
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫৭
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০১৯
পিছিয়ে পড়া সমাজে যুদ্ধ অনেক রকম। যুদ্ধ অনেক সেক্টরে। অনেক ফ্রন্টে। একজন মানুষ সচেতন হলেই যে সব সেক্টরের যুদ্ধে শামিল হতে পারবে, এমন কোনো কথা নেই। নিজের নিজের ক্ষেত্রে যোদ্ধার ভূমিকায় অবিচল থাকলে অন্য সব সেক্টরেই তার ইতিবাচক এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। অতীতে তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কাজেই একটি আন্দোলনে কেউ একজন অংশগ্রহণ করেনি বলেই তার অন্য সব আন্দোলন-অবদান অস্বীকার করতে হবে, এমন ধারণা ঠিক নয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে তিনি মানবতা এবং স্বদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন কিনা।
জীবনপঞ্জিতে দেখা যাচ্ছে, ১৮৫৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ধমান, হুগলী, মেদিনীপুর ও নদীয়ায় ৯টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। আবার সেই বছরই সংস্কৃত কলেজের ১৫০ টাকা বেতনের অধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি চাইছেন। উল্লেখ্য, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে পুরো ভারতবর্ষ ছিল উত্তাল। ব্রিটিশরা এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ আখ্যা দিলেও কার্ল মার্কস বলেছেন ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’। কারণ সিপাহীরা বিদ্রোহের সূচনা করলেও দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর থেকে ভারতবর্ষের সকল স্তরের সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কী ভূমিকা ছিল তা আলাদা করে জানা যায়নি। রাজনীতি থেকে তার অবস্থান সবসময় ছিল দূরে। তবে একথা ঠিক যে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার শিক্ষিত সমাজ, বুদ্ধিজীবী, রাজা-জমিদার, সংবাদপত্র— প্রায় সবাই এই বিদ্রোহের বিপক্ষে ছিলেন, এবং ব্রিটিশদেরকে বিদ্রোহ দমনে নৈতিক, অর্থনৈতিক সবধরনের সহযোগিতা করেছেন। আলীগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ এবং ঢাকার নবাবরাও সরাসরি ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘরের শত্রু বিভীষণ কলকাতার বাবুদের ঐ সময়ের কাণ্ডকীর্তি নিয়ে কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাচার নকশা’তে মজাদার সব ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
তবে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে এবং বিদ্রোহের নিন্দা করে যেসব বিবৃতি সেইসময় প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। আসলে তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আলাদা। সেগুলোর কথা আমরা জানি। যেমন বিধবা বিবাহ, শিক্ষাবিস্তার, নারীশিক্ষা, সামাজিক কুসংস্কার, পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্য করা ইত্যাদি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ইংরেজদের কাছ থেকেও সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। ধূতি-চাদর-চটিজুতা ছাড়া অন্য পোশাকে তাকে দেখা যায়নি। পদক নেবার জন্য রাজভবনে যেতে হলে সুনির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে বলে তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। পরের দিন দুইজন সরকারি কর্মচারি তার বাড়িতে পদক পৌঁছে দিতে এলে বলেছিলেন— পদকটা বেনের দোকানে বিক্রি করে টাকাটা দুইজনে ভাগ করে নাও।
বিধবা বিবাহ চালু করার সপক্ষে যে আবেদনপত্র ইংরেজ সরকারের কাছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পাঠিয়েছিলেন তাতে সর্বসাকুল্যে স্বাক্ষর করেছিলেন ৯৮৭ জন। অপরদিকে রাধকান্ত দেবের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহের বিপক্ষে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ৩৬৭৬৩ ব্যক্তি। তবু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা বিধবা বিবাহের পক্ষে যে আইনটি পাশ হয়েছিল তার পেছনে ছিল হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের সমর্থিত শ্লোক। সেই শ্লোক অনুযায়ী যেহেতু হিন্দুধর্মে বিধবা বিবাহ বৈধ, সেই কারণে ইংরেজরা বিধবা বিবাহের পক্ষেই আইন তৈরি করেছিলেন। তবে বিদ্যাসাগরকে অনেক খুঁজে-পেতে এই বিধানটি বের করতে হয়নি। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকাতে রাজা রাজবল্লভ নিজের কন্যার অকাল বৈধব্যের নিরসনের জন্য বারানসি, মিথিলা থেকে পণ্ডিতদের আনিয়ে নিদান খুঁজেছিলেন। পণ্ডিতরা তখন ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে এই বিধানটির উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে বিধবা বিবাহ হিন্দুধর্মে বৈধ। আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কলকাতাকেন্দ্রিক আন্দোলনের অল্প কিছুদিন আগে ১৮৪৩ সালে নাগপুরের একজন মানবিক ব্যক্তি বিধবা বিবাহের সমর্থনে একটি পুস্তিকা ছাপিয়েছিলেন। তাতেও এই শ্লোকটি উদ্ধৃত ছিল। তবে তাতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা বা গুরুত্ব কিছুমাত্র কমে যায় না। কারণ বিধান থাকা এক জিনিস আর সমাজে তাকে চালু করা আরেক জিনিস। আইন পাশ করিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। যে কোনো বিধবা বিবাহের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার তিনি বহন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অন্তত ৩০টি বিধবা বিবাহের ব্যয়ভার তিনি বহন করেছিলেন। নিজের একমাত্র পুত্র নারায়ণকেও বিধবা বালিকা ভবসুন্দরীর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরিবারের কেউ এই বিয়ে সমর্থন করেনি এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই বিবাহের সকল কর্তব্য সমাধা করেছিলেন। পরবর্তীতে নারায়ণ সেই বধূর সাথে অন্যায় আচরণ করলে তাকে উইলের মাধ্যমে নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বাদ দিয়েছিলেন।
নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। প্রধানত বই লিখে, বই ছেপে এবং বিমা কোম্পানি স্থাপনের মাধ্যমে। তার মৃত্যুর আগেই ‘বর্ণ পরিচয় ১ম ভাগ’ বইটির সংস্করণ হয়েছিল ১৫২টি। মোট বই ছাপা হয়েছিল ৩৩,৬০,০০০। ‘বর্ণ পরিচয় ২য় ভাগ’-এর সংস্করণ হয়েছিল ১৪০টি। ছাপা হয়েছিল ১৫,৯০,০০০ কপি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাকে ব্যঙ্গ করে ‘প্রাইমারি পাঠ্যপুস্তক লেখক’ বলতেন। ‘সীতার বনবাস’ বা অন্য চমৎকার রচনাগুলিকেও বঙ্কিম কোনো সাহিত্যমূল্য দিতে চাইতেন না। দুজনের সম্পর্কের তিক্ততা এতই বেড়েছিল যে বিদ্যাসাগরের চটি একবার জলে ভিজে কিছুটা বাঁকা হয়ে গেলে তিনি সেটি দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার চটিকে জলে ভেজালে বঙ্কিম হয়।
এত টাকা উপার্জন করলেও অকাতর দান-ধ্যানের জন্য এক পর্যায়ে তার ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়ে যায়। সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হলে তার ভক্ত-সুহৃদরা টাকা পাঠাতে শুরু করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এতে ক্ষুব্ধ হন। বলেন যে তাকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। তিনি নিজেই সব ঋণ শোধ করবেন। করেছিলেনও। এবং আরো বেশি টাকা উপার্জিত হয়েছিল তার। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন সবসময়। হিন্দুসমাজের নেতারা তো বটেই, রবীন্দ্রনাথের পিতা ব্রাক্ষ্ম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রচার করেছিলেন যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাস্তিক। এক পর্যায়ে মহর্ষি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্তকে বাদও দিয়েছিলেন। তা নিয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাননি বিদ্যাসাগর। কেউ তাকে কোনোদিন পূজা-অর্চনা করতে দেখেনি। তবে তাকে নাস্তিক বলে প্রচার করার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় ছিল সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচি থেকে বেদান্ত, সাংখ্যদর্শনকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব। বেদান্তকে তিনি ‘ফলস ফিলসফি’ বলতেন। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের মনে যাতে বেদান্ত প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘লজিক’ বইটি তিনি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। একবার শুধু বলেছিলেন, একজন ব্যক্তি নাস্তিক হলে এমন কী ক্ষতি? পুরো ধর্মই তো আছে যা নাস্তিক। যেমন বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম। এই দুই ধর্মেই তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই। (এখন অবশ্য বেশিরভাগ বৌদ্ধ গৌতম বুদ্ধকেই ঈশ্বর বানিয়ে নিয়েছেন)। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নিজে গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়িতে। কিন্তু তার সম্মোহনী আকর্ষণও ধর্মের প্রতি অনুরক্ত করতে পারেনি বিদ্যাসাগরকে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যাসাগরের চাইতে বড় দানবীর ভূ-ভারতে একজনই। তিনি হাজি মুহম্মদ মহসীন। অনেক অপাত্রে দান করেছেন বিদ্যাসাগর। তবে সঠিক ব্যক্তি ও সংস্থাকে দান করার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ নন। ভার্সাই নগরীতে বসেছিলেন কপর্দকশূন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সন্তানের মুখে দুধ তুলে দেবার টাকাও তখন তার নেই। এক বন্ধু বললেন, এভাবে নিশ্চেষ্ট বসে না থেকে তুমি কোনো একটা কাজ করো। মাইকেল নির্বিকার। বললেন, আমি টাকা চেয়ে একজনকে চিঠি লিখেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই টাকা এসে যাবে। তখন কোনো সমস্যা থাকবে না। বন্ধু করুণ হেসে বললেন, আর তো কেউ তোমাকে টাকা দেবে না। এমন কোনো বন্ধু বা পরিচিত জন নেই যার কাছ থেকে তুমি টাকা ধার নাওনি। কিন্তু কোনো ঋণই শোধ করতে পারোনি। আর কেউ তো তোমাকে টাকা দেবে না।
মধুসূদন বললেন, এমন একজনের কাছে আমি টাকা চেয়েছি, যার মস্তিষ্কে আছে প্রাচীন ঋষিদের প্রজ্ঞা, বুকে আছে ইংরেজ সৈনিকের মতো সাহস, আর হৃদয়ে আছে বাঙালি মায়ের মতো সীমাহীন স্নেহ। অতএব আমার টাকা আসবেই। টাকা এসেছিল ঠিকই। পাঠিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বাহিরের অসংখ্য কঠিন যুদ্ধে বিজয়ী বিদ্যাসাগর হেরে গিয়েছিলেন সংসারের স্বজনদের কাছে। পিতা-মাতা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছ থেকে ক্রমাগত কঠিন আঘাত পেয়ে আর সহ্য করতে না পেরে তিনি অসুস্থ শরীরে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন একাকি। সাঁওতালদের মধ্যে কার্মাটার নামক একটি পাণ্ডববর্জিত গ্রামে কাটিয়েছেন জীবনের শেষের দিনগুলি। বিদায়ের সময় মায়ের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোনো বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। এজন্য স্থির করিয়াছি, যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নির্ভতভাবে অতিবাহিত করিব। আপনার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের নিমিত্ত মাস মাস যে ত্রিশ টাকা পাঠাইয়া থাকি যতদিন শরীর ধারণ করিবেন কোনো কারণে তাহার ব্যতিক্রম ঘটিবেক না।’
পিতার কাছে লিখেছিলেন, ‘সাংসারিক বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি। কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে-বিষয়ে কোনো অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায়, সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না, এই প্রাচীন কথা কোনও ক্রমেই অযথা নহে।’
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, সাংসারিক এই ট্রাজেডি আপনার একার নহে। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক