রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৬৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০১৯

এই পর্বের উপশিরোনাম হতে পারে, আমার সামান্য চাওয়া।

একুশ বছর বয়সে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে টাকা এবং নারীর পেছনে ছুটব না। একটি পরিবারকে বিলাসিতাবিহীন অথচ ভদ্রভাবে আত্মসম্মানের সাথে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যতটুকু করা দরকার ততটুকুই উপার্জন করব। বাকি সময় ব্যয় করব জ্ঞানচর্চায়, সমাজকর্মে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। জীবন সেভাবেই চলছে। কখনো সামান্য টানাপোড়েন, কখনো কিছু উদ্বৃত্ত। তবে কোনোটাই চেপে বসেনি।

বয়স এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জেনেছি, নারী এবং সম্পদ ছাড়াও মানুষের আরো অনেক ধরনের লোভ আছে। যশ-খ্যাতির লোভ, ক্ষমতার লোভ, নিজেকে অনন্য হিসাবে দেখানোর লোভ, বিদেশ ভ্রমণের লোভ, পুরস্কারের লোভ, সংবর্ধিত হবার লোভ। লোভের তালিকা বড় হতেই থাকবে। এইসব লোভের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। হচ্ছে।

করি লেখালেখি। কোনোদিন ভাবিনি আমার গল্পসমগ্র বের হবে, মোটা মোটা উপন্যাস বের হবে, উপন্যাস-সংগ্রহ বের হবে। ভাবিনি লেখালেখি থেকে টাকা আসবে। ভাবিনি পুরস্কার পাব। অথচ এসব এসেছে আমার জীবনে। সিনিয়ারদের মধ্যে যাদেরকে প্রকৃত লেখক মনে করি, তারা শিখিয়েছিলেন, লেখালেখিটাই একজন লেখকের কাজ। বাকি সবকিছু— সম্মানি, পুরস্কার, সম্মাননা— এগুলোকে বাই-প্রডাক্ট হিসাবে দেখতে হবে। তাদের শিক্ষা মেনে চলেছি।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পরে মিডিয়া মাইক ধরে সামনে। তাদের গৎবাঁধা কিছু প্রশ্ন থাকে। সব পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-কবিকে একই প্রশ্ন করা হয়। যেমন, পুরস্কার পাওয়ার পরে আপনার অনুভূতি কী? উত্তরে বলেছি, আলাদা কোনো অনুভূতি নাই। পুরস্কার আমার লেখালেখিতে কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব খুশি হয়।

মিডিয়ার লোকজন খুব অবাক হয়েছিল, পুরস্কার গ্রহণের পাঁচদিনের মাথায় বাংলা একাডেমি একটি বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদসভায় টিএসসি-তে আমার অংশগ্রহণ এবং নিন্দা জ্ঞাপন করে বক্তৃতা দেওয়ায়। তা নিয়েও প্রশ্ন করেছিল তারা। সেই প্রশ্নে উল্টো অবাক হয়েছিলাম আমি। বাংলা একাডেমি আমাকে পুরস্কার দিয়েছে আমার সাহিত্যকর্মের জন্য। তার বিনিময়ে তো আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করার কোনো শর্ত দেয়নি। দিলে আমি নিশ্চয়ই পুরস্কার নিতাম না। তবে বলে রাখি সেই সময় কিন্তু বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের পদক্ষেপের নিন্দা করায় আমার প্রতি কোনো বিষোদ্গার করেনি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় সত্যিই আমি অনেকটাই স্বস্তিবোধ করেছিলাম। আমার মতো আরো অনেকেই। গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেওয়ার পরে নিজেকে দেশে অবাঞ্চিত মনে হতো। নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে আত্মগ্লানিতে মন ছেয়ে যেত। বাংলাভাইয়ের নৃশংসতা ঘটেছে আমারই জেলায়। তা নিয়ে গল্প লেখায় বাড়িতে কাফনের কাপড় এসেছে। কেয়ার করিনি। বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের নাম ধরে ধরে প্রতিবাদ সভায় কথা বলেছি। হুমকি এসেছে। কিন্তু এলাকায় আমাদের জনভিত্তি থাকায় সেগুলোকে মাথায় রাখিনি। তাই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম মন থেকে। জানতাম তাদের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন তারা করতে পারবে না। কারণ সেই রকম শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ নেতা-কর্মী তাদের বেশি নেই। এরা দলের জন্য হয়তো নিবেদিত, কিন্তু সামনে টাকা দেখলে লোভ সামলাতে পারবে না। তবু আমরা স্বস্তিবোধ করছিলাম এই ভেবে যে, অন্তত কিছুটা হলেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের হাত থেকে মুক্তি পাবে, বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই ঘটতে শুরু করল একই ধরনের দলীয়করণ, দুর্নীতি, বিরোধীমত দলন, সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাজাকারের ট্যাগ দেওয়া। সুশাসন শব্দটি রইল কেবল কাগজ-কলমে। পাঁচ হাজার টাকা কৃষিঋণের কারণে আগের মতোই কৃষককে কোমরে দড়ি বেঁধে ঢোকানো হচ্ছে হাজতে, অথচ হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিরা পাচ্ছে ভিআইপি-র মর্যাদা। দেশবিরোধী বড় বড় চুক্তি, সুন্দরবনকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরোপুরি ভারত-নির্ভরতা সহ অসংখ্য ঘটনা আওয়ামী সরকার থেকে মোহমুক্ত করল আমাকে। তেইশ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, একথা সত্য। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি সরকারগুলো। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে আরেক রকম বিকৃতি। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সকলের ভূমিকাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর সকল নেতার ভূমিকাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হচ্ছে।

আর গণতন্ত্রের সর্বশেষ ভড়ংটুকু উবে গেছে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের নির্বাচনের পরে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাওয়া যে কোনো মানুষের জন্য নৈতিক দেউলিয়াপণার উদাহরণ। এত পাপ মোছার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করা যথেষ্ট নয়। বরং এতে তার অবমাননা হয় বলেই ধারণা করি।

আমাদের দেশের অসংখ্য লেখক-কবি-সংস্কৃতিকর্মী-সাংবাদিক নির্বিকারভাবে গুণকীর্তন করে চলেছেন ক্ষমতাসীনদের। অন্য পেশাতেও এমন মানুষ অজস্র। তা তারা যা করছেন করুন। কিন্তু আমরা যারা তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাই না, তাদেরকে নানাভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দেবার চেষ্টা চালায় এদের অনেকেই। মোনায়েম খান সত্য উচ্চারণকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিত এনএসএফ নামক ঠ্যাঙারেদের। এরাও চায় এমন ধরনের ক্যাডারদের আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে। তারা কি ভয় পায় আমাদের? তারা কি মনে করে আমরা তাদের পদ-পদবী-হজযাত্রা-বিদেশভ্রমণে ভাগ বসাব? অথচ সাধারণ জ্ঞান বলে তা করতে চাইলে আমরা তো তাদের মতোই সত্য উচ্চারণে নিস্পৃহ থাকতাম।

এখন পরিষ্কার করে বলি আমার চাওয়ার কথা। যে ভাষায় রবীন্দ্র-নজরুল-মানিক-ওয়ালীউল্লাহ্ সহ অসংখ্য মেধাবী লেখক অবদান রেখে গেছেন, তাদের ডিঙিয়ে অমরত্বের স্বপ্ন দেখার বাতুলতা আমার নেই। আমি এমন কোনো বিপ্লবী নই যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দেব। আমাদের জাতির সামনে এখন ভবিতব্য দুইটি। একটি হচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অন্যটি ঘুরে দাঁড়ানো। যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তো সবই গেল। আর যদি ১০-২০-৫০ বছর পরে আগামীর প্রজন্ম ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে তারা বর্তমানের এই অন্ধকার সময়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে যেন দেখতে পায়, সবাই সুবিধাবাদ এবং মানসিক অন্ধত্বের স্রোতে গা ভাসায়নি। অন্তত কিছু মানুষ অন্যদের মতো সুবিধাপ্রাপ্তি এবং আত্মবিক্রয়ের ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি।

আমার সামান্য চাওয়া, সেই স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে নিজের জন্য এক চিলতে জায়গা পাওয়া। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক