
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৩৭
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ১৪, ২০১৯
স্বপ্ন ছাড়া তো মানুষ বাঁচে না। লেখক-শিল্পীর ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশি সত্যি। আরো বেশি প্রত্যক্ষ। স্বপ্নহীন জীবন্মৃত হয়ে বাঁচতে চান না কোনো লেখক-কবি-শিল্পী। লেখালেখি নিয়ে আমার কিছু অপূর্ণ স্বপ্ন রয়েছে বলেই এখনো বেঁচে আছি। স্বপ্নের লেখাগুলো না লিখে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাই না।
তবে আরো একটি স্বপ্ন আছে আমার। মরে যাওয়ার আগে দেখতে চাই দেশে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। কেবলমাত্র আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো মানেই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন নয়, তা এতদিনে দেশের মানুষ বুঝে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেদিন দেশে সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিনকার প্রজন্ম বিচার করবে অন্য সব কুকীর্তির ধ্বজাধারীদের পাশাপাশি চেতনা-ব্যবসায়ীদেরও।
আমাদের নাটোর শহরে দুটি পার্ক ছিল। একটি একেবারে শহরের কেন্দ্রস্থলে। পাকিস্তান আমলে তার নাম ছিল নাটোর টাউন পার্ক। স্বাধীনতার পরে একাত্তরের অকুতোভয় শহীদ বাবুলের নামে নামকরণ হয় পার্কটির। একে তো পার্ককে বলা হয় শহরের ফুসফুস। তদুপরি এটি ছিল একাত্তরের একজন মহান শহীদের নামে। তাই শহরবাসীর কাছে পার্কটির গুরুত্ব ছিল দ্বিবিধ। আমার কিশোর বয়সে দেখেছি, কী সুন্দর ছিল শহীদ বাবুল পার্ক! অনেক জায়গাজুড়ে সবুজের সমারোহ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটি প্রায় লেকের মতোই স্বচ্ছ এবং শান্তিদায়ক। সেখানে বিকালে হাঁটতে আসতেন শহরের মানুষ। সন্তানদের বেড়াতে নিয়ে আসতেন পিতারা। ছোট ছোট গ্রুপের সাহিত্য সভা হতো পার্কের উন্মুক্ত প্রান্তরে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক এবং ছাত্রকর্মীদের জটলা ছিল সেখানে। সেই পার্কটিকে নাটোর পৌরসভা বানিয়েছে হকার্স মার্কেট এবং কেন্দ্রিয় মসজিদ।
কে করেছিলেন এই কাজটি? নাটোরের তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান, নাটোর আওয়ামী লীগের কিংবদন্তি নেতা বাবু শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী। শুনতে অবাক লাগে? পার্ক তুলে দিয়ে হকার্স মার্কেট। সেইসাথে একাত্তরের একজন শহীদের নাম মুছে ফেলার কাজটি করেছিলেন নাটোরে মুক্তিযুদ্ধেরই একজন প্রধান সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা বাবু শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী।
আর একটি পার্ক ছিল শহরের পিলখানা এলাকায় লালদিঘীর প্রবেশমুখে। নাম বাহাদুর শাহ জাফর পার্ক। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে কার্ল মার্কস অভিহিত করেছিলেন ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের অঘোষিত প্রধান ছিলেন দিল্লীর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। যিনি একজন কবিও। সেই যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাহাদুর শাহ জাফরকে ইংরেজরা নির্বাসিত করেছিল রেঙ্গুনে। মৃত্যুর পরে নিজ দেশের মাটিতে সমাহিত হতে পারবেন না এটি বুঝতে পেরেছিলেন সম্রাট। তিনি লিখেছিলেন একটি মর্মস্পর্শী কবিতা। এই দেশের মানুষ একটি স্বাধীন দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে হাজার বছর ধরে। সিপাহী বিদ্রোহ ছিল তার অন্যতম একটি ধাপ। সেই বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক বাহাদুর শাহ জাফরও তাই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একশো বছর পূর্বেকার সৈনিক। সেই বাহাদুর শাহ জাফরের নামে নাটোরে স্থাপিত হয়েছিল ‘বাহাদুর শাহ জাফর পার্ক’। সেই পার্কে অনেক বছর ছিল অস্থায়ী শহীদ মিনারও। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরির পরে সেই শহীদ মিনারের পাদদেশে সম্মিলিত হয়েই বছরের পর বছর পুষ্পমাল্য অর্পণ করে স্বাধীনতা ও প্রগতির শপথ নিয়েছে নাটোরের মানুষ। আমার কৈশোরে সেখানে হতে দেখেছি বিভিন্ন সংগঠনের সম্মেলন, এবং জনসভাও।
সেই বাহাদুর শাহ পার্কের অর্ধেক জায়গাতে মার্কেট করেছিলেন নাটোরের একসময়ের পৌরপতি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। ঘটনাক্রমে তিনিও আওয়ামী লীগেরই নেতা। বাহাদুর শাহ পার্কের বাকি অর্ধেকটুকু সংস্কার করে সেখানে সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার কথা বলে আসছিলেন নাটোরের সংস্কৃতিকর্মীরা। সেকথায় কর্ণপাত না করে বর্তমান মেয়র বাকি অংশেও অগ্রিম টাকা সেলামি নিয়ে মার্কেট তৈরিতে হাত দিলেন। একটি মামলা হয়েছিল এই পার্ক ধ্বংসের বিরুদ্ধে। কিন্তু নানামুখি চাপের কারণে বাদী আর আদালতমুখি হতে পারেনি। পার্কটিকে বিলুপ্ত করে সেখানে মার্কেট নির্মাণ করছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়র বাবু শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরীর কন্যা উমা চৌধুরী।
অদ্ভুত একটা মিল। শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, উমা চৌধুরী— তিনজনই আওয়ামী লীগের নেতা। এবং তাদের আমলেই ধ্বংস হলো শহরের দুই ফুসফুস। আর সেই সাথে নিশ্চিহ্ন হলো একাত্তরের শহীদ বাবুল এবং সিপাহী বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক বাহাদুর শাহ জাফরের নামযুক্ত স্মৃতিচিহ্ন।
শহীদ বাবুল পার্ক ধ্বংস করার সময় আমি ছিলাম নিতান্ত কিশোর। বাহাদুর শাহ পার্ক অর্ধেক ধ্বংসের সময় কর্মসূত্রে আমি ছিলাম নাটোরের বাইরে। বাকি অর্ধেক রক্ষা করার জন্য আমাদের দুর্বল প্রতিরোধ কার্যকর হলো না। সেলামি, টাকা, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের পক্ষেই থাকলেন পৌর মেয়র। শহরের পরিবেশ বা ঐতিহ্য তার কাছে মূল্যহীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কি অসাধারণ প্রতিফলন! ক্ষমা চাই একাত্তরের বীর সেনানি শহীদ বাবুলের কাছে! ক্ষমা চাই সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে! আমি লেখক হয়েও রেখে যাচ্ছি ইতিহাসের উপাদান। লিখে রেখে যাচ্ছি কার কী ভূমিকা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবশ্যই একদিন বিচার করবে। করবেই। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক