
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৫৮
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০১৯
যদি বলি, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের শতকরা ৯৫ জন অধিবাসী সাম্প্রদায়িক তাহলে ভুল বলা হবে না বোধহয়। (খেয়াল করবেন আমি অধিবাসী বলেছি, মানুষ বলিনি। কারণ সাম্প্রদায়িকরা পুরো মানুষ নয়)। লোকভেদে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার মাত্রায় কম-বেশি আছে। কারো সাম্প্রদায়িকতা সুপ্ত বা কারো প্রকাশ্য। সময়মতো সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা জাগ্রত এবং প্রকাশ্য হয়। যদি ডাটা-তথ্য-উপাত্ত চান, আমি দিতে পারব না। বরং আপনাকেই বলব আপনি জরিপ করে আমার অনুমানকে ভুল প্রমাণ করুন। আমার হিসাবটা জরিপ থেকে আসেনি। এসেছে জীবনের এতগুলো বছর ধরে লক্ষাধিক ব্যক্তি এবং অনেকগুলো গোষ্ঠী, দল, সংগঠন প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে।
রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক জগত থেকে শেখা অনেক আপ্তবাক্যকেই এখন আর আমার কাছে সত্য বলে মনে হয় না। সেইসব আপ্তবাক্যের মধ্যে একটি হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক হয় না। তারা নিরাপত্তার কারণে যুথবদ্ধ হয়। আমার প্রত্যক্ষণ সেকথা বলে না।
বাংলাদেশে যদি অন্য ধর্মের লোকের অনুপস্থিতিতে দশ জন হিন্দুর কথোপকথন শোনেন, অথবা ভারতে যদি দশ জন মুসলমানের একত্রিত আলোচনা শোনেন, তাহলে দেখবেন ভেতরে কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা গোপন করে রাখেন তারা। এইরকম সমসত্ত্ব পরিবেশে সেগুলো অবিরল গরল হিসাবে নির্গত হতে থাকে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রতি। দুর্ভাগ্যক্রমে দুই সম্প্রদায়ের একাধিক গ্রুপের একাধিক আলোচনা শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। (হিন্দু গ্রুপের আলোচনার সময় আমার পরিচয় গোপন ছিল)। এইসব গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজের শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। তারা প্রকাশ্যে নয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িক।
পরিবার থেকে, স্কুল থেকে বেশিরভাগ সন্তানই সাম্প্রদায়িকতা নামক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। ক্লাস টেন বা ইলেভেন ক্লাসে পড়া মেয়ে, যে কখনো কোনো ধর্মকর্ম করে না, সে-ও পর্যন্ত কথায় কথায় তার হিন্দু বান্ধবীর সম্পর্কে বলে ফেলে, মালু তো, খুব সেয়ানা। আবার একই বয়সের হিন্দু ছেলে তার বয়সী মুসলমান ছেলের প্রসঙ্গে আলোচনায় বলে, শালা নেড়ে, মাথামোটা। আমার স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা বলে যে শিক্ষকদের অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক। বিশেষ করে ধর্মশিক্ষকরা। এমনিতে দেখা যাবে তারা মানুষ হিসাবে নিরীহ, মোটামুটি সৎ ও সাদাসিধা জীবন যাপন করেন, কিন্তু ধর্ম প্রসঙ্গ এলেই অন্য ধর্ম এবং অনুসারীদের ইতর শ্রেণির পর্যায়ে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেন না।
আমি ছোটবেলায় পরিবেষ্টিত ছিলাম হিন্দু প্রতিবেশীদের দ্বারা। বাড়ির পেছনে পশ্চিম দিকে আমাদের বড় একটা বাঁশঝাড়। তারপরেই ধোপাপাড়া। তখন রুটির চল ছিল না আমাদের বাড়িতে। বলা হতো রুটি খায় গরিবরা। কিন্তু ধোপাবাড়ির মোহিত কাকা, তার ছেলে-মেয়েরা, (তার মাকে অন্যদের মতো আমিও কত্তামা বলে ডাকতাম) সকাল বেলা চায়ে রুটি চুবিয়ে খাচ্ছে দেখলে আমার ভীষণ লোভ হতো। কাকি আমাকেও চা-রুটি দিতেন। আর বলতেন, তাড়াতাড়ি খা। তোর মা দেখলে আবার রাগ করবি।
একদিন আমার চা-রুটি খাওয়ার পরে জলতেষ্টা পেয়েছিল। আমি বাড়িতে যা করি, সেটাই করেছিলাম। তাদের পেতলের জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়েছিলাম এনামেলের গ্লাসে। সঙ্গে সঙ্গে কত্তামার চিৎকার, হায় হায় জগখান ছুঁয়ে দিলু ছোঁড়া! ঐ জগে আমি তো জল খাতে পারব না। হকচকিয়ে গেছিলাম। এ আবার কেমন কথা! তখন খেয়াল করিনি, তারা যে ধরনের কাপে চা খায় আমাকে দেয় অন্য ধরনের কাপ। কত্তামা সেই জগ নিয়ে আমার মায়ের কাছে এসেছিল। বলেছিল, তোমার ছাওয়াল আমার জগ ছুঁইছে। নষ্ট করে দিছে। এখন আমাক একটা জগ কিনার টাকা দেওয়া লাগবি।
মা টাকা দিয়েছিল। তারপর আমাকে থাপ্পড় মেরে বলেছিল-- হিন্দু ছোটজাতের বাড়িত না খাইলে তোর পেট ভরে না! পাড়ার টাইমকলে পানি আসত সকাল-বিকাল। কলের পাড় বাঁধানো। কোনো হিন্দু সেই পানি নেবার সময় প্লাটফর্মে কোনো মুসলমান পা রাখলে সঙ্গে সঙ্গে ভরা কলস উল্টে পানি ফেলে দিয়ে আবার ভরতে শুরু করত তারা। এটি একসময় তাদের উত্যক্ত করার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের। ওরা পানি ভরে। কলস বা বালতি ভরার সাথে সাথে আমরা আলতো করে পা ছোঁয়াই প্লাটফর্মে। সাথে সাথে গব গব করে পানি ফেলে দিয়ে আবার ভরতে শুরু করে তারা। সেই সাথে গালি ছোটে আমাদের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে নালিশও যায় এক পর্যায়ে। গার্জেনরা আমাদের ধমকও দেয়, আবার ফিক করে হেসেও ফেলে। তারাও উপভোগ করছে ব্যাপারটি। তখন বুঝিনি যে এটি আমাদের দিক থেকে একধরনের হিন্দু নিপীড়ন, আর তাদের দিক থেকে মুসলিম-ঘৃণার ছোট সংস্করণ।
আহমদ ছফার কাছ থেকে শিখেছিলাম-- বাঙালি মুসলমান সাম্প্রদায়িক নয়। তবে মানসিকভাবে অপরিণত। ইমম্যাচিউরড। আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে ছফা ভাইয়ের এই প্রায়-আপ্তবাক্য সঠিক নয়। ইমম্যাচিউরড বলেই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার ঝুঁকি বেশি। কারো জমি হারানোর পেছনে তার ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়াটা সবসময় একমাত্র কারণ নয়।
যেমন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। নাম শুনে তো হিন্দুই মনে হয়। তিনি এবং তার পুত্রের হুমকিতে নিম্নি নামের মেয়েটির হয়ে আইনগত লড়াই-এ নামতে বরগুনার কোনো আইনজীবী সাহস পায়নি। শম্ভু সেখানকার সরকারি দলের এমপি এবং দলের নেতা। কিন্তু তার রাজত্বে যে হিন্দু সাধারণ জনগণ স্বর্গীয় নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বাস করছে, এমনটা নয়। আমাদের নাটোরে হিন্দুর সংখ্যা অন্য এলাকার চাইতে তুলনামূলক বেশি। সেখানেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হয়ে চলে। তাদের জমি-জিরাত হাতছাড়া হয়। কিন্তু শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী বা তার পরিবারের সম্পত্তি বেহাত হয়নি এক বিন্দুও। দেশের কোনো হিন্দু আমলা, হিন্দু সামরিক অফিসার, হিন্দু পুলিশ অফিসারের সম্পত্তি বেহাত হয়নি। তাদের সম্পদ কমে না। বাড়ে। মুসলমান এমপি-দের মতোই হিন্দু এমপি-দের সম্পদ পাঁচ বছরে ত্রিশগুণ-চল্লিশগুণ-শতগুণ বেড়ে যায়।
তার মানে কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্ব নয়, ক্ষমতার সাথে সম্পর্কহীনতাও লোকজনের সম্পত্তি বেহাত হওয়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ক্ষমতাহীনতা একই ভাবে ভোগায় বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিম নর-নারীকে। যে কোনো সরকারি দলের ক্যাডার বা গডফাদার মানুষের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেবার সময় বা লক্ষ-কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে নেবার সময় সধর্মী-বিধর্মীর মধ্যে বাছবিচার করে না। কোনো ব্যবসায়ী ভেজাল মাল বিক্রি করার সময় নিজের ধর্মের লোককে রেয়াত করে না। বাংলাদেশে যেমন, ভারতেও একই অবস্থা।
এইদেশে হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের মনে করা হয় আওয়ামী লীগের বাঁধা মুরগি। হিন্দু মানেই আওয়ামী লীগের ভোটার। কথাটা শতভাগ না হলেও মোটামুটি সত্যি যে সংখ্যালঘুরা মনে করে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের রক্ষাকবচ। ১১ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার। সংখ্যালঘুদের ক্ষতগুলো তো উপশম হবার কথা। কিন্তু তা না হয়ে নতুন নতুন ক্ষত বেড়েই চলেছে। এখানেও কারণ কেবলমাত্র সংখ্যালঘুত্ব নয়। সুশাসনের অনুপস্থিতি। আরো সঠিকভাবে বলা যায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছারই অনুপস্থিতি। নিজের দলের সব ধরনের খাদক, এবং সহায়ক শক্তিগুলোর পেট ভরাবার সুযোগ করে দেওয়াটাই সরকার প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে। আর সরকারের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির সংখ্যা কম নয় তা জরিপ না করেও জানা যায়। আওয়ামী লীগের লোকেরা পাড়ার ক্লাবের ইলেকশনে হারলেও বলে, শালা মালুরা ভোট দেয়নি।
তাছাড়া বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য এবং আবুল বারাকাতের গবেষণাও প্রমাণ করেছে যে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি সবচেয়ে বেশি দখল করেছে আওয়ামী লীগের লোকেরা। অবশ্য সুশাসন জিনিসটা এদেশে কখনোই ছিল না।
তাহলে কোনো হিসাবই যে মিলছে না! কোনো সূত্রায়নই তো সম্ভব হচ্ছে না। এখন একটা প্রশ্ন করি, বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে সত্যিকারের সংখ্যালঘু কারা? আমার উত্তর হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা। অর্থাৎ যারা মানুষ, তারাই বেদনাদায়করূপে সংখ্যালঘু। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক