
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৬২
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০১৯
১৯৩০ এর দশকে দুজন মহামনীষী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো টিকবে না। দুজনের একজন সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের পর্যায়ে পৌঁছানোর মতো উন্নত মানসিকতার অধিকারী মানবজাতি এখনো হয়ে ওঠেনি। ব্যক্তিমালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় পৌঁছানোর প্র্যাকটিস করতে মানবজাতি এখনো প্রস্তুত নয়। অন্যজন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ছাঁচে ঢেলে মানুষ তৈরির প্রক্রিয়া কখনোই টেকসই হয় না।
মার্কস সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপরেখা দিয়ে যেতে পারেননি। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যে মানুষটি সারাজীবন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য যাকে সেইসময় সবচাইতে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে, এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আরেক দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে, যাকে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে (মৃত্যু হয়েছে ইংলন্ডে, কিন্তু তখনো তিনি ইংলন্ডের নাগরিকত্ব পাননি, এদিকে প্রুশিয়া (জার্মানি) তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছিল, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্স তাকে বহিষ্কার করেছিল), তিনি নিশ্চয়ই এমন কোনো রাষ্ট্রনির্মাণের কথা ভাবতে পারেন না, যেখানে মানুষ মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবে।
১৯১৭ সালে বিপ্লবের পরে লেনিনের সাথে রোজা লুক্সেমবুর্গের এই নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। রোজা বলেছিলেন, অন্তত মেনশেভিকদের পত্রিকা বা তাদের কণ্ঠরোধ করা উচিত হবে না। ম্যাক্সিম গোর্কি সম্পাদিত পত্রিকাটিও লেনিন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেখানে বছরখানেক ধরে প্রতিসংখ্যায় গোর্কি লেনিনের লালসন্ত্রাস, ভিন্নমতকে রার্ষ্ট্রয় নিপীড়নের দ্বারা বন্ধ করা, দ্রুত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান— এসব নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তবে গোর্কিকে এজন্য শাস্তি পেতে হয়নি। কারণ লেনিন ও স্তালিন দুজনেই গোর্কিকে মহান লেখক মনে করতেন। তাছাড়া দেশে এবং বিদেশে গোর্কির জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে তাকে ঘাটানোর সাহসও কেউ পায়নি।
লেনিনের পক্ষেও যুক্তি ছিল। সদ্য সংঘটিত বিপ্লবকে রক্ষা করার যুক্তি। যেখানে বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য ১৪টি দেশ অঘোষিতভাবে লেলিয়ে দিয়েছিল তাদের সৈন্যদের, দেশের ভেতর প্রতিবিপ্লবীচক্র অবিরত সশস্ত্র সংঘাত এবং ধ্বংসলীলা চালাচ্ছিল, পার্টির নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীরা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছিল, এক পর্যায়ে গুপ্তঘাতকের বুলেটে খোদ লেনিনরেও প্রাণসংশয় হয়েছিল, সেখানে লেনিন ও কমিউনিস্ট বলশেভিক পার্টির হাত গুটিয়ে বসে থাকার উপায় ছিল না। লেনিন বলেছিলেন, এই অবস্থা সাময়িক। বিপ্লবকে সুসংহত করার পরে তিনি দরজা খুলে দেবেন। যাকে আমরা গণতন্ত্র বলি, সেই পুঁজিবাদী লোকদেখানো ভোটের গণতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সত্যিকারের ও সব সেক্টরের মানুষদের মতামত প্রতিনিয়ত যাতে প্রতিফলিত হতে পারে এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের রূপরেখার প্রণয়ন তিনি শুরু করেছিলেন।
স্তালিন ক্ষমতায় আসার পরে লেনিনের এই রূপরেখা ধরে অগ্রসর হননি সত্য, তবে তিনি পার্টির মধ্যে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অবারিত রেখেছিলেন। ট্রটস্কির দাবি অনুযায়ী পার্টির মধ্যে উপদল গঠনের অধিকারের প্রস্তাব কংগ্রেসে বাতিল হলেও ট্রটস্কি নিজের কথাগুলো তথা ভিন্নমতগুলো উত্থাপন করে যেতেন পার্টির সভাতে এবং বাইরের জনসমাবেশেও। ভারতবর্ষের সবচেয়ে সোচ্চার ট্রটস্কিপন্থী সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুরের ‘যাত্রী’ বইটিতে এর সত্যতা মিলবে। ‘যাত্রী’ বইটিতে আরেকটি অপপ্রচারের উত্তর মিলবে। তা হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্ম নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ। ধর্মকে কখনোই রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ও বন্ধ করা হয়নি। তবে সেগুলোতে রাষ্ট্রীয় সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মৌলভী-পাদ্রিদের রাষ্ট্রীয় ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ধর্মীয় উৎসবের দিন সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছিল। তবে ধর্মপালনকারীরা ঔচ্ছিক বা নৈমিত্তিক ছুটি নিতে পারত। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর মস্কোর গির্জাতে মানুষের সমাবেশ দেখেছেন, গ্রামে গিয়ে সেখানেও রবিবারে গির্জাতে মানুষকে যেতে দেখেছেন। তবে তরুণ-তরুণীরা কম যেত। এখনো আমেরিকা বা ইউরোপে এই ধারাই অনেকটা বলবৎ আছে। গির্জা চালায় স্থানীয় ধার্মিকদের কমিটি। তারা ব্যয় নির্বাহ করতে না পারলে সেটি বিক্রি করে দেয়। সেখানে সিনেমা হল বা ক্লাব গড়ে ওঠে। তা নিয়ে কোনোদিন আন্দোলন হয়েছে বলে শুনিনি। কানাডাতে নিজেই দেখেছি ঈদের দিন সরকারি ছুটি থাকে না। মুসলমানরা সকালে ঈদের নামাজ পড়ে কাজে চলে যায়। বিকালে বা সন্ধ্যায় নিজেদের কমিউনিটিতে মিলিত হয়। খাওয়া-দাওয়া করে। তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ দেখিনি।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলে কিছু সুবিধা পাওয়া যেত, সেই কারণেই অনেকে ধর্মীয় আনুগত্যের ও আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখত। তবে আশির দশকে রমজান মাসে মস্কোতে সফরে যাওয়া আমাদের একজন লেখকের অ্যালবামে রাতে সেখানকার একটি পরিবারের সাথে সেহরি খাওয়ার ফটো আমি দেখেছি। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের মতামতের প্রতিফলন সমৃদ্ধ যে উন্নত গণতন্ত্রের স্বপ্ন লেনিন দেখেছিলেন, তা কোনোদিনও বাস্তবায়িত হয়নি। তার পেছনে পার্টি নেতৃত্বের পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। স্তালিন অন্তত একটি ব্যাপারে ট্রটস্কির সাথে একমত ছিলেন। আমলাতন্ত্রের ব্যাপারে। এই আমলাতন্ত্র ভাঙার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন স্তালিন। জীবনের শেষ চার বছর নামেই ক্ষমতায় ছিলেন স্তালিন। আসলে গৃহবন্দি ছিলেন এই আমলাতন্ত্রের দ্বারা। পরবর্তীতে ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভের পার্টিক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পেছনে মূল শক্তি ছিল এই আমলাতন্ত্রই।
তবে সবকিছুর পরেও এটাই বাস্তব যে সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত মডেল টেকেনি। এই মডেল আর কখনো ফিরবে বলেও মনে করেন না কোনো দেশের বামপন্থীরাই। সেইসাথে এই কথাটাও বলে রাখি, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নিজের দেশের মানুষ এবং বাইরের দেশের মানুষের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছে, যুগান্তকার ভূমিকা পালন করেছে, আবার খারাপ ঘটনাও অনেক ঘটিয়েছে। সবমিলিয়ে এটি বিশ্ব ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রাখবে আরো মত শত বছর। কেউ ভালোটা বেশি উল্লেখ করবে, কেউ খারাপটা বেশি উল্লেখ করবে।
পাশের নেপালই তার উদাহরণ। নেপালের কমিউনিস্টরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেন। তারপরেও সব দলকে সাথে নিয়ে নির্বাচন হলো। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট দলগুলো। তারপরেও তারা সোভিয়েত বা চীনা পথ অনুসরণ করলেন না। দরজা বন্ধ করে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পথে গেলেন না। বরং জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়েছেন। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র ছিল নেপাল। সেই সাম্প্রদায়িক পরিচয় থেকে তারা সংবিধানকে মুক্ত করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন ধর্মনিরপেক্ষতা। নেপালের সকল অঞ্চলের অধিবাসীর জন্য সমান উন্নয়ন-সুযোগ নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞা সংযুক্ত হলো সংবিধানে। তরাই অঞ্চল সংলগ্ন অধিবাসীদের কিছু অবৈধ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ভারত অঘোষিত অবরোধ পরিচালনা করল নেপালের বিরুদ্ধে। বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল ভারতের সঙ্গে। তাই পেট্রল, ভোগ্যপণ্য নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। সেই কারণে অনেক অসুবিধা ভোগ করেছে নেপারের জনগণ। কিন্তু নতিস্বীকার করেনি ভারতের চাপের কাছে।
তারা কোনো মালিকের কাছ থেকে ব্যবসা-বীমা-ব্যাঙ্ক-কারখানা কেড়ে নিয়ে জাতীয়করণ করেনি। তবে সেগুলো যেন অব্যাহতভাবে মানুষের পকেট থেকে অতিরিক্ত পয়সা খসাতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিয়েছে। পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা সঠিক জানি না। তবে বাংলাদেশের মতো যে নয়, তা অবশ্যই বলা যায়। বাংলাদেশে সরকারগুলো পুঁজিপতিদের অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে এই লুণ্ঠন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রের প্রধানরা, এবং তাদের তাত্ত্বিকরা এই লুটপাটকে সমর্থন করে বলেন যে, এটা হচ্ছে প্রাইমারি অ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল। প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করার জন্য ইউরোপ বিভিন্ন দেশে লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের দেশের পুঁজিপতিরা বাইরের দেশ লুটের ক্ষমতা রাখে না। তাই নিজের দেশকে লুটের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এত জঘন্য কথাকেও ভালো কথা বলেই মেনে নিতাম যদি অন্তত সেই লুটপাটকৃত সম্পদ দেশে বিনিযোগ হতো। তাতে ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে কিছু লোকের অন্তত কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু তা না হয়ে লুটপাটকৃত টাকা সব চলে যাচ্ছে সুইস ব্যাংকে, সেকেন্ড হোমে, বেগম পাড়ায়। বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা যদি বিদেশেই পাচার হয়ে যায়, তাহলে দেশে উন্নয়নটা হবে কোত্থেকে? উন্নয়নের সলিম বুঝ দিয়ে যে এখনো চলা যাচ্ছে তার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ চূড়ান্ত মাত্রায় অসচেতন এবং আত্মকেন্দ্রিক। আর যারা এসব একটু-আধটু বোঝে তাদের মুখের সাইজ অনুযায়ী হাড্ডি ছুঁড়ে দেওয়া হয়। জনগণের অন্য যে ক্ষুদ্র অংশটি এই লুটপাটের চেহারা তুলে ধরে প্রতিকার চায়, জনগণ তাদের কথা শুনতে পায় না।
অতএব এমনটাই চলবে আরো অনেক বছর। তাহারা ব্যস্ত থাকুক হাড্ডি লইয়া। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক