রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ভারত’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২০

ভারতবর্ষ মুসলমানরা যদি শাসন ক‌রে থা‌কে সা‌ড়ে পাঁচ‌শো বছর, কম ক‌রে তার আগে আড়াই হাজার বছর শা‌সিত হ‌য়ে‌ছে ব্রাহ্মণ্যবা‌দের দ্বারা। মুস‌লিম শাস‌নে কি ভার‌তে স্বর্গরাজ্য স্থা‌পিত হ‌য়ে‌ছিল? না, মো‌টেই তা নয়। ‌কিন্তু মুস‌লিম শাসন কোথায় আলাদা ব্রাহ্মণ্যবা‌দের চে‌য়ে? কথাটা অন্নদাশঙ্কর রা‌য়ের ভাষায় বলা যাক। তি‌নি বল‌ছেন, কায়স্থ প্রভৃ‌তি জা‌তের লোকরা এই প্রথম মাথা তোলার সু‌যোগ পায়। ব্রাহ্মণ্য শাস‌নে শূদ্ররা সংস্কৃত ‌শিক্ষা থে‌কে ব‌ঞ্চিত ছিল, মুসলমান শাস‌নে তা হ‌লো না। তুর্ক মুঘল শাস‌নে হিন্দু‌দের ভা‌গ্যে যেসব পদ জো‌টে তা আর ব্রাহ্মণ ক্ষ‌ত্রিয়‌দের এক‌চে‌টিয়া থাক‌লো না, হিন্দু সমা‌জের নিম্নতর অংশও তার ভাগ পেল। মুস‌লিম শাসন এ‌দিক থে‌কে বৈপ্ল‌বিক।

নিম্নব‌র্ণের হিন্দুরা জাতপা‌তের হাত থে‌কে বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নির্যাতন আর অসম্মান থে‌কে রক্ষা পে‌তে এ সম‌য়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক‌রে। স্বামী বি‌বেকানন্দ বল‌ছেন, ভারতব‌র্ষে দেখা যায় যেখা‌নে ব্রাহ্মণের সংখ্যা বে‌শি সেখা‌নে নিম্নব‌র্গের মানুষ বে‌শি ইসলাম গ্রহণ ক‌রে‌ছে ব্রাহ্মণ‌দের অত্যাচার থে‌কে রক্ষা পে‌তে। কথাটা হ‌লো, মুস‌লিম শাস‌নে শুধু নয়; হিন্দুরা ধর্মান্ত‌রিত হ‌য়ে‌ছে ইং‌রেজ‌দের শাস‌নেও। ব্রাহ্মণ্য ধ‌র্মের ক‌ঠোর নিয়মকানুন আর নির্যাতন থে‌কে রক্ষা পে‌তে শুধু নিম্নব‌র্ণের হিন্দুরা নয়, উচ্চব‌র্ণের হিন্দুরা পর্যন্ত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ক‌রে। লক্ষ্য রাখ‌তে হ‌বে, ভারতব‌র্ষের মুসলমানরা তখন ধর্মান্ত‌রিত হয়‌নি, মা‌নে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ ক‌রে‌নি। ঘটনাটার তাৎপর্য বিরাট।‌

মুস‌লিম শাস‌নে নিঃস‌ন্দে‌হে অত্যাচার নির্যাতন ছিল, রাজ্য ছিল নির্যাতন ছিল না তা হ‌তে পা‌রে না। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবা‌দের শাস‌নে তা ছিল আরও বহুগুণ ভয়াবহ। ফ‌লে ব্রাহ্মণ্যবা‌দের ইতিহাস আলোচনা না ক‌রে ভারতব‌র্ষের ইতিহাস স‌ঠিক বা গভীরভা‌বে উপল‌ব্ধি করা বা ভারতব‌র্ষের ইতিহাসের নানা সঙ্ক‌টের উপসংহার টানা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলছে, বর্তমান ইরান বা পারশ্য থে‌কে আগত বৈ‌দিক আর্যরা ঋগ্বেদ রচনার প্রথম প‌র্বে ধর্ম বা জাতপা‌তের প্রশ্ন তো‌লে‌নি। ঋগ্বেদ তা প্রমাণ ক‌রে। প‌রে মনু সং‌হিতার মাধ্যম ব্রাহ্মণ্যবাদ এমন এক অত্যাচার চা‌পি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল, যার প্রে‌ক্ষি‌তে ভারতের মানুষ কখ‌নো ভ্রাতৃ‌ত্বের বন্ধ‌নে আবদ্ধ হ‌তে পা‌রে‌নি।

স্বভাবতই ভারত তাই সাম‌গ্রিকভা‌বে ঐক্যবদ্ধ সংহ‌তি প্রকাশ ক‌রে কখ‌নো বি‌দেশি দখলদার‌দের রুখ‌তে পা‌রে‌নি। বৈ‌দিক আর্যদের ইরান থে‌কে আগত বলা হ‌চ্ছে কেন? কারণ ইরা‌নের গ্রন্থ আবেস্তার স‌ঙ্গে বে‌দের নানা রকম মিল পাওয়া গিয়ে‌ছে। মুস‌লিম আরবরা প্রথম সিন্ধু প্রদেশ দখল ক‌রে তিন‌শো বছর শাসন চালায়। খুব সামান্য সংখ্যক মুসলমান বিশাল ভার‌তের এক‌টি প্রদেশকে তিন‌শো বছর দখল ক‌রে রাখ‌তে পে‌রে‌ছিল কেন? কারণ স্থানীয় নিম্নব‌র্গের হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবা‌দের বিরু‌দ্ধে মুসলমান শাসক‌দের সমর্থন জা‌নি‌য়ে‌ছিল। মুসলমানরা সিন্ধু প্রদেশে যেসব আইন প্রণয়ন ক‌রে, সেগু‌লি ব্রাহ্মণ্যবা‌দের ম‌তো বর্ণপ্রথা দ্বারা নিয়‌ন্ত্রিত ছিল না।

ব্রাহ্মণ্যবা‌দের বিধা‌নে ব্রাহ্মণ‌দের বিচার করার ক্ষমতা শূদ্রদের ছিল না, বাহ্মণরা শূদ্রদের হত্যা কর‌লে তার শা‌স্তি ছিল খুব সামান্য। ‌কিন্তু মুসলমান‌দের শাস‌নের বা বিচার ব্যবস্থার য‌তেই ত্রু‌টি থাক, কাউকে আইনের বিচারে আলাদা করা হয়নি। মুসলমানরা সমগ্র ভারত দখল করার বহু আগে গজ‌নির সুলতান মাহমুদ স‌তে‌রোবার ভার‌তের নানা জায়গায় হামলা চালায় লুণ্ঠ‌নের জন্য। ভারতের হিন্দুরা নানাভা‌বে চেষ্টা ক‌রেও গজ‌নির মাহমুদ‌কে কখ‌নো পরা‌জিত কর‌তে পা‌রে‌নি। বিশাল ভারতে মাহমুদ তত বে‌শি সৈন্য নি‌য়ে আক্রমণ চালা‌তো না, কিন্তু মাহমু‌দের চে‌য়ে অনেক বে‌শি সৈন্যসামন্ত নি‌য়ে ভারতীয় ‌বি‌ভিন্ন আঞ্চলিক শাসকরা বারবার হে‌রে গেল কেন? স্বভাবতই প্রমাণ ক‌রে, সেরকম সুগ‌ঠিত শাসন ব্যবস্থা ছিল না। জনগণ বি‌চ্ছিন্ন ছিল শাসক‌দের থে‌কে।

ম্যারাথ‌নের যু‌দ্ধে ক্ষুদ্র এথেন্স সামান্য সৈন্য নি‌য়ে বিরাট পারস্য বা‌হিনী‌কে হা‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল, শুধুমাত্র দেশ‌প্রেম আর জনগ‌ণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মধ্য দি‌য়ে। কিন্তু ভারত কুষাণ শক হুন কাউকেই কখনো প্রতিরোধ কর‌তে পা‌রে‌নি। সক‌লে তারা ভারত দখল ক‌রে একদা ভার‌তের সংস্কৃ‌তির ম‌ধ্যে এমন মি‌শে গি‌য়ে‌ছিল, তা‌দেরকে আলাদা ক‌রে প‌রে চি‌হ্নিত করা যায়‌নি। মুসলমানরা ভারত জয় ক‌রে ভারতীয় হ‌য়ে গিয়ে‌ছিল। সংখ্যায় কম থাকার জন্য শ‌াসক হ‌য়েও বড় বড় প‌দে তা‌দের শাস‌নে হিন্দুদেরই স্থান দি‌য়ে‌ছিল। কিন্তু ভারতীয় হ‌য়ে তারা আবার নি‌জে‌দের পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কর‌তে পে‌রে‌ছিল।

মুসলমানরা ভারত জয় ক‌রে অনেক প‌রে। ইসলা‌মের নবি মারা যাবার বিশ বছ‌রের ম‌ধ্যে তারা দখল ক‌রে নেয় বি‌শ্বের বিরাট এলাকা।‌ সি‌রিয়া, প্যা‌লেস্টাইন, ইজিপ্ট, পারস্য। কিছু‌দি‌নের ম‌ধ্যে আবার দখল ক‌রে আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, তারপর প্রবেশ ক‌রে স্পে‌নে। প্রথম ছিল আব্বাসিয়দের শাসন। ভারত যখন প‌রে তুর্কী‌দের দ্বারা দখল হয়, তখন তুর্কীরা আব্বাসিদের ম‌তো জ্ঞান‌বিজ্ঞা‌নের চর্চা আর প্রসার বাদ দি‌য়ে অনেকটা রক্ষণশীল হ‌য়ে প‌ড়েছিল। স‌ত্যি বল‌তে, এ তুর্কীরা ছিল আব্বাসীয় শাসক‌দের দেহরক্ষী বা গোলাম। ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তার কর‌তে কর‌তে তারাই এক‌দিন শাসক হ‌য়ে দাঁড়া‌লো। কিন্তু আব্বাসীদের ম‌তো জ্ঞান‌বিজ্ঞান চর্চার উদারতা বা আকাঙ্ক্ষা তা‌দের ছিল না। কিন্তু তা স‌ত্ত্বেও তারা কিছুটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ক‌রে‌ছিল।

কিন্তু প্রধান প্রশ্নটা, ব্রাহ্মণবাদ সারা ভার‌তে নিজধর্ম প্রচার ক‌রেও, কেন বাই‌রের শত্রুকে কখ‌নো রুখ‌তে পার‌লো না? প্রথম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় তা‌দের বিরু‌দ্ধে চার্বাক‌দের, প‌রে জৈন আর বৌদ্ধ‌দের। কিন্তু বিরাট শূদ্র সমাজ সেখা‌নে ব্রাহ্মণ্যবা‌দের বিরু‌দ্ধে কখ‌নো বি‌দ্রোহ করার সাহস দেখায়‌নি কেন? গ্রী‌সে রো‌মের ম‌তো সাম্রা‌জ্যে ক্রীতদাস‌দের বি‌দ্রোহ হ‌লো, সাম্রা‌জ্যের পতন ঘট‌লো। কিন্তু ভার‌তের শূদ্ররা তখন কিংবা আজ পর্যন্ত সেভা‌বে বি‌দ্রোহ কর‌তে পার‌ছে না কেন? ক‌ারণ ক্রীতদাসরা আইনের দ্বারা ক্রীতদাস হ‌য়ে‌ছিল, ধ‌র্মের বিধান দ্বারা নয়। সে আইনের বিরু‌দ্ধে ক্রীতদাস‌দের বি‌দ্রোহ কর‌তে সমস্যা হয়‌নি। ভার‌তে শূদ্রদের আর অন্তজদের ধ‌র্মের বিধ‌ান দি‌য়ে আটকে রাখা হ‌য়ে‌ছে, ফ‌লে ধর্মের সে বিধান অমান্য করার সাহস দেখ‌া‌তে পা‌রে‌নি। ফ‌লে ধর্ম ত্যাগ ক‌রে নি‌জে‌দের মু‌ক্তি খুঁজে‌ছে।

ব্রাহ্মণ্য ধ‌র্মের বিধা‌নের বিরু‌দ্ধে, ঈশ্বরের বিরু‌দ্ধে দাঁড়া‌তে তারা সাহস পায়‌নি। আজও পায় না অনেকে। সে কার‌ণে ভীমরাও আম্বেদকরের  ম‌তো মানুষ‌কে পর্যন্ত মারা যাবার আগে নিজ ধর্ম ত্যাগ ক‌রে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ কর‌তে হ‌য়ে‌ছিল। তি‌নি যে নির্মম নির্যাত‌নের শিকার হ‌য়ে‌ছি‌লেন, বর্ণ‌হিন্দু এমন‌কি নিম্নব‌র্ণের হিন্দু‌দের দ্বারা তা ভাষায় প্রকাশ করা ক‌ঠিন। বর্ণপ্রথা এমন নিম্নবর্ণ তার নিচের বর্ণ‌কে আবার ভয়াবহ অবজ্ঞা ক‌রে থা‌কে, কারণ ধ‌র্মের বিধান।‌ আম্বেদকরের  ম‌তো মানুষ তাই শেষ পর্যন্ত বি‌দ্রোহ কর‌তে পা‌রেন‌নি, আত্মসমর্পণ ক‌রে‌ছেন ধর্মান্ত‌রিত হ‌য়ে।

লেখক: সমাজ ও ইতিহাস গবেষক