বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬১

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০১৯

মূর্খ বালকের মতো মাঝে মাঝে বলে ফেলেছি, রাজা তুমি তো ন্যাংটা! তোমার কাপড় কোথায়?
মনে মনে নিজেকেও বলেছি, যেসব প্রশ্ন তোমার মনেও জাগার কথা অনেক আগে সেগুলো কেন এত দেরিতে এলো? প্রচলিত চিন্তার দাসত্ব এভাবে তোমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে!
আবার নিজের হয়ে বলি, আমি তো ঐশীবাণীপ্রাপ্ত নই। আমাদের মতো মানুষদের রাখা হয় আলো-আঁধারিতে। শেখানো হয়েছে সত্যের বেশি কাছে যেতে নেই। কারণ সত্য সহস্র সূর্যের চাইতেও অগ্নিময়। যে সত্যের কাছে যেতে চায় তাকেই অঙ্গার হয়ে যেতে হয় সহস্র সূর্যের আগুনে। তাই আমরা জানালা খুলে উঁকি দিতেও ভয় পাই।

বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি মহাভুল। কিন্তু সেই ভুলের উপরই দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি বিদ্বৎ-সমাজ, আইনব্যবস্থা, সামাজিক স্তরসমূহ, জমিদার-ধনীদের ধনগৌরবের পাশাপাশি তাদের সমাজ উন্নয়ন কর্মসূচি(!), সবকিছু। এখন সেই ভ্রম সংশোধন করতে গেলে মহা বিশৃঙ্খলার ভয়। সোজা ভাষায় বিপ্লবের ভয়। আর বঙ্কিমচন্দ্রের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘আমরা সমাজ বিপ্লবের অনুমোদক নহি।’

এই যুগেও যেসব ঐতিহাসিক ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শাসকসমাজ ও বিদ্বৎ-সমাজ, সেই ভুলগুলোর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতেও মানুষের ভয়। আমাদের দেশ দরিদ্র। জাতি দরিদ্র। তবে সবচাইতে বেশি দরিদ্র চিন্তার দিক থেকে। চিন্তার দারিদ্র্যই আমাদের সকল দারিদ্র্যের জননী। আবার চিন্তার দারিদ্র্যের কারণেই আমরা অন্য দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম নই। আমরা নিজের ও পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর চিন্তা করতে ভয় পাই। প্রবাদ তৈরি করে নিয়েছি, ‘আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খোঁজ রাখার দরকার নাই’। কিন্তু সেই জাহাজে তুলে বিদেশে পাচার করা হয় যখন আমাদের আদাবেচার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা সম্পদ, তখন তো জাহাজের খবর না নিয়ে উপায় থাকে না।

সেই কথাটা মনে করিয়ে দেবে কে? শুনবেই বা কে? আর শোনার পরে জাহাজ ঠেকাতে যাবে কে? কৃষ্ণ আফ্রিকার বিপ্লবী কবি ও রাষ্ট্রনেতা উইলিয়াম লিওপোল্ড সেঙ্ঘর বলেছিলেন, খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে কিছু মানুষকে। সেই মানুষরা বিশ্বাস করে না খাঁচা ভাঙার শক্তি রয়েছে তাদের। তাই তারা খাঁচার মধ্যে ঘুমিয়ে কাটায়। বন্দিত্বের বেদনা ঘুমের মাধ্যমে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু তারা যদি বিশ্বাস করত যে খাঁচা ভাঙার ক্ষমতা তাদের সম্মিলিত শক্তির রয়েছে, তাহলে ঠিকই খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারত তারা। তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করে।

আমরাও অপেক্ষা করি ত্রাণকর্তার আগমনের। ক্ষমতার বলয়ের কিছু ব্যক্তি ছাড়া এই দেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ বঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার। শ্বাসরোধী জীবন যাপন করতে হয় সবার। নিরাপত্তাহীনতার বোধ সবসময় তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। ব্যক্তি শেখ মুজিব বা ব্যক্তি শেখ হাসিনা এখানে বিবেচ্য নয়। তারা নষ্ট সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালক বটে, কিন্তু নিজেরাও বন্দিই। বন্দি সিস্টেমের কাছে। তাই তাদেরও মেনে নিতে হয় প্রতিবছর ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারীদের দৌরাত্ম, ঋণখেলাপিদের আস্ফালন, শেয়ার বাজারে ডাকাতি করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে বসানোর ঘটনা। মেনে নিতে হয় তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করার সৎসাহসের অভাব। শুধু তাই-ই নয়, এই পাশে বসিয়ে ক্ষমতার অংশ দিয়ে চলতে হয় তাদের।

ভুঁইয়া সফিকুল ইসলামের ‘একটি ভ্রমণের বেদনা’ বইটি কয়েকদিন ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। প্রশাসনের উচ্চপদে থাকার সুবাদে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন এইসব গণশত্রুদের প্রভাব ও ক্ষমতা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আরববিশ্ব যেহেতু স্বীকৃতি দেয়নি আমাদের, তাই উচ্চমূল্যে তেল কিনতে হতো সুইজারল্যান্ডের মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় একজন উচ্চপদস্থ আমলাকে পাঠানো হলো সুইডিশ তেল কোম্পানির কাছে। বলা হলো, দুর্ভিক্ষে আমাদের দেশে মানুষ মারা যাচ্ছে। লঙ্গরখানা খুলতে হচ্ছে। কিন্তু আরো লঙ্গরখানা খোলা দরকার। তোমরা দয়া করে তেলের দাম কমাও।

সুইডিশ কর্তৃপক্ষ জানাল যে, আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যবসার নীতি অনুযায়ী আমরা তেলের দাম অফিসিয়ালি কমাতে পারব না। তবে আমরা প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য থেকে দুই ডলার করে দেব তোমাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ এবং লঙ্গরখানার জন্য। তোমরা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেই নম্বরটা আমাদের দাও। সেই কর্মকর্তা সরকারকে না জানিয়ে নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। সেই অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছিল লঙ্গরখানার জন্য দেওয়া সাহায্য। সেই টাকায় উক্ত কর্মকর্তা ঢাকা এবং সাভারে একরের পর একর জমি-জায়গা কিনেছিল, বাড়ি কিনেছিল একাধিক। এক বছর পরে সেই চুরি ধরা পড়লে শেখ মুজিব কেঁদে ফেলেছিলেন। তিনি কাকে বিশ্বাস করবেন! তার বিশ্বাসভাজন কর্মকর্তা লঙ্গরখানার রুটি চুরি করে খায়, বাড়ি-গাড়ি-জমির মালিক হয় সেই টাকায়!

আমাদের খুব দুঃখ লাগবে নিশ্চয়ই এই ঘটনাটি জেনে। কিন্তু দুঃখের কাহিনী শেষ হয়নি। উক্ত ব্যক্তি এখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন এবং ক্ষমতাশালী জীবন যাপন করছেন। বুদ্ধিমান-জ্ঞানী-শিক্ষিত-সচেতন বলে পরিচিত মানুষরা যখন তর্ক করেন হাসিনা না খালেদা, তখন শুনে আমার অতি দুঃখে হাসি পায়। হায়রে সচেতন জ্ঞানী মানুষের দল। এখনো চিন্তার দৌড় এই পর্যন্তই। তাদের চিন্তায় এই কথাটি আসেই না যে, ব্যক্তি নয়, পাল্টাতে হবে সিস্টেম। আর মনে রাখতে হবে যে, কোনো ত্রাণকর্তা আসবে না। কোনো ব্যক্তি ত্রাণকর্তা হয়ে এসে জেগে ওঠার ডাক দেবে না।

আমাদের মানসিক এবং চিন্তার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে আমাদেরকেই। তখন সিস্টেম বদলের আন্দোলন এমনিতেই দানা বেঁধে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের করার পাশাপাশি নিজেদের স্বাধীনতার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য বারংবার আবেদন জানিয়েছেন। সেই আহ্বান বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমরা অনেকবার স্বাধীনতাযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের সংগ্রাম করলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে এদেশের মানুষ। আন্দোলন-সংগ্রাম আবারও হবে। কিন্তু যদি আমরা নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে না পারি, যদি চিন্তার দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারি, যদি চিন্তাজগতের বিস্তার না ঘটাতে পারি, তাহলে আবারও পরাজিত হবে দেশের মানুষ।

কোনো বুদ্ধিজীবীর দিকে তাকানোর দরকার নেই। দরকার নিজের অন্তরাত্মার দিকে তাকানো। দরকার নিজের উদ্যোগে নিজের বোধের বিকাশ ঘটানো। আর দরকার সেই বোধ সন্নিহিত মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ। (কথাগুলো তেমন প্রায়োগিক মনে হচ্ছে না। কীভাবে আমরা অগ্রসর হবো? সারাদেশে স্থানীয় উদ্যোগে পাঠচক্র গড়ে তোলাটা হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।) চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক