যে কথা হয়নি বলা

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মার্চ ০৫, ২০২০

মূলত আমরা প্রকৃতিরই অংশ। আমরা প্রকৃতির যত কাছাকাছি থাকি, তত ভালো থাকি। প্রকৃতি থেকে যত দূরে সরে যাই, তত আমাদের বিচ্ছিন্ন জীবন শুরু হয়। পাহাড় ও বনসংলগ্ন মানুষ খুব ভালোভাবে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতে পারে। গ্রামের মানুষ কিছুটা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে। অন্যদিকে শহরের মানুষ একপ্রকার প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে অপরিকল্পিত নগরায়নের বাসিন্দারা প্রকৃতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, প্রকৃতিতে যার জন্মগত অধিকার, সেই মানুষ প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কী হয়? কেমন হয় তার পরিণতি? চিরিয়াখানার বাঘ, খাঁচার পাখি আর অ্যাকুরিয়ামের মাছের যে দশা হয়, প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন মানুষের সেই দশা হয়। মানুষের শরীর বেঁচে থাকে, কিন্তু মানুষের মনের মৃত্যু হয়। আমরা কি এমন মৃতমনের মানুষ আমাদের চারপাশে দেখিনে?

এই যে এত দূষণ, এত দখল, এত অন্যায়, এত অবিচার— এগুলো কারা করে? যারা করে তাদের মন কি বেঁচে আছে? তাদের ভেতরের সুপ্ত মানবিকতা কি সাড়া দেয়? মনে হয় দেয় না। কারণ প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন এ মানুষগুলোর মন নেই। মনহীন জড় পদার্থের মতো নির্দয় তারা। নির্বিকার তারা। কোনও কিছুই তাদের নাড়া দেয় না। যন্ত্রের মতো তারা চলছে তো চলছেই। তাদের জীবন যে বিবর্ণ হয়ে গেছে, তারা যে প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেটা তারা বুঝতে পারে না।

বসন্তের কোকিল তাদের ডাকে না, কাল বৈশাখির ঝড়েপড়া আম কুড়াতে তাদের ইচ্ছে করে না, আষাঢ়ের বৃষ্টি তাদের ভেজায় না, শরতের সাদামেঘ-কাশফুল তাদের ছুঁয়ে দেয় না, এমনকি হেমন্তের পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ তাদের নাকে আসে না। তারা ড্রেনের পচা গন্ধ, বাসি শবজি, মরা মাছ আর ফার্মের মুরগি নিয়ে বেশ আছে। তারা গাড়ির কালো ধোঁয়া, রাস্তার উড়ন্ত ধুলো, হর্নের বিকট শব্দ আর নোংরা আবর্জনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বেশিরভাগ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। নদীর কালো জলে উৎকট গন্ধ। সকালে হাঁটার জায়গা নেই। শুধু নেই আর নেই। কী নেই? ভালো কিছু নেই, প্রকৃতি নেই, পাখির কলকাকলি নেই, নির্মল বাতাস নেই, স্নিগ্ধ সবুজ নেই, পরিষ্কার জল নেই। কী আছে? সব খারাপ আছে। পলিথিন আছে যত্রতত্র। বয়লার মুরগি আছে। হাইব্রিড মাছ আছে, কংক্রিটের বস্তি আছে, সরু গলি আছে, বিকট শব্দ আছে, হাজারটা মাইক আছে, সেসব মাইকে শব্দদূষণ আছে। আর আছে অমানবিকতা।

প্রথমেই বলেছিলাম প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হলে মানুষের কী হয়?

আপনি পাহাড়ে যান। বনে যান। সম্ভব না হলে প্রত্যন্ত গ্রামে যান। সেখানে এখনো সরলতা আছে, সহমর্মিতা আছে, পারস্পরিক বন্ধন আছে, আছে হৃদ্যতা। শহরে সেটা নেই। আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। একই অ্যাপার্টমেন্টের ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানে না, চেনে না, একে অপরকে। তারা চিনতে চায়ও না। কেন? কারণ, ভয় ও অবিশ্বাস। আমরা মানুষেরা এখন মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।

আগে বনের বাঘ, জলের কুমির মানুষের ভয়ের কারণ ছিল। এখন মানুষ, মানুষের ভয়ের কারণ। এটা কেন হলো? কেন এই নিষ্ঠুর পরিবর্তন? কেন এই অবিশ্বাস? এর কারণও প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতা।

আমরা তথাকথিত সভ্য হওয়ার নামে, শহুরে হওয়ার নামে, নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছি। আমরা নদী দখল ও দূষণ করেছি। জলাভূমি ভরাট করেছি। বন ধ্বংস করেছি। পাহাড় কেটে ফেলেছি। বন্যপ্রাণী মেরে ফেলেছি, আর যা যা করলে প্রকৃতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, তার সব করেছি।

এগুলো করে, প্রকৃতিশূন্য হয়ে, প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে, আমরা পুরোপুরি নিষ্ঠুর অমানবিক হয়ে গেছি। এখন বিরাট প্রশ্ন। আমরা কী এভাবেই থাকব? না আমরা আবার প্রকৃতির কাছাকাছি যাব? উত্তর স্পষ্ট। যদি মানবসভ্যতা বাঁচাতে হয়, যদি মানুষের মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হয়, তবে প্রকৃতির কাছাকাছি আমাদের যেতেই হবে। তা না-হলে, প্রকৃতির প্রতিশোধ আমাদের জন্য অনিবার্য।

আমরা খরায় মরবো, আমরা জলে ডুববো, আমরা ঝড়ে বিধ্বস্ত হবো, আমরা ভূমিকম্পে ধ্বংস হবো, প্রাণঘাতি রোগ আমাদের নিশ্চিহ্ন করবে, আমাদের মানবসভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি, সভ্যতা ধ্বংসের মধ্যদিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে আমাদের।

সময় থাকতে যদি আমাদের বোধদয় হয়, আমরা যদি `গাছের দলের লোক` হয়ে যায়, তবেই আমাদের মুক্তি। তবেই আমাদের শান্তি। তবেই আমাদের কল্যাণ।

ব্রত রায় তার `গাছের দলের লোক` বইতে এসব কথাই বলতে চেয়েছেন। নান্দনিক সুর ও ছন্দে। অসাধারণ অন্তমিলে। গভীর উপলব্ধি থেকে।

`গাছের দলের লোক` বইটির প্রতিটি ছড়া হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। ছড়া নিয়ে হাজার হাজার বই আছে। হয়তো লক্ষ লক্ষ ছড়াও আছে। কিন্তু এমন বই একটিও নেই। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে, প্রকৃতি-পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে এমন একটি বই, এমন ইউনিক ভাবনা, তাকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এ ধরনের বই ব্রত রায়ের মতো স্পষ্টভাষী ছড়াকারদের হাত ধরেই সৃষ্টি হতে পারে।

বইটির আদ্যপান্ত পড়ে আমার এটাই মনে হয়েছে। বইটি বারবার পড়া উচিত। নিজেকে শুদ্ধ করতে, সুন্দর প্রকৃতি গড়ে তুলতে, এ বইয়ের ভাবনাগুলো মথার মধ্যে গেঁথে নেয়া উচিত।

সারস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, শিল্পী মামুন হুসাইনের অসাধারণ প্রচ্ছদের এ বইটির মূল্য ১২০ টাকা। আশি পৃষ্ঠার এ বইটিতে ব্রত রায়ের অনেকগুলো পাঠকপ্রিয় ছড়া আমরা পাব। বইটি যত দিন যাবে ততই আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।

৪ মার্চ ২০২০

একুশে বইমেলা ২০১৮