মিম জেনারেশন এবং সিসিফাসের মিথ

তৌকির হোসেন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০১৯

এ আলোচনা `ব্যক্তি` কোনো মিমকে ঘিরে নয়। কেননা একজন ব্যক্তিকে ঘিরেও পুরো একটি জেনারেশন আবর্তিত হতে পারে। বরং এই মিম হচ্ছে স্যাটায়ারের নতুন ফর্ম, যা প্রজ্বলিত, প্রচারিত ও প্রসারিত একবিংশ শতাব্দীতে। ইংরেজিতে বলে (Meme), বিভিন্ন গবেষক অনেকসময় একে উল্লেখ করেছেন সাংষ্কৃতিক একক হিসেবে। লিমর শিফম্যান একে সংজ্ঞায়িত করেছেন ডিজিটাল উপাদানের সমষ্টি হিসেবে যার বিষয়বস্তু একই থাকে। তার মতে, মিম হচ্ছে একধরণের পোস্টমর্ডান ফোকলোর যা জনগণের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে (শিফম্যান ২০১৪)। আমাদের আলোচনা ঠিক এই জায়গাটিতে। এমনিতেই মিম নিয়ে গবেষণার পরিমাণ স্বল্প। কিন্তু যেটুকু হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন, মিম কারা এবং কেন বানায়? মিম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা? মূলত বিভিন্ন আন্দোলন, বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়াতে যে নতুন হিউমোরাস ফর্মে প্রতিটি বিষয়কে আঘাত করে মিম তৈরি করছে, আদানপ্রদান করছে— এর আদৌ কোনো সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে কিনা, তা নির্ণয় করা জরুরি। এ আলোচনায় আমাদের প্রশ্ন ঘুরেফিরে চলে যাবে কেন-র দিকে। আমরা সেই কেনরই উত্তর খুঁজব, তবে তা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে।

মিমের উৎপত্তি কবে, কোথা থেকে? মিম হচ্ছে পলিটিকাল স্যাটায়ারের নয়া ধরণ যা ওয়েব ২.০ যুগে দাপটের সাথে জায়গা করে নিয়েছে ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগসহ বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মে। রিচার্ড ডকিন্স সর্বপ্রথম মিম শব্দটা ব্যবহার করেন তার দ্য সেলফিশ জিন (১৯৭৬) গ্রন্থে। কিন্তু তার ব্যবহৃত অর্থ ছিল সাংস্কৃতিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি ইউনিট বা একক হিসেবে যা নিজের প্রতিলিপি উৎপাদনে সক্ষম (ডকিন্স ১৯৮৯)। বর্তমানে এর ব্যবহার অন্য অর্থে। মিম হচ্ছে এক ধরণের স্যাটায়ার। আর স্যাটায়ারের কথা ধরলে, স্যাটায়ারের অস্তিত্ব ছিল অনেক আগে থেকেই। বিভিন্ন গ্রিক নাটক, রোমান স্যাটারনালিয়া উৎসব কিংবা রেনেসাঁ সময়কার বিভিন্ন লেখনিতে স্যাটায়ারের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এনলাইটেনমেন্টের সময় বিশ্বাস করা হতো, মানুষের চরিত্রের ভুলত্রুটি সংশোধন করা যেতে পারে শিল্পসংস্কৃতির মাধ্যমে। কেননা, শিল্পসংস্কৃতি সমাজের দর্পনে বিম্বিত রূপ। এই সময় (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) ভলতেয়ার, সারভেন্তিস বা জোনাথন সুইফটের নাম নেয়া যায় স্যাটায়ারের পুরোহিত হিসেবে। আমেরিকান সাহিত্যে মার্ক টোয়েনকে বিবেচনা করা হয় স্যাটায়ারের গুরু। তারা তাদের লেখনিতে স্যাটায়ার করেছেন, ব্যঙ্গ করেছেন, আঘাত করেছেন তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

স্যাটায়ারের ধরণ পরিবর্তিত হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে, প্রযুক্তির সাথে সাথে। যদিও এর আঘাতের বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে একই রয়ে গেছে ব্যঙ্গবিদ্রুপ বা অন্যান্য রঙ্গ, রিডিকুলনেসের মধ্যে দিয়ে। শাটজের মতে, স্যাটায়ার সবসময় আঘাত করে কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে (শাটজ ১৯৭৭)। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্যাটায়ার এর ক্লাসিক ফর্মের (উদ্দেশ্য, আঘাত ইত্যাদির ক্লাসিসিজম) দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। দ্য সিলভা ও গার্সিয়ার মতে, এই সময়কার স্যাটায়ারিস্টরা এক ধরণের ডিসটোপিয়ান বাস্তবতা দেখান যেখানে ইউটোপিয়ান বা আদর্শিক উন্নয়নের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা কিংবা বাস্তবতা ভেঙে যায় এর ভঙ্গুরতা বা নিজস্ব বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে। হাক্সলে এবং জর্জ অরওয়েল এই ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শন করেন। ইউটোপিয়ান স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার সীমাবদ্ধতা শুধু তারা তুলেই ধরেননি বরং এদের ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতাও দেখিয়ে দেন (দ্য সিলভা এবং লুই গার্সিয়া ২০১২)।

বিংশ শতাব্দীতে টেলিভিশন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় টেলিভিশন শোগুলো স্যাটায়ারকে সম্প্রচার মাধ্যমে নিয়ে আসে। তখন এক আধুনিক ফর্মে স্যাটায়ারের প্রত্যাগমন ঘটে। পলিটিকাল স্যাটায়ারও হয়ে উঠে বেশ জনপ্রিয়। `দ্যাটস মাই বুশ`, `লিল বুশ` এই শোগুলো প্রেসিডেন্ট বুশকে খানিকটা দুর্বল বা হাস্যকর ব্যক্তি হিসেবে দেখায় যেখানে এই সমালোচনাগুলো ছিলো অক্ষতিকর। এই পলিটিকাল স্যাটায়ার এক ধরণের সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে হাসি তামাশার মাধ্যমে সমালোচনা করতে থাকে। ওয়েব ২.০ যুগে এসে মিমগুলো জায়গা করে নেয় টেলিভিশন শো-এর স্থলে। এখন আমেরিকার নির্বাচনে DIY মিম জনসাধারনকে রাজনৈতিক মতামতে সম্পৃক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের স্যাটায়ার সংষ্কৃতিতে মিমের আগমন কিভাবে ঘটলো? যেহেতু এই নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ নাই, তবে ধারণা করা যেতে পারে এর পরিগমন ঘটেছে সাহিত্য থেকে ওয়েবে।

বাঙালি লেখকের মধ্যে আহমদ ছফার নাম নেয়া যায় যিনি বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আঘাত করেছেন ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে। আবার সাম্প্রতিককালে মঈনুল আহসান সাবেরের `এখন পরিমল` উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে ব্যঙ্গ করা হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এগুলো মিমের দিকে ধাবিত হওয়ার ইঙ্গিত না। তবে ধাবিত হতে ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে কমিক স্ট্রিপগুলো যেমন আলপিন, উন্মাদ, এখনকার যুগের রস+আলো। এইসব ম্যাগাজিন ছবি, শব্দ, রঙ, ভাষা ব্যবহার করে স্যাটায়ারকে কালো সাদা অক্ষর ফর্ম থেকে রঙিন চিত্রিত ফর্মে নিয়ে এসেছে। ওয়েবযুগে বা একবিংশ শতাব্দীতে যখন ছবি বানানো, মত প্রকাশের স্থান, সহজলভ্যতা বাড়লো তখন ইউজার জেনারেটেড মিম বা ব্যবহারকারীর মিম তৈরির প্রবণতাও বাড়লো। বিভিন্ন ধরণের ফেসবুক পেইজ, টুইটার একাউন্ট গড়ে উঠতে লাগলো বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন জনরার মিম নিয়ে। তবে মিমের এই ২০১৯ সালে এসে বেশকিছু ডাইমেনশনও তৈরি হয়েছে।

ওয়েঙ, ফ্লামিন্নি এবং তাদের দল একটি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, মিম সোশ্যাল মিডিয়াতে টিকে থাকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে তথ্য প্রচুর কিন্তু ব্যবহারকারীদের মনোযোগের পরিধি (Attention Span) কম। মনোযোগের এই স্বল্প সময়ে যদি কোন মিম কোন নির্দিষ্ট দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চায় তাহলে তাকে একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই প্রতিযোগিতাই তৈরি করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্যে বিভিন্ন জাতের মিমের (ওয়েঙ ২০১৩)। এইজন্যে এক জাতের মিম নির্দিষ্ট এক ধরণের মানুষের কাছেই পৌঁছে। এই পৌঁছানো বা কোন মিমের জনপ্রিয়তা বিভিন্ন বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়। কোনো সমাজের চলমান ইস্যু, হোক সেটা রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত কিংবা স্রেফ ব্যক্তিগত ইস্যুই একে অপরকে প্রভাবিত করে মিমকে মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়। মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা কিভাবে তৈরি হয়? মিম হচ্ছে এক ধরণের হালকা চালের রসিকতা। বেশি মাথা খাটাতে হয় না, যা জানা তার মধ্যেই হাসির খোরাক জোগায়।

বাংলাদেশি ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে যেমন ফিলোসফি ম্যাটারস বা দার্শনিক মিমস ফর আদুভাই টিনস পছন্দনীয় হতে পারে তেমনি রাজনৈতিক সচেতন মানুষজনের কাছে কালা কাউয়া, মুক্তিবাহিনী মিমস, ক্লকওয়ার্ক মিম, ইয়ার্কির মিম পছন্দনীয় হতে পারে। আবার বাংলা সিনেমা নিয়ে ট্রল করে তৈরি করা মিম নিয়ে আগ্রহী মানুষজনও আছে এবং এই সংক্রান্ত পেইজের সংখ্যাও অনেক।

এক মিমটা দেখা যেতে পারে। কোটা সংষ্কার আন্দোলনে যারা আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছিল তারাই যখন এসে বলে, ‘আরে এই আন্দোলন তো আমরা করলাম’ তখন তাদের পিছে লুকোনো রক্তাক্ত হকিস্টিক দেখা যায়। আমরা দেখি, তাদের কথার সাথে আচারের বৈপরীত্য বা সরাসরি ক্ল্যাশ। আবার দ্বিতীয় মিমটিও কোটা সংষ্কার আন্দোলনকে ঘিরে। যখন দেখি এক নিউজে আসে, আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের মিছিল আবার আরেক নিউজে আসে, আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রলীগের পরিচয় আগে `ছাত্র`, তখন দুটো ন্যারেটিভ সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। এটাকে আখ্যা দেয়া হলো ‘ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প’ হিসেবে, যেটা সংগ্রহ করা হয়েছে মোটিভেশনাল আলাদা একটা ন্যারেটিভ থেকে। এরকম ছোট ছোট অনেক জায়গা, নিউজের ন্যারেটিভ, মোটিভেশনাল ন্যারেটিভ মিলিয়ে মিমটা যেভাবে আমাদের বিনোদন দেয় তা হলো এর বক্তব্যের সাংঘর্ষিকতার জায়গা থেকে। আমরা বৈপরীত্যে মজা পাই, বক্রহাসি হাসি। কেউ যখন একরকম আচরণ করে একসময়, পরবর্তীতে বিপরীত আচরণ করলে দুটোকে পাশাপাশি রেখে ট্রল করি। কেননা মানুষের হিপোক্রেসি উন্মোচন করে দেয়ার মধ্যে মানুষ স্যাডিস্টিক আনন্দ খুঁজে পায়। সেটাই হচ্ছে ডিসটোপিয়ান বাস্তবতা। কেননা, সেখানে কোনো সংহত, যৌক্তিত ব্যাখা থাকে না কেবল থাকে ভেঙে দেখিয়ে দেওয়া– ‘তোমার (মানুষের, প্রতিষ্ঠানের) আগাগোড়াই হিপোক্রেসি!’ এই বিপরীতমুখী অবস্থাই কোনো মিমকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আমরা এখন আর সিরিয়াস বিষয় আর হালকা বিনোদনের পার্থক্য করতে পারি না। সময়ের এই তথ্যবহুল ক্রসরোডে সিরিয়াসনেস, সারকাজম আর বিনোদনের সীমারেখা ভেঙে গেছে। কোনটা সারকাস্টিক আর কোনটা সিরিয়াস বিষয় আর কোনটা কেবল বিনোদনের জন্যে তা আলাদা করে বোঝা যায় না। সবই কমেডি, সবই বিনোদন।

আবার চিন্তা করি, গত মেয়াদের সেতুমন্ত্রীর `চ্যালেঞ্জিং টাইম` শীর্ষক সাম্প্রতিক কিছু মিমের কথা। আমরা মন্ত্রীকে হাসাহাসি করি তার ব্যক্তিত্বের রিডিকুলনেসের কথা জেনে বা না জেনে। কিন্তু তবুও আমরা হাসি। কেননা আমরা তিন নং মিমে মন্ত্রীর স্টিফ হয়ে পত্রিকা ধরে থেকে পোজ দেয়ার রিডিক্যুল একটু হলেও ধরতে পারি। আবার সবার কাছেও এই মিম গ্রহণযোগ্যতা পায় নাই। যারা একটু শহুরে, উঠতি প্রজন্মের, শিক্ষিত, ইয়াং এদের কাছেই মিমগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে। আবার আন্দোলনের সময়কার মিমগুলোর কথা ভাবি। সবাই আন্দোলনগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা নেন নি। কিন্তু মিমগুলো ভাইরাল হয়েছে, ছড়িয়ে অনেকের কাছে। কারণ, সবাই অংশ নিক বা না নিক, সবাই জানে ক্ষমতার গদিতে বসে থাকা শাসকদের রিডিকুলনেসের কথা। সবাই জানে বা পরিষ্কার করে ফেলে, তাদের হিপোক্রেসির বিষয়ে, নিজেদের কাছে। এর প্রমাণ মিমগুলোই। তা না হলে কেন আমরা হাসি? (অর্থাৎ কেন আমাদের কাছে জনপ্রিয়তা পেল?)।

তবে এই হাসাহাসি অন্যকিছুও প্রমাণ করে। রেইলীর মতে, মিম শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই স্যাটায়ারাইজ করে না বরং নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোও তুলে আনে (রেইলী ২০১২)। যেমন, নির্বাচনের সময়কালে ভাইরাল হওয়া মিমগুলো থেকে বোঝা যেতে পারে দেশে বর্তমানে চলা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের রূপ এবং কিছু কিছু মিমের মাধ্যমে– মন্ত্রীদের হাস্যকর স্বরূপ। স্রেফ বিনোদনের পাশাপাশি নাগরিক ইস্যু, রাজনৈতিক ইস্যুতে নাগরিকগণ সম্পৃক্ত হয়ে যেতে থাকে অগোচরেই, দ্রুত মিম আদানপ্রদানের মাধ্যমে। জনমত তৈরিতে তাই মিম ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু, ব্যবহারকারীদের উপর বড় আকারের কোন রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে মিমের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এর উপযোগিতা প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মতামত তৈরিতে (কুলকার্ণি ২০১৭)।

ভাসিলিকি প্লেভ্রিতি তার গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন কেন মানুষজন মিম বানায়। তিনি একটি অনলাইন ফোকাস গ্রুপে এগারজন অংশগ্রহণকারীর সাহায্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি করা কিছু মিম। পর্যায়ক্রমে তিনটি প্রণোদনা মিম তৈরিতে ভূমিকা রাখে বলে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন। প্রথমত, ব্যক্তি নিজের অভিব্যক্তি ও নিজের প্রকৃতিকরণ (মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলোর মতে, ব্যক্তি প্রকৃতিকরণ বা নিজেকে এ্যাকচুয়ালাইজ করতে চায় নিজের প্রতিভা বা প্রকাশ বা আলাদা পরিচয় তৈরির মাধ্যমে) করতে মিম তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হয়। প্রত্যেকটি মিম যেমন এর নির্মাণকারীর অভিমত প্রদর্শন করে তেমনি এর মাধ্যমে নির্মাণকারীর এক ধরণের আত্মতৃপ্তিও কাজ করে। কেননা সে কোনকিছুর মাধ্যমে নিজেকে `কোনকিছু` তৈরী করেছে বা নিজের গুরুত্ব নিজের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছে। মিম এইভাবে ব্যক্তির পরিচয় (Individual Identity) তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তির চোখে যা অনৈতিক, অপরাধ বা সোজা কথায় যেটা ঠিক না সেটা প্রকাশ করার ইচ্ছা মিম তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তার নৈতিক অবস্থান তাকে এখানে একজন সক্রিয় অংশগ্রহনকারী হিসেবে তৈরি করে দেয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা মিম বানালো তারাই বেশি নিষ্ক্রিয়; এর পরবর্তী দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়ার যে কাজ রিএ্যাক্টকারীরা বা শেয়ারকারীরা করে থাকেন তাদের সক্রিয়তা বেশি। অর্থাৎ মিমের আদানপ্রদানে একটা মিশ্র অবস্থা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। মিম যারা বানায় তাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে এই অবস্থা তৈরি হয় এবং এর ফলে কথা বলার একটি প্লাটফর্ম যেমন নিজেদের মধ্যে তৈরি হতে পারে তেমনি নিজেদের সামাজিক পরিচয়ও এখানে সৃষ্টি হয়। নৈতিক অবস্থান তুলে ধরবার পাশাপাশি একই নৈতিক অবস্থানে থাকা অন্যান্য মানুষের সাথে যুক্ত হবার প্রেরণা মিম বানানোর পেছনে পাওয়া যায়। কেবল আনন্দ, বিনোদন বা একে অপরের সাথে যুক্ত হবার যে বাসনা বা স্রেফ সামাজিকতার তাগিদে মানুষজন মিমের মাধ্যমে একে অপরের কাছাকাছি আসতে পারে। শিফম্যান একে অভিহিত করেছেন অংশগ্রহণের সামাজিক যুক্তি হিসেবে (শিফম্যান ২০১৪)। সবশেষে ভাসিলিকি উল্লেখ করেছেন, মানুষজন মিমের প্রতি আকৃষ্ট হয় কেবলই বিনোদনের স্বার্থে। দৈনন্দিন জীবনযাপনের একঘেয়েমিতা, দুঃখ, দুর্দশা থেকে প্রশান্তির খোঁজে মিম ভোক্তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। অবশ্য মিম ভোক্তা বা নির্মাতারা এটাও বিশ্বাস করেন, মিম রাজনৈতিক মতামতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারে বা এর একটি নাগরিক গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু দিনশেষে তারা এর প্রতি আকৃষ্ট হন বিনোদনধর্মী বৈশিষ্ট্যের তীব্রতার জন্যে। এক অর্থে এই দর্শকরা এসকেপিস্ট, যারা দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে পালাতে চান, রাজনৈতিক হল্লা থেকে শান্তি খোঁজেন রস উদ্রেককারী মিমের মাঝে। কোন মিমে তারা রিএ্যাক্ট করেন, শেয়ার করেন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে দেন অন্যান্যদের মাঝে এবং এর সাথে সাথে মিম নির্মাতাও প্রলুব্ধ হন, উদ্দীপনা পান নতুন মিম তৈরিতে। নির্মাতা ও অংশগ্রহণকারী দর্শক, পরস্পরের সমন্বিত এই মিশ্র কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে মিমের সাইক্লিক ইঞ্জিন আরও বেশি গতি পেতে থাকে (প্লেভ্রিতি ২০১৪)।

শেষোক্ত মনস্তাত্ত্বিক কারণের দিকে একটু নজর দিলে কাম্যুর এ্যাবসার্ডিজমের প্রাসঙ্গিকতা বারংবার চলে আসে। আমরা সিসিফাসের মিথকে এখানে আবিষ্কার করি। সিসিফাস, গ্রিক মিথ থেকে উঠে আসা, দেবতাদের মাঝে জেগে থাকা এক সর্বহারা, ক্ষমতাহীন কিন্তু বিদ্রোহী চরিত্র। কাম্যুর কাছে সিসিফাস হচ্ছে এ্যাবসার্ড নায়ক। সিসিফাস মৃত্যুকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছিল। প্লুটো যুদ্ধের দেবতার সাহায্য নিয়ে মৃত্যুকে আবার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন এবং শাস্তিস্বরূপ সিসিফাসকে দেবতারা শাস্তি দেন- অনন্তকাল বিশাল একটি পাথরকে পাহাড়ে গড়িয়ে চূড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আবার সেটিকে গড়িয়ে চূড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আবার সেটিকে- এই চক্রের মধ্যে আটকে রেখে। সিসিফাস পাহাড়ের উপরে নিয়ে যেতে থাকে একটি বিশাল পাথর, সাথে তার দেবতাদের প্রতি শ্লেষ, মৃত্যুর প্রতি বিদ্রুপ এবং জীবনের প্রতি প্যাশন নিয়ে। সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেলে তাকে পাথরটি ফেলে দিতে হয়, সেটি নিচে গিয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে সিসিফাস তার ভাগ্যের এ্যাবসার্ডনেস নিয়ে সচেতন হয়। সে দেখতে পায়, তার এই বহন করা বা গড়িয়ে দেওয়ার কোন শেষ নাই কিন্তু এই এ্যাবসার্ডিটির পরেও প্যাশন বা বিদ্রোহ তাকে আবার পাথরে হাত দিতে উদ্বুদ্ধ করে। সবকিছুর প্রতি একটি বিদ্রুপ জারি রেখে আবার ফিরে আসতে হয় পাথরের কাছে। গড়িয়ে নিয়ে যেতে হয় পাহাড়ের চূড়ায়। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসবার কোন উপায় নাই। কিন্তু সিসিফাস এই চক্রকে অস্বীকারও করে না। বরং চক্রকে মেনে চক্রের মধ্যে আমরা আবিষ্কার করি বিদ্রোহী সিসিফাসকে যে সুখী এবং পরাজিত নয় নিজের কাছে। বরং প্যাশন নিয়ে বারবার এই এ্যাবসার্ড চক্রের মধ্যে চলমান থাকে (কাম্যু এবং ও ব্রায়ান ১৯৫৫)।

আমরা, সাধারণ জনগণ, জীবনের এরকম একটা এ্যাবসার্ড চক্রে আবদ্ধ। রাজনৈতিক শাসন, সামাজিক শাসন, পারিবারিক শাসন আমাদের ঘিরে রাখে। এর মধ্যেই আমরা আবর্তিত হই। প্রতিদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়, মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, ক্লাস করতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয়, অফিসে যেতে হয়, চাকরি করতে হয় এবং ঘরে ফিরে আসতে হয়। প্রতি মেয়াদে নতুন সরকার আসে, আমাদের ভোট চুরি হয়, করের বোঝা আরোপিত হয়, রাজনৈতিক অপরাধ পরিচালিত হয়। মানুষ গুম হয়, খুন হয়, ধর্ষিত হয় কিন্তু বিচার হয় না৷ উকিলদের চেম্বারে অসমাপ্ত ফাইলগুলো স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে৷ এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না কেবল মেনে নেয়া ছাড়া। তখন আমরা একঘেয়েমি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজি। কেউ কেউ এইসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তৈরি করে মিম যেটা একইসাথে রাজনৈতিকভাবে কম ক্ষতিকর অন্যদিকে বিনোদনমূলক। চরম বিপদেও আমরা মাঝে মাঝে হেসে ফেলি। সেই হাসি নৈরাশ্যের হাসি না সবসময়, সেই হাসিতে খানিকটা শান্তির ছোঁয়া থাকে, বন্দিত্বের অসহায়ত্ব থাকে। কিন্তু একই সাথে এই হাসি সিসিফাসেরও। সিসিফাসও বিদ্রুপভরা হাসি হেসে গড়ানোর জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয় পাথরের দিকে। আমরা চোখ বাড়িয়ে দিই মিমের দিকে। মিম এভাবেই এক সিসিফাসিয়ান পরিস্থিতিতে তরুণ জেনারেশনকে কিছু করবার অনুপ্রেরণা দেয়। যার কোন অর্থ থেকেও কোনো অর্থ নেই। যেটা একই সাথে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে এবং জীবনের একঘেয়েমিতার প্রতিবাদকে সন্নিহিত করে। এটা একইসাথে সামাজিক শক্তি তৈরি করে এবং বলাই বাহুল্য রাজনৈতিক অবস্থানও।

মিম জেনারেশন বর্তমানে শক্তিশালী একটি জেনারেশন। এই জেনারেশনের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হলে এই সময়কার মিমগুলোকে বুঝতে হবে। হতে পারে মিম আমাদের কাছে তেমন কোনো সিরিয়াস অর্থ প্রস্তাব করে না। আবার মিম কোনো সিরিয়াস অর্থ প্রস্তাব করলেও এর আসলে কোনো অর্থ নাই। মিমের এই সিরিয়াসনেস না থাকাটা আসলে এই জেনারেশনেরই সিরিয়াসনেস না থাকা। এটি যে খারাপ তা বলা হচ্ছে না৷ বরং এই অবস্থা সিসিফাসিয়ান অবস্থা৷ এই অবস্থা রাজনৈতিক বন্দিত্বের ও সামাজিক অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ। আবার এটিও যে খারাপ তাও বলা হচ্ছে না। কেননা আমরা দেখেছি এই অসহায়ত্ব, বন্দিত্ব আলাদা রাজনৈতিক সংহতি, মতামত তৈরি করে দিতে পারে। যা আদতে মিম জেনারেশনেরই এ্যাবসার্ড বিদ্রোহ।