আইজাক বশেভিস সিঙ্গার

আইজাক বশেভিস সিঙ্গার

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৫২

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০১৯

সাহিত্য কি মানুষের জীবনের তালিকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? ইলেকট্রনিক বিপ্লব, স্থূল ভোগবাদিতা, পুঁজিবাদী ব্যক্তিসর্বস্বতা, আন্তঃমানবীয় সম্পর্কগুলোর প্রতি অমনোযোগ, দেহসর্বস্ব প্রেম, পণ্যদাসত্ব— এইসব কি মানুষের জীবনে সাহিত্যকে অপাংক্তেয় করে তুলবে? প্রত্যেক বড় লেখক-কবিই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। না হলেও নিজে নিজে অন্তত ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। এবং নিজের নিজের মতো করে উত্তরও দিয়েছেন।

সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি উত্তর পাওয়া গেছে আইজাক বশেভিস সিঙ্গারের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, সাহিত্য পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবার আশংকা তখনই থাকবে যখন লেখক-কবিরা ভালো লেখা লিখতে ভুলে যাবেন। গড়পরতা লেখা, পত্রিকার পাতা ভরানোর লেখা, দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীগুলোর লেখাকে যখন নতুন লেখকরা স্ট্যান্ডার্ড ধরে লিখতে শুরু করবেন, তখন তাদের লেখার মান ওপরে ওঠার কোনো সুযোগ পাবে না। বাজারচলতি সেইসব লেখকদের অনুসরণ করবেন নতুন প্রজন্মের লেখকরা। ফলে পাঠক একসময় বিরক্ত হয়ে সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।

অর্থাৎ ভালো লেখকের অভাব এবং গৌণ লেখকের প্রাদুর্ভাব পাঠককে সাহিত্যবিমুখ করে তুলবে ক্রমান্বয়ে। আইজাক বশেভিস সিঙ্গার নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখক। তবে খুব বেশি পাঠক নেই তার। মূলত তিনি লিখতেন ইদ্দিশ ভাষাতে। যে ভাষাতে ১৯৭০-৭৫ সালেও কথা বলত মাত্র ৩৫ লক্ষ মানুষ। ইদ্দিশ ভাষা ইহুদি ঐতিহ্যের অংশ। সিঙ্গার সেই ভাষাকে আধুনিক সাহিত্যের ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন। পোল্যান্ড, প্যারিস এবং নিউইয়র্ক থেকে ইদ্দিশ ভাষাতে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সিঙ্গার সেইসব কাগজেই লিখতেন। জীবদ্দশাতেই সিঙ্গারের লেখা ৫৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবু তিনি সেই অর্থে অন্য বড় লেখকদের মতো বহুলপঠিত নন। পরে তিনি ইদ্দিশের পাশাপাশি ইংরেজিতেও গল্প লিখতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি গল্প ছাপতে দিতেন মাদমোয়াজেল, হারপর, দ্য স্যাটারডে ইভিনিং পোস্ট, ভোগ, প্লেবয় পত্রিকাতে। এইসব পত্রিকা সাহিত্যের চাইতে যৌনতা বিপননের জন্যই বিখ্যাত বা কুখ্যাত। এইসব পত্রিকায় লেখার মাধ্যমেই তিনি সাধারণ পাঠকের কাছে কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিলেন। আর্থিক টানাটানির জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেছিলেন।

সিঙ্গারের আরেকটি মতামত জানিয়ে রাখি। অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে অনুবাদে মূলের অনেককিছুই হারিয়ে যায় বটে। তবু যে কোনো বড় লেখককে অনুবাদ পাঠ করলেও বোঝা যায় যে তিনি বড় লেখকই। এই মতামত আমার নিজেরও। লেখক-কবিরা ভালো লিখতে ভুলে যাবেন, এই ব্যাপারটি আসলে কী? শক্তিমান লেখকরা ভালো লিখবেনই। ইচ্ছা করলেও তারা খারাপ লিখতে পারবেন না। লিখলেও সেই দুর্বল লেখাকে পাঠকের চক্ষুর আড়ালে রাখার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু অসংখ্য দুর্বল বই যখন গুটিকয়মাত্র ভালো বইকে বিজ্ঞাপন, পদ-পদবি, বিপণনের মাধ্যমে পাঠকের সামনে থেকে আড়াল করে ফেলে তখন পাঠকরা মনে করতে থাকেন যে ভালো সাহিত্যকর্ম আর সৃষ্টি হচ্ছে না। একটার পর একটা গতানুগতিক, দুর্বল, স্থূল সাহিত্যের বই তাদের সামনে আসতে থাকে। তখন তারা সাহিত্য থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। একুশের বইমেলায় একবছরে প্রকাশিত সাড়ে চার হাজার বইয়ের গন্ধমাদন থেকে ৫০টি ভালো বই খুঁজে বের করা কী যার-তার কম্মো!

জীবনানন্দ দাশ খুব কঠিন কথা বলে গেছেন সিঙ্গারেরও আগে। বলেছেন, সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি। এই কবি শব্দটিকে আমরা প্রসারিত করে নিতে পারি সব ধরনের শিল্পী অর্থে। জীবনানন্দ দাশ অপরিষ্কার করে বলেছেন, প্রকৃতি সবাইকে সবকিছু দেয় না। তাই সবার পক্ষে সবকিছু হওয়া সম্ভব হয় না।

এবার আমরা সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য দাবড়ে বেড়ানো হারুকি মুরাকামির প্রেসক্রিপশনটা খেয়াল করতে পারি। তিনি বলেছেন, উপন্যাস যে কেউ লিখতে পারে, যদি তার তিনটি গুণ থাকে।

১. সহিষ্ণুতা, অধ্যবসায়। লিখতে সময় লাগে, শারীরিক পরিশ্রম লাগে, মানসিক শ্রম দিতে হয়। ঘুমের বা সামাজিকতার সময় কমিয়ে লেখার টেবিলে বেশি সময় বরাদ্দ করতে হয়। সঠিক শব্দের খোঁজে কলম কামড়াতে হয়। বারবার অভিধানের সাহায্য নিতে হয়। একটা বই লেখার জন্য এক হাজার বই বা প্রবন্ধ পড়তে হয়। একটি তথ্যের জন্য যেতে হয় অনেক মাইল পাড়ি দিয়ে সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞের কাছে। আমার এখন যাকে বলি ‘পেইন নেওয়া’। সেই পেইন নিতে হয় পদে পদে। মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিয়ে যে কেউ এই পেইন নিতে পারবেন। অভ্যাস করে নিতে পারবেন পেইন নেওয়া। এইসব কষ্ট ও পরিশ্রেমকে প্রকাশ করার ইংরেজিতে তিনি যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা হচ্ছে, Endurrance.

২. বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ করা। তিনি যাই করুন না কেন সবসময় তার চিন্তার কেন্দ্রে থাকবে উপন্যাস এবং উপন্যাসের বিষয়। উপন্যাসের বিষয় নিয়ে তিনি যত বেশি ভাবতে থাকবেন বিষয়ের বহুমাত্রিক দিকগুলো তত বেশি তার মনের চোখে আবিষ্কৃত হতে থাকবে। উপন্যাসে তিনি কোন তথ্য বা বক্তব্য উত্থাপন করবেন, সেটি তাকে ভেবে নিতে হবে খুব পরিচ্ছন্নভাবে। যে বিষয়টি নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখছেন, সেই বিষয় নিয়ে আগে কে কে লিখে গেছেন সেগুলির খোঁজ নিতে হবে যতদূর সম্ভব। এবং অবশ্যই তার লেখা যাতে পূর্বজ লেখকের লেখা থেকে ভিন্নধর্মীতা লাভ করে, সেভাবেই লিখতে হবে তাকে। একই বিষয়ের চর্বিত চর্বণ যেমন পাঠককে বিরক্ত করবে, তেমনই লেখক নিজেও হাতাশায় আক্রান্ত হবেন। যে বিসয়টি তিনি লিখছেন সেই বিষয়ের সমাজতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, আইনগত, আন্তঃমানবিক দ্বন্দ্ব-মিলন সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে তাকে। মুরাকামি আশ্বাস দিচ্ছেন যে, সব মানুষই মন থেকে চেষ্টা করলে এই গুণ অর্জন করতে পারবেন। লক্ষ থাকবে পাখির চোখ। অর্জুনকে একটি ঘূর্ণায়মান পাখির চোখে তীর বেঁধাতে হবে। পাখি ঘুরছে, তার শরীরে রং-বেরঙের পালক, যে গাছে পাখিটি বসে আছে তার শাখা-প্রশাখা নানা রকম রত্নরাজি দিয়ে মোড়ানো, সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে সেইসব রত্ন-পাথর থেকে। কিন্তু অর্জুন অন্য কিছুই দেখছেন না। দেখছেন কেবলমাত্র পাখির চোখটি, যেখানে তাকে তীর বেঁধাতে হবে। উপন্যাস লেখার সময় এই একাগ্রতা দরকার হয়। মুরাকামি বলছেন, যে কোনো মানুষ চেষ্টা এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এই মনঃসংযোগ বা একাগ্রতা অর্জন করতে পারবেন। ইংরেজিতে এটি মুরাকামির ভাষায় Focusing.

৩. তৃতীয় গুণটিকে বা যোগ্যতাকে মুরাকামি বলছেন Literary talent. এই গুণটি মানুষ কীভাবে পাবে বা অর্জন করতে পারবে, তা মুরাকামি জানেন না। তার মতে সম্ভবত এটি অর্জনযোগ্য নয়। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে তা আল্লাহর দান, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীর কাছে তা প্রকৃতির দান।

যিনি লিখতে এসেছেন, তাকেই ভেবে দেখতে হবে তার মধ্যে এই গুণটি আছে কি না। না থাকলে তিনি উপন্যাসিক হতে পারবেন না। মুরাকামি তাই শক্তির অপচয় বেশি হয়ে যাওয়ার আগেই, লিখতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে বলেছেন, তার ভেতরে লিটারারি ট্যলেন্ট আছে কি না। যদি না থাকে, তার উচিত হবে অন্য কোনো কাজ করা, যেটি তিনি সবচাইতে ভালো পারবেন। সক্রেটিস এবং প্রাচীন জ্ঞানীরা এটাকেও বলেছেন ‘নো দাইসেলফ’-এর একটি প্রকারভেদ। খুব কড়া হয়ে গেল কথাগুলো। তবে কোনো কথাই আমার নয়। সবই মহাজন বাক্য। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক