আল মাহমুদ

আল মাহমুদ

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৫৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ১৩, ২০১৯

আল মাহমুদকে নিয়ে লেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবু লিখতে হচ্ছে। প্রথমে আগের একটি পর্বের লেখার রেশ ধরে মনে করিয়ে দিতে চাই, কোনো প্রতিভাবান বা মেধাবী তরুণ লেখক-কবি কোনো অগ্রজ লেখক-কবির ডুগডুগিবাদক হন না। ডুগডুগিবাদক হয় নিম্ন মেধার অধিকারীরা। মেধাবীরা সকলের লেখা পড়েন, সাহিত্যমূল্য বিবেচনা করেন, সেইসাথে কবি-লেখকের জীবনযাপন লক্ষ করেন, দূর থেকে শ্রদ্ধা করেন অথবা এড়িয়ে চলেন। অপ্রয়োজনীয় মনে করলে তাকে নিজেরপাঠ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন। কেননা দেশি বা বিদেশী ভাষায় এত মূল্যবান পাঠসামগ্রী রয়েছে যে তা পড়তে একটা জীবন যথেষ্ট মনে হয় না।

এই দেশে নিম্ন-মেধাবীরা নানা লেখক-কবির সাথে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ান। মূলত অমুক বিখ্যাত (!) লেখক-কবির সাথে তার ব্যক্তিগত সখ্য আছে এটা দেখানোর জন্য, আর কেউ কেউ নিজের অখাদ্য পুস্তকের জন্য তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট চান। এবং পানও।

আল মাহমুদের ক্ষেত্রে এইসবের সাথে যোগ হয়েছে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মেরুকরণ। জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি-র জামায়াত ঘেঁষা অংশের লেখক-কবিরা আল মাহমুদকে নিজেদের লোক হিসাবে ঘোষণা দিয়ে নিজেদের জাতে তুলতে চান। আর আওয়ামী লেখক-কবিরা তাকে অস্বীকার করতে চান। বাম ঘরানার লেখকরা আল মাহমুদের ব্যক্তিজীবনের অসততার জন্য নিন্দা জানান, আবার তার শক্তিশালী কবিতাগুলোকে পাঠও করেন।

জামায়াত এবং সংশ্লিষ্টরা অদ্ভুত সব কথা বলেন। তারা বলেন, আল মাহমুদ ইসলাম নিয়ে লেখার জন্য তার বিরোধিতা করে তথাকথিত প্রগতিশীলরা। এটি একটি মিথ্যা কথা। এটি জামায়াত-শিবিরের পুরনো কৌশল। যখনই জামায়াত বা শিবিরের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মহল একত্রিত হয়েছে তখনই তারা ইসলামকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। মানুষকে বোঝাতে চেয়েছে, আমরা ইসলামের কথা বলি, তাই ওরা আমাদের বিরোধিতা করে। তাদের সেই কৌশল অনেক সময় কাজে লেগেছে। সর্বশেষ সাঈদীকে চাঁদে পৌঁছানো পর্যন্ত কাজে লেগেছে। এখন আর সেই ধার নেই বটে। কিন্তু আল মাহমুদকে নিয়ে তারা সেই একই চাল চেলে যাচ্ছে।

প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ইসলামি কবিতা রচনার জন্য কেউ আল মাহমুদকে গালমন্দ করে না। যেমন করেনি ফররুখ আহমদকে। যদি ইসলামি অনুষঙ্গ নিয়ে সাহিত্য রচনা করলে তা গালমন্দের খোরাক হয়, তাহলে বর্তমান সময়ে আমি এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গালমন্দ খাওয়ার মতো একজন লেখক। কিন্তু তা ঘটেনি। তাই আল মাহমুদকে সমালোচনা করার উৎস তার ইসলামি কবিতা নয়, বরং তার ব্যক্তিগত জীবন এবং নৈতিক পদস্খলন। টাকার কাছে, সুবিধার কাছে নিজের আদর্শ বিক্রি করে দেওয়া। প্রথমে তিনি জিয়াউর রহমানের সাথে ভিড়ে গিয়ে জাসাস-এর সভাপতি হলেন। তা অনেকেই সেরকম করেছে। তাদের মতো তিনিও যদি বলতেন যে টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্যই তো সরকারি দলে যোগ দিয়েছি, তাহলে ব্যাপারটা তখনই মিটে যেত। কিন্তু উল্টো তিনি নিজের স্খলন ঢাকার অপচেষ্টায় সাহিত্যজগতের প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন। জিয়াউর রহমান তাকে ঢাকা শহরে একটা বাড়ি দান করলেন। তা যার ঢাকা শহরে নিজস্ব কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা প্লট নেই, তাকে তা বরাদ্দ দেওয়াটা বেআইনি নয়।

কিন্তু এরশাদের সময় আবার তার ডিগবাজি। একা নয়। কবিকণ্ঠ-গ্রুপটার অনেককে সঙ্গে নিয়ে। খুবই বিদ্বান কিন্তু চিরকালের সরকারি দল সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফজল শাহাবুদ্দিনসহ তিনি ভিড়লেন এরশাদের কবিসভায়। এরশাদ তাকে সাংবাদিক পল্লীতে বরাদ্দ করলেন আরেকটি বাসস্থান। এবারেরটা কিন্তু পুরোপুরি বেআইনি। কারণ আগেই জিয়াউর রহমান তাকে বাড়ি দিয়েছেন আগেই। একই ব্যক্তি ঢাকা শহরে একাধিক সরকারি বাড়ি/প্লট/ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে পারে না। এরশাদের পতনের পরে তিনি ঢুকলেন জামায়াতের আধুনিক প্রেসের অঞ্চলে। ইনকিলাব-পূর্ণিমা- নয়া দিগন্ত সহ জামায়াতি এবং ডানপন্থী মৌলবাদীদের সাথী করলেন তিনি। তাকে প্রচলিত সম্মানীর চাইতে অনেক বেশি দেওয়া হতো। এই দেওয়াটা সম্মানী নাকি দলত্যাগের ঘুষ, তা বলা শক্ত।

এবার আরেকটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। আল মাহমুদের ডুগডুগিবাদকরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রচার করে থাকে। হয়তো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটও তার আছে। একথা সত্যি একাত্তর সালে আল মাহমুদ দেশ থেকে পালিয়ে কলকাতায় অবস্থান করেছেন। কিন্তু তিনি সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কোন কাজটি করেছেন তা কেউ বলতে পারে না। সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করাটাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়। আরো নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন অনেকে। এদেশের কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন, নিজেদের লেখা কবিতা পাঠ করে গেরিলাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন, বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে লেখালেখি করেছেন ইত্যাদি। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আল মাহমুদ কী করেছেন? এইসব বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে তার নাম পাওয়া গেছে কি? তাকে কলকাতায় পরম সমাদরে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন কবিতা সিংহ এবং তার স্বামী। এক পর্যায়ে আল মাহমুদের বিভিন্ন কু-আচরণের জন্য তারা একসময় বাধ্য হয়েছিলেন তাকে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার জন্য বলতে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতাপত্রের একটি সংখ্যায় খুব বিরক্তির সাথে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন লড়াই করছে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে, সেই সময় বাংলাদেশের কয়েকজন লেখক-কবির কাণ্ড-কারখানা দেখে তিনি তাদের কিছু অপকর্মের কথা লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন তার কাগজে। তাদের মধ্যে আল মাহমুদও অন্তর্ভুক্ত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ইন্ডিয়ায় গেছে কেবলমাত্র তারাই মুক্তিযোদ্ধা, আর দেশত্যাগ করেনি তারা সবাই রাজাকার— এমন ধারণার বিরুদ্ধে সবচাইতে সরব হচ্ছে বিএনপি-র ডনপন্থী অংশ এবং জামায়াত-শিবির। কিন্তু তারাই আবার ইন্ডিয়ায় হিজরতের কারণে আল মাহমুদকে মুক্তিযোদ্ধা এবং ঢাকায় অবস্থানের কারণে শামসুর রাহমানকে রাজাকার বলতে চেষ্টা চালান। শামসুর রাহমান যে ‘বন্দি শিবির থেকে’ বইয়ের কবিতাগুলো অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে লিখেছেন, এবং সেটি কলকাতা থেকে মজলুম আদীব ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে, এবং সেটাও যে শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই— সেকথা ভুলেও মনে করতে চায় না ঐ শিবিরের লোকজন।

কেউ কেউ বলতে চান যে আল মাহমুদ টাকা নিয়েছেন জিয়া-এরশাদ-জামায়াতের কাছ থেকে, সুবিধা গ্রহণ করেছেন, বিদেশভ্রমণ করেছেন, সেসব যদি অন্যায় হয়, তাহলে এখন যারা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন অপ্রাপ্য সুবিধা নিচ্ছেন সেগুলো কেন অন্যায় নয়? আমার পরিষ্কার উত্তর, এগুলোও অন্যায়। তবে একটা অন্যায় দিয়ে আরেকটা অন্যায়কে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া যায় না। দশজনের স্খলন দেখে একজনের স্খলনকে কখনোই নিন্দা না জানানোর কারণ নেই। অন্যায় অন্যায়ই। স্খলন স্খলনই। কবিতা এই লেখার আলোচ্য নয়। সেটি অন্যত্র হবে।

আমার অবস্থান পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্মগুলো নিয়ে আমি সবসময় সোচ্চার। বর্তমানের লেখক-কবিদের মধ্যে হয়তো সবচাইতে সোচ্চারদের একজন। কিন্তু তাই বলে জামায়াত-শিবিরকে আসন গাড়তে দিতে রাজি নই। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক