
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫১
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০১৯
সেই কোন কালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের নিজেদের ইতিহাস নিজেদের লেখার জন্য কাতর অনুনয় জানিয়েছিলেন। ইংরেজরা যে ইতিহাস বানিয়ে রেখে গেছে, তা যে ‘তাদের মতো করে লেখা আমাদের ইতিহাস’ সেটা বঙ্কিমের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল।
কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি। ইংরেজদের লেখা ইতিহাসকেই ভিত্তি ধরে তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার পিএইচডি ডিগ্রিধারী, ইতিহাসের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ। সেই ইতিহাস যে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল এবং সেই ভুলগুলো যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেকমাত্র হয় না। ইংরেজদের বানানো ইতিহাস অনুযায়ী জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর বা সম্রাট বাবর নাকি ভারতে মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা! নামটা ঠিকই আছে। কিন্তু যে বাবর নিজেই মোগল নন, তিনি মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হন কেমন করে? এত শত বছরেও এই প্রশ্নটি কেন যে আমাদের বিদ্বান ইতিহাসবিদরা উত্থাপন করলেন না, তা কেবল তারাই জানেন।
বাবরের পিতৃকূল তৈমুর লঙের বংশধর। বাবর ছিলেন তৈমুর লঙের ষষ্ঠ অধস্তন পুরুষ। জন্ম ফারগানায়। সেটি এখন উজবেকিস্তানে। যদিও তারা জাতিতে উজবেক নন। বাবর নিজেকে সবসময় তৈমুর শাহ-র উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়েছেন। শাসক হিসাবে বাবরদের বংশীয় পদবী ছিল মির্জা। বাবরই প্রথম সম্রাট উপাধি ধারণ করেন কাবুল বিজয়ের পর। ফারগানা ছিল একটি ছোট রাজ্য। তার পিতা ওমর শেখ মির্জা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। প্রচুর উপপত্নী এবং রক্ষিতা ছিল পিতার হারেমে। তিনি পায়রা ওড়াতে পছন্দ করতেন। এই পায়রা ওড়াতে গিয়েই একবার পাহাড়ের ওপরের বাড়ি থেকে পা হড়কে নিচে পড়ে যান পায়রার খাঁচাসমেত। মৃত্যু ঘটে তৎক্ষণাৎ। তাই বাবরকে ১২ বছর বয়সেই ফারগানার সিংহাসনে বসতে হয়।
বয়স ১৮ পূর্ণ হবার আগেই বাবর একাধিক রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। পরেও করেছেন আরো অনেকগুলো বিয়ে। কিন্তু প্রেমে পড়েছিলেন একবারই। তা কোনো যুবতীর নয়। ‘বাবুরি’ নামের একজন তরুণের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। আত্মজীবনীতে এই প্রেমের কথা অসঙ্কোচে লিখে গেছেন বাবর। বাবুরিকে কিছুক্ষণ না দেখতে পেলে তার কলিজা যেন ছিঁড়ে যেত, এমন কথা এবং বাবুরি-কে নিয়ে লেখা অনেকগুলো কবিতা আছে তার আত্মজীবনীতে। এই প্রেমের পরিণতি কী হয়েছিল তা জানা যায় না। বাবুরির কথা হঠাৎ শুরু করে হঠাৎ-ই শেষ করে দিয়েছেন বাবর। (আমাদের দেশের বিশিষ্ট্য মনোরোগ চিকিৎসক কথাসাহিত্যিক জিল্লুর কামাল সমকামী পুরুষদের প্রেম নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন ‘বাবুরি’ নামে।)
তবে বাবরের মাতা ছিলেন মোগল রমণী, বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকু খাঁর বংশের মেয়ে। বাবর তার আত্মজীবনীতে মোগলদেরকে সবসময় নীচু বিশ্বাসঘাতকদের জাতি বলে আখ্যা দিয়ে গেছেন। মোগলদের তিনি ঘৃণা করতেন। বাবর বারবার মোগলদের বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছেন। ঘৃণায় একসময় বলেছেন, এই মোগলরা জয়ী এবং পরাজিত উভয়ের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে। জয়ীদের সঙ্গে থাকলে পরাজিতদের ধন-দৌলত লুঠ করে। আবার পরাজিতদের সাথে থাকলে সেই পরাজিত মিত্রদের মাল-সামান লুঠ করে ভেগে পড়ে।
মায়ের সূত্রে বাবরের বাহিনীতে দুই হাজারের মতো মোগল সৈন্য ছিল। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধ না করে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ শেষ হলে লুঠপাট করার জন্য অপেক্ষা করত। কোনো কোনো খণ্ডযুদ্ধে এমন অবস্থাও হয়েছে যে বাবরকে কেবলমাত্র একশোজন বা তারও কম সৈন্য সাথে নিয়ে বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। বাবর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে একবার নয় দুইবার নয়, পাঁচ-পাঁচবার মোগলরা তার সাথে এই রকম প্রতারণা করেছে। এমনকী একবার বাবর কাবুলের বাইরে থাকাকালে মোগল সৈন্যরা সুযোগ বুঝে কাবুল দখল করে নেবার চেষ্টাও করেছে।
বাবরের প্রধান শত্রুর নাম সেবানি খাঁ। সে ফারগানা দখল করে বাবরকে আশ্রয়হীন করেছে, তার বোন খানজাদে বেগমকে দশ বছর ধরে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়েছে। বাবরকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাবর সেটিকে রাজ্যজয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসাবেই দেখেছেন। তিনি সেবানি খাঁ-কে বিদ্রূপ করেছেন কেবলমাত্র তার কবিতা লেখার অক্ষম চেষ্টার জন্য। উল্লেখ্য, বাবর নিজে কবি ছিলেন। তুর্কি এবং ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। নিজের কবিত্বশক্তি নিয়ে যথেষ্ট তিনি গর্বিত ছিলেন।
বাবরের আরেকজন শত্রু খসরু শাহ। বাবর তার নিন্দা করেছেন ইন্দ্রিয়পরায়ণতার জন্য। প্রজাদের ওপর তার অত্যাচার-অবিচারের জন্য। একবার খসরু শাহ-র কয়েকজন সৈনিক এক লোকের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে আসে। সেই ব্যক্তি খসরুর কাছে বিচারপ্রার্থী হলে খসরু উল্টো বলে দেন যে সে তো তার স্ত্রীকে কয়েক বছর ধরে ভোগ করেছে। এখন অন্যেরা ভোগ করলে তার হিংসা করা উচিত নয়। খসরু শাহ সম্পর্কে বাবর লিখেছেন, রাজলক্ষ্মী কী করে এই অপদার্থ ঘৃণ্য জীবের প্রতি সদয় হলেন! যার না আছে বংশমর্যাদা, না আছে জন্মের গৌরব, না আছে প্রতিভা, খ্যাতি, জ্ঞানবুদ্ধি, না আছে সাহস, না আছে বিচারবুদ্ধি।
দুই জানের দুষমন সম্পর্কে আত্মজীবনীতে এর চেয়ে বেশি নিন্দাবাচক কিছু লেখেননি বাবর। কিন্তু মোগলদের প্রতি ঘৃণা এবং তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন সময় বিপদে পড়ে বাবর মোগল মাতৃকূলের কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করেছেন। পাননি। কাবুল দখলের পর সেই মাতৃকূলের আত্মীয়রা তার কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন সুবিধার আশায়। বাবর তার মায়ের খালা শা বেগমকে উপহার দিলেন কাবুলের সবচাইতে সুন্দর এলাকা ‘পেমখান’। তার মায়ের দিকের আরেক আত্মীয় সুলতান সৈয়দ সর্বস্ব হারিয়ে বাবরের দরবারে এলেন। বাবর তাকে দিলেন মানদ্রা প্রদেশের তুমান জেলাটি। পরে আন্দেজান শহরটি তার দখলে এলে বাবর সেটিও দান করলেন সুলতান সৈয়দকে। সেইসাথে তাকে খাঁ পদকেও ভূষিত করলেন। মোহাম্মদ হোসেন এবং বিরলাস নামক মাতৃকূলের দুই মোগল আত্মীয়কেও অনেক সম্মান এবং সম্পদ দান করেছিলেন বাবর।
কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এরাই মোগল সৈন্যদের সহযোগিতায় কাবুল দখল করে নেবার চেষ্টা চালায়। খবর পাওয়ামাত্র বাবর অনুগত সেনাদল নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে এদের হাত থেকে কাবুলকে মুক্ত করেন। এই বিদ্রোহের হোতাদের কেউ লুকিয়েছিল নারীমহলের গালিচার মধ্যে, কেউ আলমারির পেছনে। তাদের খুঁজে বের করে বাবরের সামনে আনা হলো। রাজপ্রাসাদের নিয়ম অনুসারে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবু বাবর এদের ক্ষমা করলেন। তবে সবার খেলাত এবং জমিদারি বাজেয়াপ্ত করলেন। প্রাণে না মেরে কাবুল থেকে বহিষ্কার করলেন। পাঠিয়ে দিলেন খোরাসানে।
মোহাম্মদ হোসেন খোরাসানে না গিয়ে যোগ দিল বাবরের চিরশত্রু সেবানি খাঁ-র সাথে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা যার রক্তের মধ্যে বহমান সে তো সবার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেষ্টা করে। মোহাম্মদ হোসেন সেবানি খাঁ-র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেবানি খাঁ যথারীতি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর বাবর তার কাছে আর কোনো মোগলকে ঘেঁষতে দেননি। তিতিবিরক্ত বাবর মোগলদের নিয়ে একটি কবিতা লিখে গেছেন:
জাতে মোগল, মোগল জাত?
দেবদূত এরা? কখনো নয়!
মোগল জাত— বদজাত।
সোনার আখরে যদি লেখা থাকে
মোগল নাম
গৌরব সেটা? কখনো নয়।
মোগল নাম— দুর্নাম।
তার পরেও আমাদের ইতিহাসবিদদের কাছে, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, আমাদের শিক্ষাক্রমে জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর মোগল। এবং ভারতে মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ধন্য ইংরেজভক্তি! চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক