রাজীব জবরজংয়ের গল্প ‘জালালি খতম’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২৩

ভোর হতে না হতেই বিবি সকিনার বাড়ি হতে কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ আসছে। সাতজন মৌলানা একসাথে কুরআন খতমে বসেছেন। সবাই মিলে সত্তুর বার কুরআন খতম করবেন আছর আযানের আগেই। তারপর আছর থেকে মাগরীবের ওয়াক্ত পর্যন্ত জায়নামাযে বসে বিবি সকিনার পাপমুক্তির দোয়া করবেন সাত মৌলানা।

 

বিবি সকিনা মেঝেতে পাটির উপর প্রায় মৃত্যু শয্যায়। তার ছেলে সন্তানদের মধ্যে চতুর্থজন এখনো এসে পৌঁছাতে পারেনি। চার মেয়ের তিন মেয়ে পৌঁছে গেছে আগের দিনই। মেঝো মেয়ে মারা গেছে কয়েক বছর আগে। বড় মেয়ে ময়ূরীর খানিক পরপর বিলাপ করে কান্না, এবং ময়ূরীর বিলাপ থামাতে সেঝো মেয়ে বানু আর ছোট মেয়ে মনির বিলাপ ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে, বিবি সকিনার বাড়িতে কেউ একজন মৃত্যুশয্যায়।

 

সকিনার ছয় ছেলের মধ্যে দুজন থাকে তার বাড়িতেই। সবার ছোট সন্তানটি বারো বছর বয়সে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিল, আর ফেরেনি। ছোট ছেলেটি ফিরে না আসায় পঞ্চম ছেলে রেজাউলই এখন এই বাড়ির ছোট ছেলে। বড় ছেলে শামসুল হক রেলওয়েতে চাকরি করে, বাড়ির সামনে ট্রেন থামিয়ে চাকরিতে যায় বলে আশি বছরের সকিনার খুব গর্ব হয়। আদর করে সকিনা বড় ছেলেকে ডাকে, শামু। মেঝো ছেলে থাকে খুলনায়, চাকরি করে দাদা ম্যাচ ফ্যক্টরিতে, নাম ফজলুল হক। মেঝো ছেলের আদরের ডাকনাম ফজু।

 

সকিনা তার আশি বছরের জীবনে কোনোদিন খুলনা যায়নি, অথচ ফজু খুলনাতেই থাকছে। তাই ফজুর জন্যেও বিবি সকিনার গর্ব হয়। সকিনার সেজো ছেলে মজু, মুজিবুল হকও তার কাছেই থাকে, বড় ছেলের মতো রেলওয়েতে চাকরি করে। বিবি সকিনার স্বামী মন্নাফও রেলওয়েতেই চাকরি করত। তাই বড় আর মেঝো ছেলের ভেতর প্রয়াত স্বামীর ছায়া দেখে সুখটুকু অনুভব করেন এখনো। ছোট ছেলে রেজাউল হক থাকে খুলনায়, মেঝো ছেলের কাছে। সবার ছোট হওয়ায় তার আদরের মাত্রাটা গিয়ে ঠেকেছে তার ডাক নামে। বাড়ির সকলের কাছেও সে সকিনার মতো আদরের বড্ডা হুক্কা।

 

চতুর্থ ছেলে লুৎফুল হক মস্তবড় সরকারি কর্মকর্তা। তাকে আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ মাস্টার ভাই বলে ডাকে। সকিনা কখনো ডাকে লুতু, কখনো মাস্টর। এই ছেলেটাকে নিয়ে বিবি সকিনার গর্ব একটু বেশিই।

 

শীতের সকালের ভেতর কুয়াশা ঠেলে রোদ এসে পড়েছে সকিনার বাড়ির উঠানে। বড্ডা হুক্কা সকিনাকে কোলে করে মজুর ঘর থেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসে। কোলে করে উঠানে আসতে আসতে বড্ডা হুক্কার কাছে সকিনা জানতে চায়, মাস্টর আইয়্যে ন অঁনো? মাস্টররে সরকার ছুটি দিছেনি রে হুক্কা?

 

বড্ডা হুক্কা মাকে উঠানে পেতে রাখা বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে আশ্বস্ত করে বলে, মাস্টর ভাই তো কাঁলিঞ্জা রওনা দিছে, আটটা নটার মইধ্যে চলি আইবো।
অনগা জুঁত হরি হুতি থান, শইল্যে রইদ লাইগলে ভালা লাইগবো।
বড্ডা হুক্কা তার স্ত্রী আশাকে ডাকে, এঁরে পপির মা, পপির মারে.... পপির মা কোনাইরে?

 

মজুর মেয়ে লাভলি দৌড়ে এসে বড্ডা হুক্কাকে বলে, ছোট্ট কাক্কু, চাচি আম্মা হইত গেছে, বুবুর কাপড় ধুইবার লাই।
কিছু লাইগবো নি কি?
বড্ডা হুক্কা বলে, মা’র ভইর দোনোয়ান এক্কারে ঠাণ্ডায় বই গেছে! অল্প কদ্দুর ভালা তেলের লগে দুই কোঁয়া রৌন গরম করি মা’র ভইরে ডলি দে। এই বলেই বড্ডা হুক্কা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মাকে বলে, মাস্টর ভাই আইবার টাইম অইগেছে। আঁই ইস্টিশনের মুই যাইয়ের। আন্নে কিছু খাইবেন নি? কিয়া আইনতাম আন্নের লাই?

 

সকিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আঁর মাস্টররে লই আয় তুই। আঁর নাতিন লিপিরে লই আয়। হাবিজ রাবিজরে লই আঁয়।

 

মাস্টর কিছুক্ষনের মধ্যেই তার কাছে চলে আসবে, এই ভাবনায় সকিনা রোদের উঠানে শুয়ে শুয়ে ভেবে ফেলে, একবার মাস্টরের শহরের বাসায় বেড়াতে গিয়ে কী দারুণ বিদ্যুতের জৌলুশ দেখেছিল। সেবার বাড়ি ফিরে এসে কত মানুষকে গর্ব করে বলেছিল, আঙ্গো মাস্টরের বাসাত কারেন্টের হ্যাজাক জ্বলে। হাইবের ভিত্তে কেরোসিন চলি যায় বাত্তির গোড়াত। দূরে এক কল আছে, হিয়েনে টিবি দিলে হ্যাজাক জ্বলে, আবার টিবি দিলে বন্দ অই যায়।

 

সাত মৌলানার তেলাওয়াত আরো বেশি শব্দ করে কানে লাগে সকিনার। একে একে আত্মীয়-স্বজনের ভিড় বাড়তে থাকে সকিনার বাড়িতে। একেকজন বাড়ির ভেতর ঢোকে আর মিনিটখানেক বিলাপের শব্দ আসে। এর মাঝেই লুৎফুল হক তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে রিক্সা থেকে নামে বাড়ির উঠানে। বিবি সকিনা অপলক তাকিয়ে আছে। লুৎফুল হক আর তার স্ত্রী চোখ মুছতে মুছতে সকিনার পা ছুঁয়ে সালাম করে। সকিনা তার পাশে থাকা হাত পাখা দিয়ে লুৎফুল হককে মারতে মারতে বলে, আমার হাবিজ, রাবিজ, লিপিরে চাইবার লাই আঁর কইলজ্যা হাডি যাঁর এ ক’দিন। তুই কিল্লাই এত দেরি কইচ্ছত?

 

লুৎফুল হক চোখ মোছে আর বলে, আমনের কিয়া খাইতো মন চায় মা?
সকিনা তখন বলে, লুতুরে, মজুর ঘরে হুজুরেরা খতম হড়ের। হুজুররে যাই ক চাই , আর রাহমান সূরাগা এক্কানা জোরে জোরে হইড়বারলাই। লুতু তখন সকিনাকে বলে, মা হুজুরেরা তো খতম হড়ের আর রাহমান সুরার সিরিয়াল আইলে হেতারা হইড়বো। ছকিনা রেগে গিয়ে লুতুকে বলে, খতমের হইশা দিবো আঁর মাস্টরে, আর হেতারা খতম হইড়বো হেতাগো ইচ্ছা মতো? তুই হুজুররে যাই কই আয় সুরা আর রাহমান হইড়বারলাই ।

 

লুৎফুল হক মায়ের সিথান থেকে উঠে সেঝো ভাই মজুর ঘরে ঢোকে। বড়বোন ময়ূরী লুতুকে ধরে আবারো বিলাপ শুরু করে। এদিকে জালালি খতমের পাশাপাশি চিনিপড়া নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে সকিনার সন্তানরা। আত্মীয়দের মধ্যে এক মুরুব্বি লুৎফুল হককে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, চিনিপড়া মৃত্যুপথ যাত্রীর জন্য মন্দ কিছু নয়। এতে মৃত্যুপথ যাত্রীর যাত্রা সহজ হয়। অবশেষে সকিনার সন্তানদের প্রায় সবাই একমত হয় চিনি পড়ার বিষয়ে।

 

সকিনা বাড়ির উঠানে কুরানের ধ্বনি শুনতে শুনতে রোদের চিকচিকের ভেতর দেখতে থাকে। সকিনাকে নাইওর নিতে সকিনার বাবা এসেছে সকিনার স্বামীর বাড়িতে। কিন্তু কোনোভাবেই সকিনা স্বামীর বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে নামছে না। সকিনা কোনোভাবেই এই পেয়ারা গাছের পেয়ারা ছেড়ে বাবার বাড়িতে নাইওর যাবে না। সকিনার বাবা প্রচণ্ড সুখ নিয়ে হাসতে থাকে। সকিনা উঠোনে শুয়ে শুয়ে সেই পেয়ারা গাছটা দেখার চেষ্টা করে। রেজাউলের ঘরের আড়ালে ঢেকে গেছে সেই প্রাণের পেয়ারা গাছ। রোদের তাপে সকিনার গরম লাগে, সকিনার মনে পড়ে যায়, সকিনার ছেলে লুতু শহরে থাকে। লুতুর বাসায় রাতে কারেন্টের হ্যাজাক জ্বলে, গরমে চলে কারেন্টের বিচুইন। সকিনার মনে হয়, যদি কোনোদিন তার বাড়িতে কারেন্টের লাইন আসে তবে লুতু নিশ্চয়ই সকিনার ঘরে কারেন্টের হ্যাজাক আর কারেন্টের বিচুইন এনে দেবে।

 

সাত মৌলানার মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠ মৌলানার সামনে একবাটি চিনি রাখা। মৌলানা বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছেন আর একটু পরপর ফুঁ দিচ্ছেন। চিনিতে ফুঁ দেয়া শেষ করে মৌলানা বললেন, সকিনা যে ঘরে ঘুমায়, সে ঘরের চারপাশের ডেলায় এই চিনি ছিটিয়ে দিতে। সকিনাকে দেখতে আসা স্বজনদের কেউ কেউ বলাবলি করছে, এই চিনিপড়া যদি পিঁপড়া না খেয়ে ফেলে তবে বুঝে নিতে হবে সকিনার আয়ু আর নেই। যদি পিঁপড়ারা চিনিপড়া খেয়ে ফেলে তবে ছকিনা সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসবে আবারো। সাত মৌলানার বাকি ছয় মৌলানা শব্দ করে করে পড়ছেন, আর রাহমানু, আল্লামাল কুরয়ান, খ্বলাক্বাল ঈনসান... আল্লামাহুল বাইয়্যান ....

 

ময়ূরী আর বানুর বিলাপের চিৎকার বাড়তে থাকে, থামে না। বড় ছেলে শামুর মেয়ে শিরি মেহমানদের জন্য খাবারদাবার নিয়ে আরো তৎপর হতে থাকে। রেজাউল এসে জানান দেয়, বাঁশ কাটা হয়ে গেছে। গোরখোদক অপেক্ষায় আছে সিদ্ধান্তের। শামুর ছেলে রিপন সচেতনভাবেই কালক্ষেপণ করছে কাফন কিনতে যেতে। হঠাৎ মজুর ছেলে শহিদ এসে সকিনাকে বলে, বুবু আইসকিরিম আলা আইছে, আইসকিরিম খাইবেন নি? সকিনা কিছুই বলে না। কেবল ইশারায় বলে, চুপ, একদম চুপ।

 

পেয়ারা গাছটা যেন রেজাউলের ঘর ঠেলে উঠানের রোদ ঠেলে সকিনার চোখের দিকে আসছে। সকিনার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা যায়। পেয়ারা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মন্নাফ। মন্নাফ সকিনাকে ডাকছে। সকিনা দেখে, রেজাউলের ঘরের পাশে ছাতা হাতে মুখে পান নিয়ে সকিনার বাবা হাসি মুখে সকিনার দিকে তাকিয়ে আছে। সকিনার খুব ইচ্ছা করে নিঃশ্বাসের ভেতর দিয়ে অন্তর ভিজিয়ে ফেলতে পেয়ারার সুবাসে। রেজাউল এসে আবারো সকিনাকে কোলে করে নিয়ে যায় মজুর ঘরের ভেতর। সকিনার কানে কুরআনের ধ্বনি আরো শব্দ করে বাজে।

 

সকিনার হাত পা অসাড় হয়ে আসে। সকিনা যেন ক্রমেই একটা পেয়ারা গাছ হয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টির চারপাশে সন্তানদের একেকজন যেন একেক ডালে ঝুলে থাকা পেয়ারা। নাতি নাতনিরা ডালে ডালে ঝুলে থাকা সতেজ পেয়ারার ফুল। সকিনা নিঃশব্দে হাসির রেখা একে পেয়ারা পাতার মতো কান খাড়া করে শুনতে থাকে। মৌলানারা সূর তুলেছে:

অখলাক্বল্ জ্বান্না মিম্ মা-রিজ্বিম্ মিন্ নার্
ফাবি আইয়্যি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান্ ।