
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০১৯
লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবাই যে কেবলমাত্র টাকা বা সুযোগ-সুবিধার জন্য নিজের আদর্শ ত্যাগ করেন তা নয়। অনেকেই যতখানি আশা করেন ততখানি মূল্যায়িত না হয়ে ক্ষোভে-অভিমানে-ক্রোধে বিপক্ষ শিবিরে গিয়ে যোগ দেন। তখন তিনি অমৃতের অনুসন্ধানী না হয়ে কেবলমাত্র গরল উদ্গীরণ করতে থাকেন। যেহেতু আগে যে প্রগতিশীল ধারাতে ছিলেন সেই ধারার অনেকের সাথেই তার যোগাযোগ ছিল, সেই ধারার শক্তি এবং দুর্বলতার দিক তিনি কিছু কিছু জানেন, এমনকি খারাপ দিকগুলোও জানেন, তাই তার কলম হয়ে ওঠে মৌলবাদী ধর্মাশ্রয়ী শিবিরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র। এমন লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের সন্ধানে সবসময় তৎপর থাকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। এই রকম কবি-সাহিত্যিকের উদাহরণ জাতীয় পর্যায়ে রয়েছে। বুদ্ধিজীবী হতে চাওয়া একজন নিম-বুদ্ধিজীবীকে প্রগতিশীল ধারা সেভাবে গ্রহণ করেনি বলে তিনি এখন পুরোদস্তুর বিপরীত শিবিরের হয়ে সকল প্রগতিপন্থী এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের লেখকের কুৎসা গেয়ে চলেছেন অবিরাম ফেসবুকে, ব্লগে, পুস্তকে।
আমাদের শহরে একজন খুব নিবেদিতপ্রাণ লেখক ছিলেন। শফীউদ্দীন সরদার। চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে মৃত্যু পর্যন্ত সার্বক্ষণিক লেখালেখি করতেন। নাটকীয় মনে হলেও সত্য যে, তিনি মশা যাতে উৎপাত না করতে পারে সেইজন্য খাটের ওপর চেয়ার-টেবিল তুলে বিশাল মশারি খাটিয়ে লিখতেন। বাড়ির এক কোণে দিঘির পাশে একটি ঘর বানিয়েছিলেন লেখার জন্য। সেই ঘরের দরজায় ছোট সাইনবোর্ড ছিল ‘লেখাঘর’। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ। ইংল্যান্ডেও উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন। নাটোর এবং রাজশাহী জেলাতে অনেকগুলো স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। এরশাদ-বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। বয়সের কারণে সেই চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়েছিল ২-৩ বছর পরেই। সেই এরশাদের আমলেই।
লেখালেখির শুরুর দিকে লিখতেন রম্যরচনা, যাত্রাপালা, নাটক, উপন্যাসও। নাটোরের লোককাহিনি এবং লোকগানভিত্তিক তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রয়েছে। নাম ‘শীত-বসন্তের গীত’। যাত্রা লিখেছেন ‘গাজী মণ্ডলের দল’ নামে। নাটোরের ঐতিহ্যবাহী নাট্য প্রতিষ্ঠান ‘সাকাম’-এর সুবর্ণ সময়ে তার লেখা নাটক ‘কাঁকড়া-কেত্তন’ মঞ্চস্থ হয়েছে অনেকবার। ‘সাকাম’-এর প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতির মর্যাদাপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কয়েক বছর। রাজশাহী বেতারে তার নাটক প্রচারিত হয়েছে অন্তত কুড়িটি। কিন্তু তার ছিল অতৃপ্তি। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে তিনি লেখক হিসাবে কাঙ্ক্ষিত স্থানটি পাননি। পাওয়া শুধু তার জন্য নয়, সবার জন্যই কঠিন ছিল। কারণ সেই সময় মিডিয়া-বুম হয়নি। ফেসবুক-ব্লগ-অনলাইন তো দূরের কথা। ‘দৈনিক বাংলা’, ‘সংবাদ’, ‘ইত্তেফাক’-এ লেখা ছাপা হওয়া বেশ দুরূহ ব্যাপারই ছিল। একই রকম কঠিন ছিল ‘সাহিত্যপত্র’, ‘দীপঙ্কর’, ‘সুন্দরম’ পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়া। আর লেখা ছাপা হলেই বা বই প্রকাশিত হলেই কোনো লেখক আলোচিত হবেন, এমন অবস্থা ছিল না।
এই সময়ে প্রাক-মৌলবাদী অংশের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হলো এরশাদের মন্ত্রী রাজাকার মওলানা মান্নানের দৈনিক ‘ইনকিলাব’। প্রচার সংখ্যায় তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত ‘ইত্তেফাক’কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল সম্ভবত পত্রিকাটি। সেই সময় নাটোর ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জেলাপ্রধান কর্মকর্তা হিসাবে এলেন জামায়াতে ইসলামির একজন রোকন বুদ্ধিজীবী জাইদুর রহমান। ভালো সংগঠক ছিলেন তিনি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পদের সুযোগ নিয়ে নাটোরে গড়ে তুলেছিলেন নানাধরনের শিশু-কিশোর গ্রুপ, তরুণ-যুবকদের গ্রুপ। তারা অনুষ্ঠান করত, লেখালেখি করত ইসলামি ধারায়। পরে কেউ কেউ ছাত্রশিবিরের বড় নেতাও হয়েছিল। সেই জাইদুর রহমান করায়ত্ত করলেন শফীউদ্দীন সরদারকে। লেখালেখি এবং চিন্তা-চেতনায় পুরোপুরি উল্টোদিকে বাঁক নিয়ে নিলেন শফীউদ্দীন সরদার। ‘ইনকিলাব’-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে শুরু করল তার উপন্যাস ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’। তারপর পর পর বেশ কয়েকটি উপন্যাস। জামায়াতে ইসলামির প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল তার ঢাউস সাইজের উপন্যাস একের পর এক। কলকাতার মুসলিম চিন্তাধারাভিত্তিক প্রকাশনীগুলোও ছাপত সেইসব উপন্যাস। ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় শফীউদ্দীন সরদারের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছি আমি সেই সময়। ‘ইনকিলাব’ এবং জামায়াতমনা সাহিত্য সংগঠনগুলো তাকে সংবর্ধনা দিতে শুরু করল। কিছুদিন পরে তার বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলল ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নাটোর শাখার কার্যালয়।
আমি নিজে তখন লেখালেখির জগতের দরজা ধাক্কানো শুরু করেছি মাত্র। লেখক-পরিচিতির চাইতে কুখ্যাতিই বেশি। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ করলেন। সেটি যে ধর্মভীরুতা নয়, রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজিমাত্র; আর সেইসাথে দেশের অন্য ধর্মের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার পদক্ষেপ— এইসব লিখলাম আমি খুব কড়া ভাষায়। সঙ্গে সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে মিছিল, বাড়িতে হামলা, আমাকে না পেয়ে আব্বাকে অপমান, বিরাট ধর্মীয় জনসভা ডেকে আমাকে মুরতাদ ঘোষণা ইত্যাদি ঘটে গেছে ততদিনে।
কুখ্যাত একজন ডিসি ছিলেন তখন নাটোরে। লাম্পট্য থেকে শুরু করে ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার— সবকিছুতে চ্যাম্পিয়ান। সেই ডিসির পাশে তখন আবার ভন ভন করত নাটোরের সব লেখক, সাংবাদিক, নাট্যশিল্পী, গাইয়ে, নাচিয়ের দল। (এই লেখাটা লিখতে বসে খেয়াল করছি নাটোরের অধিকাংশ কুলচুর-ওয়ালা চিরকালই এমপি-ডিসি-এসপি-মেয়রদের চারপাশে ভন ভন করে)। সেই ডিসি এবং তার তোষামোদকারীদের কটাক্ষ করে একটি পদ্য লিখেছিলাম ‘নাটোর’ নামে। সাথে সাথে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ। বেচারা সম্পাদক ছেলেটা (এখন ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট) মাফ-টাফ চেয়ে পার পেল। কিন্তু মূল রাগ তো আমার ওপর। অতএব আরো বেশকিছু ভোগান্তি। ফলাফল, আমার কুখ্যাতি আরো বেড়ে যাওয়া। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বা বিজয় দিবসে কেউ কোনো স্মরণিকা বের করতে চাইলে, এবং সেখানে আমার লেখা থাকলে প্রেসওয়ালারা পত্রিকা ছাপার কাজ নিতে চাইত না।
নীতিগত কারণেই তখন শফীউদ্দীন সরদারের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তবে আমি যেতাম তার বাড়িতে। তার এক পুত্র আমার সহপাঠী এবং খুবই ভালো বন্ধু। এখনো। তাদের বাড়িতে গেলে আমি চেষ্টা করতাম যেন সরদার চাচার নজরে না পড়ি। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই সেই চেষ্টা সফল হতো না। তিনি ডেকে নিতেন আমাকে। আমি তাকে আক্রমণ করে কখনো কোনো কথা বলিনি। কিন্তু তিনি নিজেই আমার কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন তার অবস্থান পরিবর্তনের কারণ। আমার কাছে কোনো কারণ-ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু মুখের ওপর সেকথা বলিনি। অন্যত্রও তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলিনি। শুধু একবার আমি মৃদু প্রতিবাদ করেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি ঘোর সাম্প্রদায়িক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। বলছিলেন, এই রকম ঘোর সাম্প্রদায়িক লেখককে যথাযথ উত্তর দেয়া একজন মুসলমান লেখক হিসাবে তার দায়িত্ব। আমি মৃদুস্বরে বলেছিলাম, বঙ্কিমচন্দ্র যদি সাম্প্রদায়িক হন, সেটি তার কলঙ্ক। তার উত্তর দেবার জন্য আপনি-আমি যদি সাম্প্রদায়িকতারই আশ্রয় নিই, তাহলে আমাদের কপালেও কলঙ্কই জুটবে। আর নিজের সম্প্রদায় নিয়ে লিখতে চাইলে সাম্প্রদায়িক না হয়েও লেখা যায়।
তিনি সুযোগ পেয়ে বললেন, তুমি আমার উপন্যাসগুলো পড়ে দ্যাখো। সাম্প্রদায়িকতা পাবে না। বলেছিলাম, আচ্ছা পড়ব। কিন্তু পড়িনি। কারণ, তার ‘শীত-বসন্তের গীত’ পড়ে যেটুকু ভালোলাগা রয়ে গেছে, তা এইসব ইনকিলাবি থান ইট সাইজের বইগুলো পড়ে নষ্ট করতে চাইনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো তিনি অনেককিছু পেয়েছেন এই ধারাতে লেখালেখি করে। কিন্তু নিজের ভেতরে অতৃপ্তি বিরাজ করত সবসময়। মূলধারার লেখক-পাঠকদের স্বীকৃতি না পেলে যে অতৃপ্তি কোনোদিন দূর হয় না।
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারা কোনটি? উত্তর খুব স্পষ্ট। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে নির্ধারিত হয়ে গেছে যে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, জাতীয়তাবাদকে ধারণ করেও আন্তর্জাতিক চেতনা লালনকারী, দেশের বঞ্চিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো, বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তিকামী ধারাটিই আমাদের সাহিত্যের মূলধারা। এই ধারার মধ্যে অনেক ছদ্মবেশি সুবিধাবাদী আছে, অনেক আপোসকামী আছে, কিন্তু ধারাটি মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে। এই সময়টা বাংলাসাহিত্যের জন্য খুবই বিভ্রান্তির সময়। প্রগতির বিপক্ষে কারা কারা আছে তাদের আমরা চিনতে পারি। চিনি। কিন্তু সমস্যা তৈরি করেছে বর্তমানের সরকারি কবি-লেখকরা। যে কেউ মুখে নৌকা মার্কার পক্ষে কথা বললেই তাকে প্রগতিশীল বলে তকমা দেয়ার জন্য মঞ্চ তৈরি।
কিন্তু প্রগতিশীলতা তো এত ছোট বা স্থূল জিনিস নয়। একটা ঘটনা বা লেখা দিয়ে কেউ প্রগতিশীল হয়ে যায় না। এই মুখোশপরা সময়ে প্রগতিশীলকে প্রগতিশীলতার পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিটি দিন। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক