মুক্ত হস্তে দান নয়, মুক্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করতে দিন

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : আগস্ট ১০, ২০১৮

মুক্ত হস্তে দান করার চেয়ে মুক্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করতে দিন। একটা রাষ্ট্রে মুক্ত হস্তে দানের সংস্কৃতির চেয়ে মুক্ত মস্তিষ্কে চিন্তার সংস্কৃতি জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাষ্ট্রে মুক্ত হস্তে দানের সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, মুক্ত মস্তিষ্কে চিন্তার সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। আমাদের রাস্তার মোড়ে মোড়ে মসজিদ-মাদ্রাসা-মাজারের দান-খয়রাতের বাকসো। আমাদের ফকির থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত একই দশা।

চিন্তা সবাই করতে পারে না। বেশির ভাগ মানুষই নিছক প্রাত্যহিক ও অভ্যেসগত ভাবনার নাম দেয় চিন্তা। ভাবনা সয়ংক্রিয়, চিন্তা সয়ংক্রিয় নয়। চিন্তার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ভূমিকা থাকে। আমি কী ভাববো না-ভাববো, তার অনেক কিছুই আমার হাতে থাকে না, পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভর করে। বাজারে বেগুনের দাম বেড়ে গেলে আমার ভাবনা পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু তাতে চিন্তা পাল্টায় না। চিন্তা হচ্ছে দুধের সর, ক্রমাগত জাল দিলে তা ক্ষীর হয়।

ভাবনা খুব আরবিটারি, স্বেচ্ছাচারী। ফলে সমাজে তৈরি হয় অরাজকতা। কারণ আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষ ভাবনার নাম দিয়েছে চিন্তা, আর সেগুলো তারা সমাজে অ্যাপ্লাই করতে চায়। ভাবনা যে স্বেচ্ছাচারী হয় তারও যৌক্তিক কারণ আছে। ভাবনা স্বেচ্ছাচারী হয় বলেই আমরা কিছু সিস্টেম দাঁড় করাই। কিছু পদ্ধতিকে নির্দিষ্ট চিন্তা দিয়ে বাঁধি। যেন পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো অনুসরণ করে সহজ একটা জীবন পায়। খুবই সিম্পল ব্যাপারটা।

এই চিন্তাগুলো করেন কারা? সমাজের জ্ঞানী-গুণী-সাধু-সন্ত-বুদ্ধিজীবী-দার্শনিকরা। এটা চিন্তা করার কোনোই কারণ নাই যে, আমরা সবাই উন্নত চিন্তা করি এবং সেগুলো সমাজে অ্যাপ্লাই করতে পারি। যুগ যুগ ধরে আমরা সাধারণ মানুষরা সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু চিন্তাদ্বারা ঘুরপাক খাই। এতে লজ্জার কিছু নাই যে, আমি নতুন কোনো চিন্তা দিতে পারতেছি না। বরং পুরনো চিন্তাগুলো সব আমি জানলাম কীনা, তা নিয়েও আমার সমাজে খোলাখুলি আলাপ করতে পারলাম কীনা, তাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দুঃখের ব্যাপার, আমাদের সমাজে সেটাও নাই। অর্থাৎ এ সমাজে সব চিন্তা নিয়ে আপনি আলাপ করতে পারবেন না। রাষ্ট্র আমাদের নির্দিষ্ট চিন্তার মধ্যে বেঁধে দিয়েছে। সব রাষ্ট্রই অবশ্য তাই করে, কম-বেশি। রাষ্ট্রের কামই হচ্ছে চিন্তাকে নির্দিষ্ট ছক করে দেয়া। কারণ চিন্তার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখে। উন্নত কিছু রাষ্ট্রে হয়তো চিন্তার কিছু স্বাধীনতা দিয়েছে। তা না-হলে তারা এতদূর আসতো না। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত উন্নত হতো না। এর মানে আবার এই না যে, তারাও নিজ রাষ্ট্রে বা অপর রাষ্ট্রে শোষণ করে নাই, চিন্তার নামেও করছে।  এখন এ থেকে আমরা খুব সহজে বেরোতে পারবো না। সভ্যতার এটা একটা বিরাট সংকট। সভ্যতা আপনার আমার মস্তিষ্কে কহর মেরে দিয়েছে।

কিন্তু আবার এ কথাও তো সত্য যে, সভ্যতাই আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সভ্যতা একটা বিরাট ধারণা। যা খারাপ হচ্ছে এর মধ্যেই হচ্ছে, যা ভালো হচ্ছে এর মধ্যেই হচ্ছে। চিন্তার যদি মুক্ত-হাওয়া না থাকে তাহলে সে সমাজ দূষিত হতে বাধ্য। সে সমাজ কট্টর মৌলবাদী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হতে বাধ্য। এটা কোনো নৈতিকতার ব্যাপার না, এটা এটা একটা প্রক্রিয়া।

আমাদের সমাজে এক সময় অনেক চিন্তাই ছিল। সুফিবাদ, বুদ্ধবাদ, মার্কসবাদ এখানে এক সময় হাত ধরাধরি করে চলেছে। নানা তরিকার লোক ছিল, যাদের সাথে যে-কোনো বিষয়েই কথা বলা যেত। ভাসানীর মতো মাওলানাও সমাজন্ত্রীদের সাথে নিয়েছেন। এর গুণ শুধু মাওলানা সাবের নয়, এটা এ অঞ্চলের গুণ। সেই গুণগুলা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। চিন্তাকে এখন করে তোলা হয়েছে এককেন্দ্রিক। এককেন্দ্রিক চিন্তা মানেই মৌলবাদিতা, কর্তৃত্বপরায়ণতা। সে যদি বিজ্ঞানও হয়, এবং বিজ্ঞান যে ধর্মের রূপ নিয়েছে এ অঞ্চলে এবং সারা পৃথিবীতেই, এ কারণেই।

আলাপের জায়গা রাখতেই হবে। তা না-হলে সব শেষ। আর এটা সহজও না অবশ্য। কারণ মুক্তচিন্তার জন্য অধিক চিন্তার দরকার, সে সময় কই? এত চিন্তাচর্চার পেছনে এত শ্রম কে দেবে? আপনি বড়জোর উদারপন্থী হতে পারবেন, সে আরেক বিপদ। কিন্তু জেনেবুঝে অনেকগুলো চিন্তা আপনি চর্চা করবেন, এটা সহজ না। বরং কোনো একটা নির্দিষ্ট চিন্তায় আমল নেয়াই সহজ। বেশির ভাগ মানুষ অবশ্য তাই করে। একটা চিন্তা গ্রহণ করে অন্যগুলো বাতিল করে দেয়। জাস্ট ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তারপর ওই একটা চিন্তা নিয়েই লাফায়, ফালায়, বড়াই করে। বলে, দেখো, আমি কি জ্ঞানী, প্রগতিশীল, বৈজ্ঞানিক, অথবা ধার্মিক, সাধু, মুক্তিকামী। অথচ সে যে সমাজের জন্য কতখানি ক্ষতিকর, সেটা বুঝতেও পারে না। তার অজান্তেই সে সমাজের হত্যাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার