রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০১৯

এই দেশের কিছু মানুষ খুব গর্বের সাথে পরিচয় দেয়, আমার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন আরব-ইরান-তুরান থেকে। আমরা এই দেশের আদি বাসিন্দা নই। আমার সামনে পড়লে জিগ্যেস করি, আপনার পূর্বপুরুষ কেন এসেছিলেন নিজের দেশ ছেড়ে এই দেশে?

বেশিরভাগই হকচকিয়ে যায়। খুব পরিষ্কার করে বলতে পারে না। তবে দুইটি উত্তর বেশি পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে, আরেকটি হচ্ছে রাজকর্ম করতে। আমি আবার প্রশ্ন করি, বাংলাদেশ থেকে মানুষ দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে কেন? উত্তর আসে, উন্নত জীবনের সন্ধানে। আমি বলি, ঠিক একই কারণে আপনাদের পূর্বপুরুষ এসেছিল এই দেশে। নিজের দেশে যে মানুষ ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা পায়, নিরাপত্তা পায়, জীবনে উন্নতির সম্ভাবনা পায়, সে কখনোই দেশত্যাগ করে না।

আমার কথায় খুব মাইন্ড করেন তারা। কিন্তু আমি আমার বক্তব্য থেকে সরি না। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বেশকিছু ইসলামি ব্যক্তিত্ব এইদেশে এসেছেন সত্য। তাদের সঠিক সংখ্যা ঠিক কত ছিল তা জানা যায় না। তবে একথা ঠিক যে, সংখ্যাটি অনেক নয়। বড়জোর হাজারখানেক। নবির কোনো প্রত্যক্ষ সাহাবি এদেশে এসেছেন বলে প্রমাণ নেই। তাবে-তাবেঈনের নামও পাওয়া যায় না। যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই আউলিয়া এবং আউলিয়াদের খলিফা। তারা এখানে এসে বিয়ে-থা করেছেন। অনেকের বংশধররা বংশলতিকা রক্ষা করেছে। অনেকের বংশধর করেনি।

এর বাইরে যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশই ভারতে সাতশো বছরের মুসলিম শাসনামলে এসেছেন উন্নত জীবনের সন্ধানে। মুসলমান হিসাবে মুসলমান সাম্রাজ্যে চাকরি-বাকরির আশায়। যারা সরাসরি সৈনিক হিসাবে এসেছিলেন ইখতিয়ারউদ্দিন খিলজির সাথে, পাঠান শাসকদের সাথে, বাবুরের সাথে, তারাও এদেশেই বিয়ে-শাদি করে সংসারধর্ম পালন করেছেন।

কিন্তু যারা পরবর্তীতে এসেছেন, তারা সবাই এসেছেন ভাগ্যান্বেষণে। নিজের দেশে গরিব ছিলেন। ভারতবর্ষে এলে একটা হিল্লে হবে, এই আশাতে। আর বাংলায় এসেছেন আরো কম। এই দেশে এসে অধিকাংশই আশ্রয় নিতেন বাদশাহ-নবাব-মনসবদারদের আস্তাবলে। সেখান থেকে সমভাষার জাতিভাইদের ধরে কাজ জুটিয়ে নিতেন কোনো একটা। তুর্কী, ফারসি, উর্দু, পশতুভাষীরা সাহায্য নিতেন একই ভাষার পুরনো অধিবাসীদের। সেখান থেকে ধাপে ধাপে উন্নতি হতো কারো। আর বেশিরভাগই কোনোরকমে দিন গুজরান করতেন। তারা চাষের কাজ জানতেন না, ব্যবসাও জানতেন না, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন এমন কোনো কাজই জানতেন না। কাজেই হয় সরকারি চাকরি অথবা কোনো আমির-ওমরার অধীনে কাজ জুটিয়ে দিনাতিপাত করতেন। মহলের দারোয়ান-নোকর-খিদমতগার হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সপরিবারে যারা এসেছিলেন, তাদের ভাগ্যের শিকে কখনো কখনো ছিঁড়ত সুন্দরী কন্যার গুণে। সুন্দরীর দিকে আমিরের নজর পড়লে দারোয়ান হয়ে যেতেন শ্বশুর।

যে তাজমহলের নাম হয়েছে মমতাজ মহলের নাম থেকে, তার জন্ম হয়েছিল ভারতে আসার পথে রাস্তার ধারে গাছের সাথে বাঁধা সাধারণ কাপড়ের তাঁবুতে। দেশ থেকে তার বাবা আসফ খান যখন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ভারতের পথে রওনা দেন বিরাট পরিবার নিয়ে, তাদের বাহন ছিল একটিমাত্র গাধা। সেই গাধার পিঠে চলতেন মমতাজের মা। বাকি সবাই পায়ে হেঁটে। আসফ খাঁ লেখাপড়া জানা বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। প্রথমে ছোট কাজ জুটলেও নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরিচয়, বুদ্ধিমত্তা এবং কন্যাদের রূপের সূত্রে দিল্লীর সম্রাটের দরবারে অমাত্যের পদ অর্জন করেছিলেন।

এই দেশে ঢাকাইয়া কুট্টিরাও নিজেদের বাঙালি নয়, অন্য দেশ থেকে আসা বহিরাগত হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করত। সৈয়দ মুজতবা আলীর ধারণা, এরা আসলে ছিল নবাব-মনসবদারদের আস্তাবলরক্ষক, বাবুর্চি। কেউ কেউ ছিল অশ্বারোহী সৈনিকও। ইংরেজ আমলে নবাবি সৈন্যদের চাকরি চলে যায়। কুট্টিরাও বেকার হয়ে পড়ে। ঢাকার নবাব পরিবারের বিভিন্ন কাজকর্ম করত তারা। পরে চলে যায় ছোটখাট স্বাধীন পেশায়। তো এই হচ্ছে মোটাদাগে আমাদের গর্বিত মুসলমান বন্ধুদের বিদেশি পূর্বপুরুষদের কথা।

এই দেশের সাধারণ মানুষ বহিরাগতদের অন্ন জুগিয়েছে, আশ্রয় জুগিয়েছে, বিলাসের উপকরণ জুগিয়েছে, বিনিময়ে পেয়েছে ‘আতরাফ’ (অনভিজাত) মুসলমানের খেতাব। বিদেশ থেকে এইদেশে ভাত-কাপড়ের সংস্থানের জন্য যারা এসেছে, তারা ‘আশরাফ’ বা অভিজাত। কী অদ্ভুত প্যারাডক্স? এখন যারা একদেশ থেকে মাইগ্রেট করে অন্যদেশে, তারা সেদেশে তৃতীয় বা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। নিজের দেশে খেতে পায় না বলে অন্য দেশে গেছে। আর আমাদের দেশে যারা এসেছে খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়-ভাগ্য পরিবর্তনে সন্ধানে, তারাই আশরাফ বা অভিজাত। এদেশের কৃষক এবং প্রান্তিক মানুষরা প্রান্তিক আতরাফ-ই থেকে গেছে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় বাঙালি মুসলমানের কোনো বাঙালি নেতা ছিল না। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকেরও পারিবারিক ভাষা উর্দু। তারাও আশরাফ গোত্রের। মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলকাতায় বসবাস করতেন, নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতেন, কিন্তু বাংলা বলতেন না। ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফ ছিলেন বাঙালি। কিন্তু তিনি নবাব উপাধি পাওয়ার পরে, কলকাতায় অভিজাত সমাজে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য বাংলার পরিবর্তে পরিবর্তে উর্দু চালু করে দিলেন। এই ‘আশরাফরা’ই সবসময় বাঙালি মুসলমানের মুখপত্রের ভূমিকা পালন করেছেন।

আতরাফ গোত্রের বাঙালিই যে সত্যিকারের বাঙালি, এবং তারা যে উঠে দাঁড়িয়েছে নিজেদের সত্তা নিয়ে, তা প্রথম জানা গেল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়। দুই মহাযুদ্ধের অভিঘাতে পাটের চাহিদা তৈরি হয়েছির বিশ্বব্যাপী। বাঙালি কৃষক পাটবিক্রির টাকায় সন্তানকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর সক্ষমতা অর্জন করল। সেই কৃষকসন্তানরাই শুরু করল ভাষা আন্দোলন। একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশিত হলো হাসান হাফিজুর রহমানের দ্বারা। তিনি যে পারিবারিক জমি বিক্রির টাকায় এই সংকলন প্রকাশ করবেন, এ তো অবধারিতই ছিল। কারণ তখনো কৃষকপুত্রদের হাতে এমন কোনো প্রভাবশালী পদ বা চাকুরি আসেনি যা হাসান হাফিজুর রহমানকে জমি বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে টাকা পাওয়ার পথ দেখাতে পারে।

পাকিস্তান আমলে এইসব আশরাফ গোত্রের মানুষরাই উঁচুপদে চাকুরি পেয়েছে, পার্লামেন্টে গেছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে, মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছে। এবং যদি পরিবার ধরে ধরে খোঁজ নেওয়া যায়, দেখা যাবে, এই আশরাফরা বেশিরভাগই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ অবস্থানে।

আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু শেখ হাসিনার এই আমলে দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপুরুষকেও ইরাক থেকে আগত বলে প্রচার করা হচ্ছে। বাঙালি ‘জাতির জনক’ পরিচয়টা কি তার জন্য যথেষ্ট সম্মানের মনে করছে না তোষামোদকারীরা? চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক