রংবাজ

উপন্যাস ৬

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮

রাত ঠিক ১টার দিকে একজন সেন্ট্রি আসে হাজতের কাছে। দরজা খুলে বাবুকে ইশারা করে ওর সাথে যাওয়ার জন্য। বাবু উঠে দাঁড়িয়ে রওনা দেয় ওর সাথে। গলিটা পেরিয়ে বড় ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায় বাবু আর ওই সেন্ট্রি। ৩টা টেবিলে তিনজন বসে আছে। একজনের গায়ে কোনো সার্ট নাই, খাকি প্যান্টের সাথে শুধু স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরে আছে। ও বাবুকে ডাকলো ওর কাছে যাওয়ার জন্য। বাবু গেল। ওকে টেবিলের কাছে মাটিতে বসতে ইশারা দিলো। বাবুর মাটিতে বসে মোটেই অভ্যাস নাই, ও এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, মধ্যবিত্তদের মাটিতে বসাটা একটু অস্বাভাবিক, এরা সাধারণত কারো সামনে মাটিতে বসতে পারে না, ইগোতে লাগে ভীষণ। আজ বাবুর আর কোনো ইগো নেই, আছে শুধু চোখ ভরা বিস্ময় আর মন ভরা ভয়। বাবুর হাতদুটো হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাঁধা। ওটার সাথে যে দড়িটা বাঁধা ছিল, সেটাকে নিয়ে সেন্ট্রি ঐ ইন্সপেক্টরের টেবিলের পায়ার সাথে বাঁধলো। এবার ইন্সপেক্টর জয়দেব বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, কই রাখছস পিস্তলটা যেইটা দিয়া গুলি করছস?
বাবু: আমি গুলি করি নাই, আমি জানি না কে ওরে গুলি করছে।
জয়দেব: ওই চুতমারানির পোলা, তুই জানোস না, কে গুলি করছে?
বাবু: না ভাই, আমি কিচ্ছু জানি না।
জয়দেব: ওয়, আমি তোর ভাই না, আমি তোর বাপ।

এই কথাটা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই জয়দেব উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা লাঠিটা দিয়ে বাবুকে মারতে শুরু করে দেয়। প্রথমে একটু সাবধানে মারে, তারপর শুরু হয় এলোপাথাড়ি মারধোর। বাবু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। জয়দেবের লাঠি থামে না, চলতে থাকে বিচ্ছিরিভাবে।

জয়দেব: কিরে তুই স্বীকার করবি? না এইখানেই তোরে মাইরা ফালামু?
বাবু: স্যার বিশ্বাস করেন আমি কিচ্ছু জানি না, আমি মারি নাই কাউরে।
জয়দেব সেন্ট্রিকে উদ্দেশ্য করে বলে, হাশেম মিয়া সুঁই লইয়া আসো, হালারে সুঁই দিমু।
হাশেম চলে যায়। বাবুর চোখ কপালে গিয়ে ঠেকে, এখন ওকে সুঁই দেবে, কোথায় দেবে ও জানে না। ভয়ে ওর মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যায়, কাঁপতে থাকে ও। এদিকে এলোপাথাড়ি মারধোর চলতেই থাকে, থামে না। বাবুর সারা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফেটে ফেটে যায়, হাতের তালু দিয়ে আটকাতে আটকাতে তালুর কয়েক জায়গা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। এত্ত ছোট্ট একটা ছেলেকে মারতে জয়দেবের এতোটুকু হাত বা চোখ কাঁপে না, বেধড়ক পিটাতে থাকে বাবুকে। বাবুর প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থা, গলা দিয়ে শুধু চিৎকার বেরোচ্ছে, আর কোনো কান্না বের হচ্ছে না।

এরই মধ্যে সেন্ট্রি চলে আসে সুঁই নিয়ে। সেন্ট্রি বাবুকে একটা চেয়ারে বসায় যে চেয়ারের হ্যান্ড রেস্ট আছে। হ্যান্ডকাফ খুলে হাতদুটোকে হ্যান্ডরেস্টের উপর রেখে দড়ি দিয়ে পুরো হাতটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলে। পা দুটোকে বাঁধে চেয়ারের দুই পায়ের সাথে। জয়দেব এগিয়ে আসে সুঁই নিয়ে ওর দিকে। ডানহাতের একটা আঙুল শক্ত করে ধরে তার মাথায় সুঁইটা ঢুকিয়ে দেয়। বাবু বিকটভাবে চিৎকার করে ওঠে। জয়দেব জিজ্ঞাসা করে, এইবার কইয়া ফালা কুত্তার বাচ্চা, তা না হইলে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দিমু।

বাবু শুধু চিৎকার করতে থাকে ব্যথায়, ওর কোনো হুঁশ নাই ব্যথার জ্বালায়। জয়দেব আবারও পাশের আঙুলে ঢুকিয়ে দেয় সুঁইটা। বাবুর অচেতন হওয়ার মতো অবস্থা। বাবু শুধু চিৎকার করে বলতে থাকে, স্যার আমি কিচ্ছু জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমার কোনো দোষ নাই। আমি মারি নাই কিসমতরে।

এভাবে আরও কিছুক্ষণ মারধোর চলতে থাকে। একসময় বাবু অচেতন হয়ে পড়ে, সেন্ট্রি আর জয়দেব ধরাধরি করে হাজতে ফেলে দিয়ে যায় ওকে আর অন্যদের বলে, ওরে একটু মুখে পানি দে তোরা, ঠিক হইয়া যাইবো, প্রথম দিনতো, একটু এইরকম হয়। সব ঠিক হইয়া যাইবো।

ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরে আসে বাবুর। চোখ খুলে দেখতে পায় গোপালকে। ওর মাথাটা গোপাল তার কোলের উপর রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবু চেষ্টা করলো চারদিকে তাকাতে, যতটুকু দেখতে পেল তা হলো সবাই ঘুমিয়ে আছে শুধু এই গোপাল ছাড়া। গোপাল ওকে বললো, তুমি ঘুমাও, জাইগো না এখন। এই ট্যাবলেটটা খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ো।

গোপাল ওকে একটা ট্যাবলেট এগিয়ে দেয় সাথে প্লাস্টিকের একটা গ্লাসে পানি। কোনোমতে বাবু ট্যাবলেটটা গিলে ফেলে। গোপাল বলে, তুমি চিন্তা কইরো না, এই খানকির পোলারা স্বীকার করানোর লেইগা এইভাবে মারে, আবার যদি তোমারে নেয়, স্বীকার কইরো না কোনোকিছু।
বাবু: আমাকে আবার নিবে ওরা?
গোপাল: মনে হয় না, কাইল হয়তো চালান দিয়া দিবো তোমারে। তবুও কইলাম তোমারে যাতে তুমি স্বীকার না করো। একবার স্বীকার কইরা ফালাইলে ফাস্ট ডিগ্রীতে ফাইসা যাইবা। তবে তুমি বেশি চিন্তা কইরো না, চালান দিলেই বাঁইচা যাইবা, জামিন পায়া যাইবা।

বাবু গোপালের কোলে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সারা বনগ্রাম কাঁপানো গোপালের এতো নরম একটা মন কিভাবে থাকতে পারে, ও ভেবে পায় না। নিজের সন্তানের মতো করে আদর করছে বাবুকে। এতদিন শুধু দূর থেকে গোপালকে দেখেছে, সবাই ওকে দেখলে কাঁপে ভয়ে। ও নিজেও কোনোদিন কথা বলে নাই ওর সাথে ভয়ে। অথচ নিয়তি ওকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, ও গোপালের কোলে শুয়ে আছে। কখন যেন ও ঘুমিয়ে পড়ে। অগোছালো স্বপ্ন দেখে বাবু।

চলবে