে তো ভ্যাপ্সা গরম। তার ওপর পহেলা বৈশাখের সাজ, সেই পুরনো ভিড়। কি এমন হতো একটা দিন পরে এলে! কিন্তু দিপা শুনলে তো? অনেক দিন পরে সে দেশে এলো আর দিপা এত কাছের কলিগ, শতরূপার আসতেই হলো। ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে দিপা বললো, এই শোন, তুই বরং ওই কফির দিকটায় একটু দাঁড়া, আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি।

 

গ্যালারির ডানদিকে কফির জন্য মস্ত কিউ। কাছাকাছি গিয়েই শতরূপার চোখ আটকে গেল ঠিক লাইনের সামনে, সেই চোখজোড়া, এত বছরে একটুও পাল্টায়নি। কফি কাপ হাতে ওর দিকেই আসছে নীলাঞ্জন। কাঁপা কাঁপা হাতে কফির কাপটা নিল শতরূপা। কেমন আছ?

 

মাথা নাড়লো শতরুপা। দ্রুত কফি শেষ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো, এবার আসি।
নীলাঞ্জন আগের মতো কেবল ঘাড়টা একটু বাঁকা করল।

 

তিন.
আজ রাতেই শতরূপার ফ্লাইট। এরপর ওকে আর এই অফিসে দেখা যাবে না। বছরের শুরুর সকালটা সেই লালপেড়ে সাদা শাড়ি, সেই লাল টিপ, লাল সিঁদুর কাল আর দেখবে না নীলাঞ্জন। আজও নিয়ম মেনে শতরূপা পরেছে লাল শাড়ি। চৈত্রের শেষদিন আজ। এইতো পড়ে আসছে একটা বছর। গত কয়েকটা বছর এদিনে কেবল একাজ-সেকাজের বাহানা দিয়ে নীলাঞ্জন শতরূপার আশপাশে ঘুরঘুর করতো। ব্যাপারটা শতরূপা ধরে ফেললে, কখনো হয়তো দুজন সবাইকে অবাক করে হেসে উঠতো, আবার পরমূহুর্তেই দুজনেই চুপ।

 

এটুকুই অসাবধান হয়েছে তারা বছরে দু’একবার। তবে আজ সেরকম দিন নয়, নীলাঞ্জন একটিবারের জন্যও আজ ওদিকটায় যায়নি। শতরূপা বিদায় নিচ্ছে সবার কাছ থেকে, অন্যদিনের চেয়ে গলা চড়িয়ে বলছে, হ্যাঁ দিদি, বরের কাছে যাচ্ছি, নিউ ইয়র্ক, কবে ফিরবো ঠিক নেই, একেবারেই যাচ্ছি গো।

 

একেবারে সবার শেষে নীলাঞ্জনকে বলল, যাচ্ছি।
বরাবররে মতো ও কেবল ঘাড়টা একটু বাঁকাল। শতরূপাও তেমন আর কথা বাড়াল না। দ্রুতই সিঁড়ি বেয়ে নামা শুরু করল। জানে, কেউ তাকে ফেরাতে আসবে না, তাই পেছনে একটি বারের জন্যও দেখলো না।

 

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। নীলাঞ্জন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। শতরূপা অনেকটা অলস পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার যে দিকটায় বাঁক, ওদিকেই যাবে সে। তারপরে একেবারেই মিলিয়ে যাবে, পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার আগে একটা বার ফিরে তাকালো কিনা ঠিক বোঝা গেল না। ঝাপসা চোখে নীলাঞ্জন কেবল লাল একটা অবয়ব মিলিয়ে যেতে দেখলো পথের বাঁকে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকটা হালকা করল নীলাঞ্জন, এপথে আর কোনো দিনও ফিরে আসবে না শতরূপা সেন!