রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩৮

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০১৯

ধরে নিলাম, আপনি নিজে গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি সাহিত্যতত্ত্ব পড়েছেন। বেশ ভালোভাবেই পড়েছেন। যে কোনো লেখাকে ব্যাখ্যা করার মতো অন্তত পড়েছেন। এমনকী আলটপকা মন্তব্য দিয়ে নয়, সাহিত্যতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার সাহায্যেই আপনি রবীন্দ্রনাথ, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সতীনাথ ভাদুড়ী, শামসুর রাহমান এবং এই সময়ের অনেক লেখক-কবিকেই নাকচ করে দিতে পারেন। কারণ সাহিত্যতত্ত্ব অনেক রকমের। আপনি যে কোনো একটির সাহায্য নিয়ে কোনো নিম্ন-মাঝারি মানের লেখক-কবির যেমন উচ্চ প্রশংসা করতে পারেন, তেমনই কোনো বড় ও মৌলিক লেখককে বাতিলও করে দিতে পারেন।

তারপরে কিন্তু আপনার একটি দায় থেকে যায়। যেহেতু আপনি অন্যদের নাকচ করে দিচ্ছেন আপনার মনমোত না হওয়ার অপরাধে, তাই আপনাকেই গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে দেখাতে হবে যে, লেখা এইরকম হওয়া উচিত। আপনার লেখাকে হয়ে উঠতে হবে মানসম্মত লেখার উদাহরণ। এই জায়গাতে এসে আপনি নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস আদৌ পাতে দেবার মতো কিছু হয় না। নিজের রদ্দিমার্কা লেখাগুলো আরেকবার পড়ুন। তারপর সেগুলোকে আবার যদি পাঠকসমক্ষে নিয়ে আসার যোগ্য মনে করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি সাহিত্যতত্ত্বও বোঝেন না। এবং সাহিত্য আপনার জন্য নয়। আপনি অযথা ফরফর করা মানুষ।

সাহিত্যতত্ত্ব আমিও পড়েছি। পড়েছি জানার কৌতূহল থেকে। সাহিত্যতত্ত্ব মেনে সাহিত্য করার জন্য নয়। কারণ তা সম্ভব নয়। সাহিত্যতত্ব গড়ে ওঠে সাহিত্যকে নিয়ে। সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে সাহিত্য গড়ে ওঠে না। অন্তত সৃজনশীল সাহিত্য কখনোই কোনো তত্ত্ব মেনে হয় না।

লেখকজীবনের এই পর্যায়ে এসে কেউ আমার কোনো বই বা লেখার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও আমি তেমন আপ্লুত আর হই না। আবার কেউ আমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেও তা আমার ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। কারণ আমি জানি আমি কী লিখেছি। আমি নিজেই জানি আমার লেখার ত্রুটিগুলো কী কী। সেইসাথে জানি আমার লেখাতে পাঠকের জন্য নতুন কিছু আছে কি না। আর সর্বভূক পাঠক হিসাবে আমি জানি যে, পৃথিবীর কোনো লেখক সব লেখা অসাধারণভাবে লিখতে পারেন না। তিনি মাঝে মাঝে খুব সাধারণ লেখাও লেখেন। কখনো কখনো সাধারণের চাইতেও নিম্নমানের লেখাও লেখেন। বড় লেখকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি যে সাধারণ মানের লেখাগুলো লিখেছেন, সেগুলোর প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে পরবর্তীতে অনেক বেশি পরিশ্রম এবং মেধা-মনন-মনোনিবেশ যোগ করে নতুন একটি লেখায় হাত দেন।

লেখকের জন্য নিজস্ব কথনরীতি তৈরি করতে পারা অনেক বড় সার্থকতা সন্দেহ নেই। আবার সেটাই অনেক ক্ষেত্রে হয়ে যায় অনেক লেখকের জন্য বন্দিশালা। তখন তিনি সেই ছকের বাইরে আর বেরুতে পারেন না। বেরুতে চান না। বেরুতে ভয় পান। ভয় পান এটা ভেবে যে, যে ভঙ্গিতে লিখে সাফল্য পেয়েছেন, সেই কথনভঙ্গির বাইরে গেলে যদি পাঠক তাকে গ্রহণ না করেন! সেই কারণে তিনি আর ভার্সেটাইল হতে পারেন না। একই ধরনের বিষয় নিয়ে একই বর্ণনাভঙ্গির আশ্রয় নিয়ে লিখতে থাকেন। সেটাই তার বন্দিশালা এবং বন্ধ্যাত্বও বটে।

আমি এই ধরনের ছকের বাইরে থাকতে চেয়েছি সবসময়। আমার কাণ্ডজ্ঞান বলে, গ্রামের সর্বস্বান্ত কৃষককে নিয়ে যে গল্প লিখছি, তার ভাষাভঙ্গি এবং আঙ্গিক অবশ্যই শহুরে মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখা গল্পের আঙ্গিক বা কথনরীতির সাথে মিলবে না। বাংলাদেশের কবিকে কেন্দ্রে রেখে যে গল্প লিখছি, তার সাথে আরবের আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগের কবিকে নিয়ে লেখা গল্পের ভাষা-বয়ান-আঙ্গিক কি এক হতে পারে? সাহিত্যের তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেক বিষয়ে পাহাড়সমান তফাৎ আছে। কিন্তু একটি কথায় কারো কোনো দ্বিমত নেই। তা হচ্ছে, সঠিক বিষয়কে সঠিক আঙ্গিক দিতে পারাটাই সফল লেখকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমি সেই কাজটাই করতে চেয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আমি অনেক নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছি। তাই দেখা যায়, যারা ঘোষণা দিয়ে নিরীক্ষাধর্মী গল্প লিখতে বসেন, বা যাদের নামের সাথে নিরীক্ষাধর্মী লেখকের তকমা জুড়ে দেন সমকালের সাহিত্য-সম্পাদক ও সমালোচকরা, তাদের চাইতে অনেক বেশি নিরীক্ষার চিহ্ন আছে আমার গল্পগুলোতে।

যে ভাষাতে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ, সেই ভাষায় লিখতে এসে তাদের সমকক্ষ হওয়া বা তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার কল্পনা করার মতো বাতুলতা কোনোদিনই কাজ করেনি আমার মধ্যে। তবে আমি এটি জানি যে ঐসব মহান লেখক জবনের যেসব তল স্পর্শ করে গেছেন, তার বাইরেও রয়ে গেছে আরো অনেক দিগন্তজুড়ে অস্পর্শিত অকর্ষিত ভূমি। সেই ভূমিতে পা রাখার জায়গা আমার রয়েছে। আমার মতো আরো অসংখ্য লেখক-কবির জন্য জায়গা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সময় বাঙালির জীবন যতটা বিস্তৃত ছিল, এখনকার বিস্তার তার চাইতে শত বা হাজারগুণ বেশি। টিপিক্যাল বাঙালির জায়গাতে তৈরি হয়ে গেছে বহুমাত্রিক বাঙালি-জীবন। সেইসাথে খুলে গেছে বাঙালির জীবন নিয়ে লেখার অনেক রাজপথ-গলিপথ। তাই পুনরাবৃত্তি না করেও বাঙালির জীবন নিয়ে লেখার জমিনের অভাব কোনোদিনই ঘটবে না।

বাংলাসাহিত্য এবং বাঙালিজীবনের আজীবন পাঠক বিনয় সরকার সেই ৬০ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথসহ সব লেখক-কবি মিলেও বাঙালির জীবনের শতকরা ৩০ ভাগের বেশি বাংলাসাহিত্যে নিয়ে আসতে পারেননি। ৭০ ভাগই রয়ে গেছে সাহিত্যের কাছে অজানা। এখন তো নতুন অজানার সংখ্যা এবং শতকরা অনুপাত আরো অনেক বেড়ে গেছে। তাই আমাদেরও ছুটতে হয় এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায়।

কেউ কেউ নিজস্ব কথনরীতি ও আঙ্গিকের তৃপ্তি নিয়ে নিয়ে বসে আছেন নিজ নিজ বানানো নিবাসে। তারা নিজেদের সফলকাম ভাবেন। অনেকেই তাদের সফল মনে করেন। বাংলাসাহিত্যের স্তম্ভ মনে করেন। তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না। তবে আমার পথ তাদের পথের মতো নয়। বাংলাসাহিত্যের জগতে আমি কোনো প্রাসাদ, দালান বা কুঁড়েঘর বানাতে আসিনি। এসেছি অবিরাম পথ চলতে। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক