রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘বর্ণনাত্বক নাট‌্যরী‌তি: কিছু কথা’

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০২৪

বাংলা‌দে‌শের এই ভূখ‌ণ্ডে আম‌ার যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা অনেকদিনের। সেটা প্রধানত স্বাধীনতার আগের সময়কার কথা বল‌ছি। স্বাধীনতার প‌রেও সামান‌্য দিন যাত্রা দে‌খে‌ছি। গ্রা‌মের মানু‌ষের কা‌ছে যাত্রা‌ ছিল খুব আকর্ষণীয় এক‌টি মাধ‌্যম। গ্রা‌মের সকল শ্রেণির মানুষ রা‌তের খাওয়া-দাওয়া শেষ ক‌রে রাত দশটা সা‌ড়ে দশটার দি‌কে যাত্রা দেখ‌তে‌ ভিড় জমা‌তো। এরপর ভোর ‌তিনটা চারটা পর্যন্ত একটানা গোগ্রা‌সে যাত্রা উপ‌ভোগ কর‌তো। গ্রাম কেন, ঝালকাঠী শহ‌রেই আমি প্রথম যাত্রা দে‌খি। রাত এগারোটায় যাত্রা আরম্ভ হ‌তো, ভোর চারটা সা‌ড়ে চারটা পর্যন্ত চল‌তো।

প্রথমবার ম‌নে আছে, রা‌তেরবেলা ভাই আর ভাইয়ের বন্ধুরা যাত্রা দেখ‌তে যা‌বে। রাত‌ সা‌ড়ে দশটার দি‌কে তখন আমি শু‌য়ে প‌ড়ে‌ছি। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। আব্বা ভাইয়ের বন্ধু‌দের বল‌লেন স‌ঙ্গে ক‌রে আমা‌কেও যাত্রা দেখ‌তে নি‌য়ে যে‌তে। ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই রা‌জি হ‌লে আমি বিছানা ছে‌ড়ে উঠে রাত এগা‌রোটায় চ‌লে গেলাম যাত্রা দেখ‌তে। প‌থেই যাত্রার বিউগল শোনা যা‌চ্ছিল। যাত্রা প্যাণ্ডেলের কা‌ছে গেলাম। কারণ টি‌কেট কেনার কথা সক‌লের জন‌্য। আব্বা আমার জন‌্য টি‌কে‌টের টাকা দি‌য়ে‌ছি‌লেন, কিন্তু সংগঠকরা ছি‌লেন ভাইয়ের বন্ধু‌দের প‌রি‌চিত। আব্বা‌কে চিন‌তেন। বল‌লেন, আমার টি‌কেট লাগ‌বে না। বা‌কিরা টি‌কেট কাট‌লেন। প‌্যাণ্ডে‌লে ঢু‌কে দেখলাম, বহু মানুষ মা‌টি‌তে কাপ‌ড়ের ওপর ব‌সে আছেন, আমরা এক‌দি‌কে সস্তা চেয়া‌রে বসলাম। যাত্রা দেখার সেই স্মৃ‌তি ইহকা‌লে আর ভুলবার নয়। যাত্রার দেখার সেই আনন্দ আজও তৃ‌প্তি দেয়। হয়‌তো যাত্রার সেইসব বিষয়বস্তু ম‌নে আজ ভিন্নরকম প্রশ্ন তো‌লে।

ঝালকা‌ঠির সেই দিনগুলো‌তে প্রতিবছর শী‌তে যাত্রা দেখা এবং লক্ষ্মণ দা‌সের সার্কাস দেখার স্মৃ‌তি‌টি ম‌নে উজ্জ্বল। যাত্রা দেখার আনন্দ ছিল তার অভিনয় আর গ‌ল্পের জন‌্য। এবং সেই স‌ঙ্গে সংলাপ, সার্কাস দেখার আনন্দ একেবা‌রেই ভিন্ন। সেখা‌নে মানু‌ষের দক্ষতা আর নৈপুণ‌্য দেখে চম‌কিত হতাম। সার্কাস দে‌খে যেমন বি‌স্মিত হতাম, যাত্রা দে‌খে মুগ্ধ হতাম। যাত্রা দে‌খে ম‌নের অব‌চেত‌নে যাত্রা লিখবার কথা ভাবতাম, অভিনেতা হবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু সার্কাস দে‌খে য‌তেই চম‌কিত হই, ম‌নের ভিত‌রে কখ‌নো সার্কাস দ‌লের দক্ষ খে‌লোয়ার হবার ইচ্ছা জাগে‌নি। হয়‌তো আমার অব‌চেতন মন আমা‌কে ব‌লে দি‌য়ে‌ছে, সার্কা‌সের দক্ষ কু্শলী হবার যোগ‌্যতা আমার নেই। প‌রে ঘটনাচ‌ক্রে মু‌ক্তিযু‌দ্ধের আগে যাত্রা করার সু‌যোগ এসে যায় আমার জীব‌নে। মা‌র্চের শুরু‌তে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখন বন্ধ, আমরা নানার গ্রা‌ম বিল‌বিলাসে বেড়া‌তে গেলাম। সেখা‌নে তখন স্থানীয়রা মি‌লে যাত্রার মহড়া দি‌চ্ছিল মিঞা বা‌ড়ির মাধ‌্যমিক বিদ‌্যাল‌য়ে।

বিকেল হ‌লেই খোন্দকার বা‌ড়ি থে‌কে মিঞা বা‌ড়ির মাধ‌্যমি‌ক বিদ‌্যালয়ে যাত্রার মহড়া দেখ‌তে চ‌লে যেতাম। যাত্রাপালার নাম ‌ছিল ‘বাইশ বছর প‌রে’। সেখা‌নে এক‌টি চ‌রিত্র ছিল বান্নু। বান্নুর চ‌রিত্রে যারা অভিনয় কর‌ছিল প‌রিচালক খু‌শি নন তা‌দের অভিনয়ে। কম বয়স তখন আমার, মহড়ার ম‌ধ্যেই সমা‌লোচনা ক‌রে বসতাম। এক‌দিন প‌রিচালক আমা‌কে বল‌লেন, বান্নুর চ‌রি‌ত্রে অভিনয় কর‌তে। কী‌সের নার্ভাস‌নেস তখন, উদ্ধতভা‌বে দাঁড়িয়ে অভিনয় ক‌রে ফেললাম বান্নুর চরি‌ত্রের ছোট প্রথম দৃশ‌্যটি‌তে। কী‌সের প্রোমট্, মহড়া দে‌খে দে‌খে সংলাপ তখন আমার মুখস্থ। মহড়ায় আমার অভিনয় দেখার পর উপ‌স্থিত সক‌লের খুব করতা‌লি এবং আমা‌কেই সেই চরি‌ত্রে অভিনয় কর‌তে অনু‌রোধ করা হ‌লো। রা‌জি হলাম ঠিকই, দরকার ছিল মামার অনুম‌তির। সেটাও পাওয়া গেল। ম‌নে ম‌নে আজ ভা‌বি, আস‌লে ম‌নের অব‌চেত‌নে আমি সেই চ‌রিত্রটি করবার জন‌্যই নি‌জে‌কে তৈ‌রি কর‌ছিলাম। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় যাত্রা‌টি সেবার করা গেল না। কারণ যাত্রা অভিয়নের দিন‌টি ছিল সম্ভবত ১৯৭১ সা‌লের ত্রিশে মার্চ। মু‌ক্তিযুদ্ধ হ‌য়ে যাবার পর ১৯৭২ সা‌লের জানুয়া‌রি মা‌সে যাত্রা‌টি প্রদর্শিত হয় এবং আমি তা‌তে বান্নু চ‌রি‌ত্রে অভিনয় ক‌রি।

যাত্রা ছিল আস‌লে সংলাপ প্রধান এবং সম্পূর্ণ অভিনয় প্রধান মাধ‌্যম। কণ্ঠস্বর নি‌য়ে খেলার মাধ‌্যম। যাত্রায় স্বাভা‌বিক অভিনয় ব‌লে কিছু ছিল না এবং তা কেউ আশাও কর‌তো না। খুব উচ্চস্ব‌রে কণ্ঠস্বর দু‌লি‌য়ে দু‌লি‌য়ে কথা বল‌তে হ‌তো এবং তার মধ‌্য দি‌য়েই অভিনয়ের চাতুর্য বা মাধুর্য ফু‌টি‌য়ে তুল‌তে হ‌তো। যাত্রাপালায় মা‌ঝে ম‌ধ্যে বি‌বে‌কের দু‌তিন‌টি গান বা অন‌্য গান থাক‌তো। খুব বে‌শি গান থাক‌তো না। গান যাত্রাপালার মূল নিয়ামক ছিল না, মূল নিয়ামক ছিল সংলাপ। সংলাপ গেঁথে গেঁথে যাত্রার গল্প তৈ‌রি হ‌তো। য‌দিও বলা হয়ে থা‌কে, মানুষ যাত্রা `দেখ‌তে` যায়, কিন্তু প্রধানত যে‌ত `শুন‌তে`, সংলাপ শুন‌তে। যাত্রার সমঝদাররা সংলাপ শো‌নে মনপ্রাণ দি‌য়ে। যাত্রায় গান না থাক‌লেও তা নি‌য়ে দর্শক‌শ্রোতার সমস‌্যা হ‌তো না। কারণ তা‌দের চাই সংলাপ। যাত্রায় বর্ণনাত্বক রীতি ব‌লে কিছু ছিল না। যাত্রার শ্রোতারা কখ‌নো প্রশ্ন তো‌লে‌নি যাত্রায় `বর্ণনা` নেই ব‌লে। বর্ণনাত্বক রী‌তি কী তাই দর্শক বা যাত্রার অভিনেতারা বুঝ‌তেন না। বর্ণানাত্বক রী‌তি যাত্রায় ছিল না‌ ব‌লে কেউ অভিযোগ তু‌লে ব‌লে‌নি যে, যাত্রা হ‌লো সাম্রাজ‌্যবা‌দের দান বা যাত্রা করা মা‌নে প‌শ্চি‌মের দাসত্ব করা এবং সেজন‌্য তা বা‌তিল ক‌রে দেয়া দরকার। নিশ্চয় সারা বাংলার গ্রা‌মে গ‌ঞ্জে শহ‌রে প্রদ‌র্শিত যাত্রাপালা মানুষ‌কে মুগ্ধ ক‌রে‌ছে বছ‌রের‌ পর বছর। বর্ণনাত্বক রী‌তির অভা‌বে ত‌া আট‌কে থা‌কে‌নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটক লিখ‌লেন সংলাপ‌কে প্রধান ক‌রে। নাট‌কে সেই স‌ঙ্গে গান ব‌্যবহার ক‌রে‌ছেন। রবীন্দ্রনা‌থের সেরা নাটকগু‌লো সব সংলাপ প্রধান, গান কম। রবীন্দ্রনা‌থের এক‌টি নাটকও নেই যেখা‌নে বর্ণনাত্বক রী‌তি আছে সংলাপ বাদ দি‌য়ে। ‌কিন্তু বাংলা‌দে‌শের কিছু মহাপ‌ণ্ডিত‌দের কা‌ছে শুন‌তে পাই, নাটক বর্ণনাত্বক রী‌তির না হ‌লে তাতে না‌কি সাম্রাজ‌্যবাদের দাসত্ব করা হয়, প‌শ্চি‌মের অনুকরণ করা‌ হয়। স‌ন্দেহ নেই, কলকাতার নাট‌কের হা‌তেখ‌ড়ি ইউরো‌পের হাত ধ‌রে। প‌রের এক‌শো বছ‌রে বহু নাটক লেখা হ‌য়ে‌ছে কলকাতাসহ সমগ্র বাংলা তথা সমগ্র ভারতব‌র্ষে। বাংলা‌দে‌শের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত এক‌শো বছ‌রে বাংলা নাট‌কের য‌ত দিকপাল সবাই সেইরকম নাটকই ক‌রে‌ছেন, যেখা‌নে সংলাপ আছে কিন্তু বর্ণনা নেই । মধুসূদন দত্ত, গি‌রিশ ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, ক্ষি‌রোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ হা‌লের বিজন ভট্টচার্য, দি‌গিন্দ্রচন্দ্র, উৎপল দত্ত, ন‌ভেন্দু সেন, মো‌হিতলাল চ‌ট্টোপাধ‌্যায় প্রমুখ। সবাই না‌কি তারা সাম্রাজ‌্যবা‌দের অনুকরণ ক‌রে‌ছেন। কারণ তারা বর্ণনারী‌তির নাটক লে‌খেন‌নি। বর্ণনারী‌তির নাটক লিখ‌লেই তারা ভা‌লো ছাত্র বা নাট‌্যকার হবার সনদপত্র পে‌তেন। বর্ণনারী‌তির নাটক লেখা হয়‌নি ব‌লে এক‌শো বছ‌রের সেসব নাটক না‌কি বা‌তি‌লের খাতায়। বর্ণনারী‌তি গ্রহণ করা হয়‌নি মা‌নেই বাংলার নিজস্ব নাট‌্য আঙ্গিক গ্রহণ করা‌ হয়‌নি এইটাই একপ‌ক্ষের সারকথা। ব্রিটিশ শাস‌নে বহু নাটক লেখা হ‌য়ে‌ছে ইং‌রেজ শাস‌নের বিরু‌দ্ধে যা আজও অভিনীত হয়। কিন্তু তবুও সেসব না‌কি সাম্রাজ‌্যবা‌দের দাসত্ব। বাংলার কিছু মহাপ‌ণ্ডিত‌দের বয়ান এসব। বাংলার নিজস্ব আঙ্গি‌কের নাট‌্যরী‌তির স্রষ্টারা সব না‌কি বাংলা‌দে‌শে জ‌ন্মে‌ছেন! এর আগে যা নাটক লেখা হ‌য়ে‌ছে সব না‌কি পাশ্চা‌ত্যের ধারার। সকল ধৃষ্টতার একটা সীমা থাকা দরকার।

যা কিছু একটা তৈ‌রি ক‌রে ব‌লে দেওয়া হ‌লো, এটাই বাংলার নিজস্ব নাট‌্য আঙ্গিক। সেটাই অন‌্যদের বিশ্বাস কর‌তে হ‌বে। কানা‌কে উচ্চ আদালত দেখা‌নো আর কী? বাংলার অতী‌তের কো‌নো দ‌লিল‌পত্রে এরকম নাট‌্য আঙ্গিক খুঁজে পাওয়া যা‌বে না। অথচ তাঁ‌দের ভাবখানা এমন যে, তারা যেন জাদুঘ‌রে গি‌য়ে বাংলার এরকম নাট‌্য আঙ্গিক স্ব‌চক্ষে দে‌খে এসেছেন বা বাংলার অতী‌তের মা‌টি খুঁড়ে যেন এই আঙ্গিক বের ক‌রে‌ছেন। প্রাচীন সংস্কৃত নাটক থে‌কে আরম্ভ ক‌রে মধ‌্যযু‌গের বাংলা পর্যন্ত য‌ত নাট‌কের সন্ধান পাওয়া গে‌ছে, স‌ত্যি বল‌তে তা‌তে এমন কিছুর প্রমাণ নেই। বাংলা নাটকই খুঁজে পাওয়া যায়‌নি, সেখা‌নে আবার নাট‌্য আঙ্গিক! প্রাচীন যু‌গের সংস্কৃত নাটকের পাণ্ডু‌লি‌পি পাওয়া গেল, এমন‌কি ভার‌তের নাট‌্যশাস্ত্র পর্যন্ত পাওয়া গেল, বাংলার নাটক খুঁজে পাওয়া গেল না। নাটক পাওয়া গেল না, কিন্তু নাট‌্য আঙ্গিক নাকি খুঁজে পাওয়া গেল! সংস্কৃত নাট‌কের ম‌ধ্যে যেগু‌লো বে‌শি আলো‌চিত সেগু‌লো সংলাপ প্রধান, বা‌কিগু‌লো‌তে গান আছে প্রচুর। কিন্তু বর্ণনাত্বক রী‌তি নেই সংস্কৃত নাট‌কে। কারণ তার পাণ্ডু‌লি‌পি র‌য়ে‌ছে আমা‌দের হা‌তে। দু’একটা মৈ‌থিলী নাট‌কের পাণ্ড‌লি‌পি যা পাওয়া গে‌ছে, তাও কিন্তু সংলাপ প্রধান। কিন্তু আমা‌দের বর্ণনারী‌তির উদগাতা‌দের অনেকের ভাবখানা এমন যে, বর্ণনাত্বক রী‌তি বাদ দি‌য়ে সংলাপ প্রধান নাটক লিখ‌লে তা জাতীয় নাট‌্য হ‌বে না; যেন জাত চ‌লে যা‌বে। বর্ণনাত্বক নাটক না লিখ‌লে নাট‌কের সতিত্ব থাক‌বে না। কিছু মহাপ‌ণ্ডিত এই বয়ান দি‌য়ে আস‌ছেন। এক‌শো বছর বা এক‌শো বিশ বছ‌রের বাংলার নাট‌্য চর্চার সকল ঐতিহ‌্য বা‌তিল ক‌রে দি‌য়ে তাদের ‌চিন্তাই যেন সবাইকে গ্রহণ কর‌তে হ‌বে। সক‌লেই এত‌দিন ভুল প‌থে ছি‌লেন, বাংলা নাটক রচনা ও মঞ্চায়‌নের স‌ঠিক পথটা এবার তারাই আবিষ্কার ক‌রে‌ছে। প্রবাদ আছে, অল্প‌বিদ‌্যা ভয়ঙ্কর।

বহু‌দে‌শে বহুকা‌লে শিল্পসা‌হি‌ত্যের জগ‌তে এইরকম হটকা‌রিতা হ‌য়ে‌ছে। রুশ বিপ্ল‌বের পর মায়ার‌হোল্ডসহ একদল অতিবিপ্লবী সকল পুরা‌নো শিল্প সা‌হিত‌্য নাটক বা‌তিল ক‌রে দি‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। সক‌লে তারা রব তু‌লে‌ছি‌লেন টলস্টয়, চেকভ, পুশ‌কিন প্রমু‌খের সব সা‌হিত‌্য বা‌তিল কর‌তে হ‌বে। কারণ তারা সবাই বিপ্লববি‌রোধী, প্রতি‌ক্রিয়াশীল। স্তা‌নিস্লাভ‌স্কির ম‌স্কো আর্ট থি‌য়েটার বন্ধ ক‌রে দি‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন তারা। সেইসব অতিবিপ্লবী মহামানবরা বল‌লেন, তারা সৃ‌ষ্টি কর‌বেন বিপ্লবী সা‌হিত‌্য, নাটক ও নাট‌্যকলাসহ সকল কিছু হ‌বে সমাজতা‌ন্ত্রিক। যা তারপর সৃ‌ষ্টি কর‌তে থাক‌লেন তা ভয়াবহ, দু‌র্বোধ‌্য এবং কখ‌নো কখ‌নো দানবীয়। সব‌কিছু দে‌খে লে‌নিন ও স্ট‌্যা‌লিনসহ সব বিপ্লবী নেতারা চম‌কে গে‌লেন। অতিবিপ্লবীদের প্রতি বিরক্ত হ‌য়ে লে‌নিন কলম ধর‌লেন। লিখ‌লেন, চাইলেই পিস্ত‌লের নল দি‌য়ে বিপ্লবী শিল্প সা‌হিত‌্য রচনা করা যায় না। কলমের এক খোঁচায় অতী‌তের সকল সৃ‌ষ্টিশীল ধ্রুপদী‌কে বা‌তিল করা চ‌লে না। সামন্ত যু‌গে ও বুর্জায়া সমা‌জে অনেক মহৎ রচনা পাওয়া গে‌ছে, সেগু‌লো সব জনগ‌ণের সম্প‌ত্তি এবং তা দেশকা‌লের ঊর্ধে। সেসব যত্ন সহকা‌রে রক্ষা কর‌তে হ‌বে। বিপ্ল‌বের পর সেসব বা‌তিল হ‌য়ে যায় না বরং সেসব আরো গুরুত্ববহ হ‌য়ে ওঠে। আগে ছিল সেসব কেবল ধনী‌দের উপ‌ভোগ‌্য, বিপ্ল‌বের পর তা সর্বসাধার‌ণের ক‌রে দি‌তে হ‌বে। ফ‌লে স্তা‌নিস্লাভ‌স্কির ম‌স্কো আর্ট থি‌য়েটার আর বন্ধ হ‌লো না। টলস্টয়, চেকভ, ফিওদর দস্তয়ভ‌স্কি, পুশ‌কিন, নি‌কোলাই গোগল প্রমুখের রচনার লক্ষ লক্ষ বই ছা‌পি‌য়ে জনগ‌ণের ম‌ধ্যে বিতরণ করা হ‌লো।

স্বাধীনতার আগে-প‌রে পর একই ঘটনা ঘটে‌ছিল প‌শ্চিম বাংলা তথা ভার‌তে। স্বাধীনতার আগেই বুদ্ধ‌দেব বসুসহ বহুজন রব তুল‌লেন, রবীন্দ্রনাথ বয়ক‌টের। বুদ্ধ‌দেব বসুসহ ক‌য়েকজন তার ম‌ধ্যে ছি‌লেন শ‌ক্তিমান লেখক, বা‌কিরা অনেকে ছি‌লেন অযোগ্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সম‌য়ে ভার‌তের সাম‌্যবাদী দলের সম্পাদক রনদীভে রব তু‌লে‌ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ প্রতি‌ক্রিয়াশীল তাই তা‌কে বর্জন কর‌তে হ‌বে। গণনাট‌্য সং‌ঘে উৎপল দত্ত রবীন্দ্রনা‌থের অচলায়তন মঞ্চস্থ করার জন‌্য রনদীভের চো‌খে ট্রটস্কীপন্থী হ‌য়ে গে‌লেন উৎপল, ফ‌লে তাঁ‌কে গণনাট‌্য ছাড়‌তে হ‌লো। পূর্ব বাংলায়ও তখন তার রেশ প‌ড়ে‌ছিল। মুনীর চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মূ‌তি শরফু‌দ্দিন প্রমুখ রবীন্দ্রনাথ‌কে বা‌তিল করার ঘোষণা দি‌লেন। সেসব নি‌য়ে তিক্ত ঘটনা ঘ‌টে সেই পঞ্চা‌শের দশ‌কে। প‌রে সাম‌্যবাদী দল রনদী‌ভের পথ ভুল ব‌লে সিদ্ধান্ত নি‌লে রবীন্দ্রবর্জন নী‌তি বাদ পড়‌লো। ফ‌লে, এই ধর‌নের ঘটনা নতুন কিছু নয়। শি‌ক্ষিতরাই এসব হটকারী আচরণ ক‌রে থা‌কে। ফ‌লে বাংলার সেইসব মহা‌প‌ণ্ডিতর‌া বাংলার সাধারণ রঙ্গশালার এক‌শো কিংবা এক‌শো বিশ বছর সময়কা‌লের নাট‌্যচর্চা‌কে বা‌তিল ক‌রে দি‌তে চাইলেন তাঁ‌দের কল‌মের খোঁচায়। ঠিক ধর্মীয় শুদ্ধচারী আন্দোল‌নের ম‌তো, একমাত্র তাহারাই ঠিক, বা‌কিরা সব ভুল।

নাট‌কের প্রতি স‌ত্যিকা‌রের আগ্রহ আমার প্রথম জ‌ন্মে‌ছে ম‌ঞ্চে নাটক দে‌খে য‌তেটা নয়, তার‌চে‌য়ে বেতা‌রে নাটক শু‌নে। বেতার নাটকও ছিল সংলাপ প্রধান। শুধু সংলা‌পের ওপর নির্ভর ক‌রে নাট‌কের সবটা বু‌ঝে নেওয়া যে‌ত। দুই বাংলার বেতার নাট‌কেও বর্ণনা বলে কিছু ছিল না। সবটাই সংলাপ। কিন্তু মহাপ‌ণ্ডিতর‌া ধর্মীয় কট্টর‌দের ম‌তো বর্ণনাত্বক না হইলে তাহা‌কে কিছু‌তেই বাংলার নাটক ব‌লিয়া মা‌নি‌তে রা‌জি নহেন। নাটক তাদের কা‌ছে বর্ণনাত্বক হওয়া না হওয়ার স‌ঙ্গে যুক্ত, বাংলার দেশীয় নাট‌্য আঙ্গিক হওয়ার সেটাই একমাত্র শর্ত। কিন্তু যু‌ক্তিটা কী? একজন বল‌লেন, চি‌লে কান নি‌য়ে গে‌ছে আর স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে তাই বিশ্বাস কর‌তে হ‌বে? যারা বর্ণনাত্বক রী‌তি‌কে বাংলার নিজস্ব আঙ্গিক ব‌লেন, তাঁ‌দের কয়টা নাটক মঞ্চস্থ হয় বাংলার গ্রা‌মে গ‌ঞ্জে? কিন্তু সিরাজ‌দৌলা, নীলদর্পণ, তিতুমীর এরকম বহু নাটক এক‌শো বছ‌রের বে‌শি সময় ধ‌রে মঞ্চস্থ হ‌য়ে চ‌লে‌ছে। বাংলার গ্রা‌মের সাধারণ মানুষ‌কে য‌দি গি‌য়ে বলা হয়, ওসব বাংলার নিজস্ব ঐতি‌হ্যের নাটক নয়; গ্রা‌মের মানুষ শু‌নে তা হাস‌বে, না হ‌লে বোকাম মতন তা‌কি‌য়ে থাক‌বে। `প‌হেলা বৈশা‌খে পান্তা খাওয়া ঐতিহ‌্য` এসব সস্তা কথা অর্ধ শি‌ক্ষিত‌দের যত সহ‌জে বিশ্বাস করা‌নো যায়, মা‌টির সংলগ্ন সাধারণ মানুষ‌কে তা সহ‌জে বিশ্বাস করা‌নো যায় না।

নাটক নি‌য়ে যে কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষা কর‌তেই পারেন। নতুন চিন্তা নতুন আঙ্গিক নাট‌কে আস‌তেই পা‌রে। দর্শক য‌দি সেই নাট‌্য প্রযোজনা বা সেই আঙ্গিক গ্রহণ ক‌রে, তা‌তে অন‌্য কা‌রো আপ‌ত্তি করার কিছু নেই। দর্শকের ভা‌লো লাগা না লাগার স‌ঙ্গে নাট‌্য আঙ্গি‌কের সার্থকতা লাভ ক‌রে। কিন্তু তাই ব‌লে সেই নাট‌্য আঙ্গিক‌কে বাংলার নিজস্ব নাট‌্য আঙ্গিক ব‌লে চালাবার এবং বা‌কিগু‌লো‌কে বা‌তিল ক‌রে দেবার কো‌নো সু‌যোগ নেই। সম্ভবও নয়। রুশ বিপ্ল‌বের পর অতিবিপ্লবীদের নাটক দেখ‌তে মানুষ কম ভিড় ক‌রে‌ছে বরং ম‌স্কো আর্ট থি‌য়েটা‌রের প্রেক্ষাগৃহ সর্বদাই পূর্ণ ছিল। শ্রমিকরাও সেই নাটক দেখ‌তে যে‌তেন। বর্তমান রচনার মূল বক্তব‌্য এই নয় যে, বর্ণনাত্বক নাটক করা যা‌বে না। দর্শ‌কের ভা‌লো লাগ‌লে কার কি বলার আছে? দর্শ‌কের মন জয় করা, নাট‌কের বিষয়বস্তু সমকা‌লের দর্পণ, এগু‌লো নাট‌কের সাফ‌ল্যের উতাজরণ। নাটক বর্ণনাত্বক না‌কি অন‌্য কিছু সেটা বড় কথা নয়, দর্শ‌কের মন জয় কর‌তে হ‌বে। বনপংশুল, নিত‌্যপুরাণ বর্ণনাত্বক হওয়া স‌ত্ত্বেও ঢাকার ম‌ঞ্চের অন‌্যতম দু‌টি শ্রেষ্ঠ নাটক। ‘মহাজ‌নের নাও’ অনেক ক্ষে‌ত্রেই বর্ণনাত্বক হওয়া স‌ত্ত্বেও আমার খুব প্রিয় নাটক। ইউসুফ হাসা‌নের অনেকগুলো বর্ণনাত্বক নাটক আমি দে‌খে‌ছি এবং সেগু‌লোর বে‌শির ভাগই আমার ভা‌লো লে‌গে‌ছে। ফ‌লে বর্ণনাত্বক নাটক ক‌রে তারা সফল হ‌য়েছেন ও মানসম্পন্ন নাটক ক‌রে‌ছেন। কিন্তু আমা‌কে য‌দি বলা হয়, `বর্ণনাত্বক` ওটাই বাংলার নিজস্ব নাট‌্যরী‌তি সেটা আমি মান‌তে নারাজ। সেই স‌ঙ্গে বর্ণনাত্বক নাট‌্যরী‌তির না‌মে যা কিছু চা‌লি‌য়ে দি‌লে সেটার সমা‌লোচনা হ‌বেই। নাটক‌কে আগে সবরকমভা‌বে নাটক হ‌য়ে উঠ‌তে হ‌বে।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ