জাঁ পল সার্ত্র

জাঁ পল সার্ত্র

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৫৯

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ২৩, ২০১৯

অমিয়ভূষণ মজুমদার একজন প্রকাশকের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, বিভিন্ন কারণে তিনি ক্রোধ এবং বিরক্তিতে আচ্ছন্ন। এই অবস্থায় উপন্যাস লিখতে বসা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। তাতে সাহিত্যের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। এখন লিখতে বসলে সাহিত্যিক সততার প্রতি পুরোপুরি অবিচার করার আশঙ্কা থেকে যাবে। লেককের ব্যক্তিগত ক্রোধ এবং হতাশা হয়তো উপন্যাসের কোনো প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।

হায় অমিয়ভূষণ! পরলোক থেকে যদি একবার তাকাতেন আমাদের দিকে! আমাদের সমাজের ও দেশের যা অবস্থা এবং শরীরে-মনে তার যে অভিঘাত, আমাদের তো চিরস্থায়ীভাবে কলম বন্ধ করে রাখার কথা। অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা বলেন, এই রকম সময়েই তো লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের কলম ঝলসে ওঠার কথা। মানুষ তাদের লেখা থেকেই তো উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে। এ কথাতেও যুক্তি আছে। কিন্তু কলমধরা মানুষরা অসহায় বোধ করেন। কারণ তারা গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন যে, লেখালেখি করে কিছুই হয় না। মিডিয়াতে অঘোষিত কড়াকড়ি সেন্সর থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু লেখা তো প্রকাশিত হচ্ছে। বই লেখা হচ্ছে ঝুঁকি নিয়েই। আলোচনা সভা হচ্ছে। কিন্তু কাজে লাগছে না কিছুই।

সরকার এবং ক্ষমতাবানরা সেইসব লেখাকে গণনায় ধরছেন না। আর সাধারণ মানুষ সেইসব লেখা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ছে। আর জনগণ ঘুমিয়ে থাকছে বলে সরকার বা ক্ষমতাবানদের তটস্থ হবার কোনো কারণ ঘটছে না। তারা বলছে দেশে সব ঠিক আছে। সরকারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার জন্য কিছু লোক কেবল সমালোচনাই করে যাচ্ছে। তাদের কথায় কান না দেবার জন্য জনগণকে তারা শুকরিয়া জানাচ্ছেন। এই অবস্থায় লেখালেখি করার মতো মানসিক শক্তি কীভাবে বজায় থাকে? যা কোনো কাজে লাগে না তা উৎপাদন করার দরকারটাই বা কী?

নিজেকে এতটা অসহায়, এতটা বিবশ, এতটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় আগে কখনোই মনে হয়নি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কেবল শক্তির প্রদর্শন আর অপপ্রয়োগ। ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্টরা তাদের ইচ্ছামতো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে যারা নিজেদের সচেতন মানুষ মনে করেন, তারা নির্বিকারভাবে এসব চালিয়ে যেতে দিচ্ছেন। তারা শক্তিহীন বটে। একক ব্যক্তি মানেই শক্তিহীন। কিন্তু একক থেকে সমষ্টিতে পরিণত হবার যে প্রক্রিয়া চালু রাখার চেষ্টা চলে, সেখানেও তাদের অংশগ্রহণ নেই। তারা উল্টো ক্ষমতাশালীর সাথে গাঁটছড়া বাঁধাকেই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সুবিধাজনক মনে করছেন। বিবেকের স্বাধীনতা বিক্রির বিনিময়ে শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজছেন। ট্রাজেডি হচ্ছে, তবুও পাচ্ছেন না। পাওয়ার কথাও নয়। কারণ ভক্ষক যখন বাইরের খাওয়াতে টান পড়ে, তখন নিজের বাঁধা মুরগিগুলোকেই খেতে শুরু করে। এই সময়ের একজন জাতীয় অধ্যাপকের শ্বশুরকুলের সম্পত্তিও নাকি দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাবান ক্যাডাররা। বেচারা পুরোটা জীবন আওয়ামী সরকারের নিঃশর্ত গুণগান গেয়েও রেহাই পাননি।

একই সময়ের ইতিহাসকে দুইভাবে লেখা যায়। এখনকার রোজনামচাও দুইভাবে লেখা সম্ভব। একভাবে লেখা যায় যে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে, দেশকে অনেকটাই ডিজিটালাইজেশন করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি বাস্তবায়ন করেছে ইত্যাদি। আরেকভাবে এসব মেনে নিয়েও লেখা যায় উন্নয়নের সাথে সাথে সরকার ব্যাপকভাবে তার নিজের লোকদের দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছে। এক কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণে যেখানে ১০০ কোটি টাকা যথেষ্ট, সেখানে ৩৩২ টাকা বরাদ্দ করে নিজের ঠিকাদারদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের পথ সুগম করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১২০০ কোটি টাকায় পাওয়া সম্ভব ছিল। সেটি ঠিকাদারের মাধ্যমে কেনা হয়েছে ৩০০০ কোটি টাকায়। দেশে আইনের শাসন নেই। আইন চলে সরকারের কথায়। ৩০ বছর চাকুরি করে রিটায়ারমেন্টের পরে ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সুদ দিয়ে যে অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি নিজের ও স্ত্রীর দিনগত পাপক্ষয়ের ব্যবস্থা করেন, নিজেদের ওষুধ-পত্র কেনেন, সেই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে সরকার তাকে অসহায় বানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে শতকোটি টাকার ঋণখেলাপিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে তার টাকা আত্মসাতের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করছে সরকার। সরকারি প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় ব্যাংক থেকে ৪০০০ কোটি টাকা লোপাট করে দিচ্ছে একজনমাত্র ব্যক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে। অথচ কর্তব্যে অবহেলার জন্য কারো শাস্তির উদ্যোগ নেই। ধর্ষণ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। অথচ সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে ধর্ষণকারী জামিন পেয়ে যাচ্ছে।

এই রকম পরিস্থিতিতে মানুষ বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা যে হারাবে তা বুঝতে বুদ্ধিজীবী হবার দরকার পড়ে না। অসহায় ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। সেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ নারী ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের পিটিয়ে মারার মধ্য দিয়ে। বুদ্ধিজীবীদের দায়ী করার প্রবণতা দেখতে পাই আমরা। যারা দায়ী করেন তারা হয়েতো খেয়াল করেন না বুদ্ধিজীবী-কবি-লেখকের সংখ্যা সরকারি দলেরই বেশি। তারা সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে শানিত প্রতিবাদ জানাবেন, এমনটি আশা করা বোকামি। তাছাড়া এখনো এটাও নির্ধারণ করতে পারিনি যে বুদ্ধিজীবী আমরা কাকে বলব। গতকাল একটা বই পড়ছিলাম। ভুঁইয়া সফিকুল ইসলামের ‘একটি ভ্রমণের বেদনা’। সেখানেই পেলাম ঘটনাটি।

স্বাধীনতার পরে ফ্রান্স থেকে একদল শিক্ষাবিদ এসেছিলেন বাংলাদেশে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন তারা। সেখানে তখনকার প্রভাবশালী শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় চলছে তাদের। শুরুতে পরিচয়পর্ব। রাবি শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন একজন। প্রত্যেকে কোন বিভাগে শিক্ষকতা করেন, তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বলার পরে যোগ করা হচ্ছে, ইনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। ফ্রান্সের শিক্ষাবিদ প্রতিনিধি দলের নেতা বললেন, কী সৌভাগ্য বাংলাদেশের মানুষের। এই মফস্বল শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত এত এত বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। অথচ আমাদের পুরো ফ্রান্সে রয়েছেন মাত্র একজন বুদ্ধিজীবী। তার নাম জাঁ পল সার্ত্রে। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক