
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ৩
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : মে ১৬, ২০১৯
দুই.
মায়ের সাথে ঈশান ছিমছাম একটা দুই বেডের বাড়িতে থাকে। ছোটবেলায় ঈশান বাবাকে হারায়। মা ধানমন্ডির একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিচার। নিজবাড়ি আর মায়ের চাকরির বেতনে ওদের দুজনের সংসার ভালোই চলে। তারপরও মা কষ্ট করে চাকরি করে সংসার চালায়, এটা ভাবলে ঈশানের মন খারাপ হয়। চাকরি-বাকরি অথবা অন্য কোনো পেশায় যেতে হলে ঈশানকে আরও অন্তত তিনটা বছর অপেক্ষা করতে হবে।
ঈশানের ইচ্ছে ছিল, কোনো পাবলিক ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হবে। মা রাজি হননি।পাবলিক ইউনির্ভাসিটির ছাত্র-রাজনীতি আর সেশন জট মায়ের দুঃচিন্তার কারণ। এ কারণে অনেক টাকা খরচ করে গুলশান কেন্দ্রিক একটা নামি প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিতে ঈশানকে ভর্তি হতে হয়েছে। ঈশানের সহপাঠিরা সবাই তথাকথিত আপার ক্লাশ পরিবারের সদস্য। ওদের লাইফ স্টাইল আলাদা। ঈশানের সাথে ওদের তেমন জমে না। এ কারণে ঈশান ঢাকা ইউনির্ভাসিটি আর আর্টস্ ফ্যাকাল্টির বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর আছে ওদের মধ্যবিত্ত পাড়াসম্পর্কিত বন্ধনগুলো এখানে এখনো অটুট। পাড়ার ভেতর ঈশানের আড্ডার জায়গাও আছে। সিনিয়র-জুনিয়র সবাই অনেক সময় এক হয়ে আড্ডা দেয়। পাড়ার সমস্যা, দেশের হালচাল, রাজনীতি সবই এই আলোচনায় উঠে আসে। পাড়ার ঠিক মাথায় হলুদ রংয়ের পুরানো মডেলের ইকবালভাই’র বাড়িটা এ ধরনের একটি আড্ডাখানা। প্রায় প্রতিদিনই ঐ বাড়িতে ঈশানের একপাক যাওয়া চাই। ভার্সিটি থেকে এসে প্রতি সন্ধ্যায় ঐ বাড়িতে কিছুটা সময় কাটিয়ে ঈশান বাড়ি ফিরে।
দুপুর থেকেই ঈশান একটা নুতন সুর নিয়ে মেতে আছে। গানের কথার সাথে সুরটা ঠিক মিলছে না। পঞ্চাশের ওপর বয়স ইকবাল ভাইয়ের-বিয়ে থা, সংসার কিছুই করেননি। সর্ম্পকিত এক বোনকে বাসাটা ভাড়া দিয়ে তিনি চিলে কোঠায় থাকেন। ছোট্ট রুমটায় গাদা গাদি করে রাখা বই আর পত্রপত্রিকা। ঘরটার মধ্যে ধূলা জমা। এই ধুলার মধ্যেই ইকবাল ভাই নির্বিকার ঘুমিয়ে থাকেন। কালেভদ্রেই এই ধূলা পরিষ্কার করা হয়। ইকবাল ভাই অনেক পড়েন, বলেন বেশি, কাজ করেন কম। সারাক্ষণই আকাশ পথে থাকেন। গাঁজার নেশাকে ইকবালভাই আকাশ পথ বলেন। ইকবাল ভাই একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। ইকবাল ভাই প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে প্রচুর মিথ্যা কথা বলেন। ইকবাল ভাইয়ের কোন কথা সত্য কোন কথা মিথ্যা সেটা ধরা খুব মুশকিল। সমবয়সিরা ইকবাল ভাইকে এড়িয়ে চলেন। ইকবালভাই সমবয়সিদের সাথে আড্ডা দিতে স্বাছন্দ্য বোধ করেন না। কারণ ইকবাল ভাইয়ের ভাষায় ‘ওদের হয়ে’গেছে। সন্তান উৎপাদন ছাড়া এদের আর কোন হ্মমতা নেই। এই সব লোকেরা আলু পটল আর তেল-নুন নিয়ে ব্যতিক্রম নিরামিষ জীব।
সুতরাং যাদের ‘হয়ে গেছে’ অথবা যারা ‘নিরামিষ’ তাদের বর্জন করাই উত্তম। আর তারুণ্য মানেই সম্ভাবনা। ইকবাল ভাই তরুণদের পছন্দ করেন। এ কারণে ইকবাল ভাইয়ের চিলেকোঠায় তরুণ-যুবকদের আড্ডা। কেউ আসে গাঁজা খেতে, কেউ আসে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে, অথবা কেউ গলা ছেড়ে গান গায়, কারও সাথে কারও বিরোধ নেই। ইকবাল ভাইয়ের মিথ্যাগুলোর মধ্যে একটা কল্পনার মিশেল থাকে। এ জন্য গল্পগুলো শুনতে বেশ লাগে। কিছুদিন আগে দেশে আধা সামরিক শাসনের সময় ইকবাল ভাই একদিন গম্ভীর ভাবে বললেন, ’আজ একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।’
’কি ঘটনা?’ সবাই সমস্বরে জানতে চাইল।
‘সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে আজকে একঘণ্টায় আটশো বস্তিবাসী ভ্যানিশ। জানিস তো ওখানে হাতিরঝিল প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এজন্য বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে। নুতন এক প্রক্রিয়ায় এই বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে থার্মাল ডিভাইস।’
‘সেটা আবার কি?’
‘এটা নিউক্লিয়ার বোমার সর্বশেষ সংস্করণ বলতে পারিস। এই বোমায় ধোঁয়া আগুন কিছুই হয় না। এক লাখ স্কোয়ার ফিট এলাকার বাতাস উপ্তত্ত হয় কেবল-ধর ঐ এলাকার গলনাঙ্ক দাঁড়ায় এক হাজার ডিগ্রি। সুতরাং ঐ এলাকার সব কিছু নিমিষে বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আটশত বস্তিবাসি কয়েক সেকেন্ডে শেষ। সব ঘটনা আমার এক বন্ধু দেখেছে। মোবাইল ফোনে ছবিও তুলেছে। কালকেই ঐ ভিডিও আমি পেয়ে যাব। আমেরিকানরা ঐ থার্মাল ডিভাইস ইরাকে ব্যবহার করবে, আফগানিস্তানে করবে। ইরানের ওপরও প্রয়োগ হতে পারে। বাংলাদেশে একটা প্র্যাকটিকেল পরিহ্মা করল আর কি!’
‘নির্ঘাত গুল।’ একজন বলল।
‘কালই ভিডিও চলে আসবে, মিলিয়ে দেখিস। তোদেরকে তো আইসিডিডিআরবির কথাও বলেছি। তোরা মিলিয়ে দ্যাখ।’
আইসিডিডিআরবি নিয়ে ইকবাল ভাইয়ের একটা আবর্জাভেশন আছে। ওখানে ডায়ারিয়ার উত্তম চিকিৎসা হয় বটে। তবে ওখানে রোগিদের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। মাল্টি-ন্যাশনাল ঔষধ কোম্পানীগুলো তাদের উদ্ভাবিত ঔষধ প্রথম ব্যবহার করে বানর, গিনিপিগ ইত্যাদি জীব-জন্তুর ওপর, তারপর বাংলাদেশ আর আফ্রিকার গরিবদেশের মানুষের ওপর। আইসিডিডিআরবির শাখা আছে আফ্রিকার কয়েকটি গরিবদেশে। যে সব দেশ গরিব ও সরকারগুলোর ওপর পশ্চিমারা মাতবরি ফলাতে পারে সে সব দেশেই ঐ প্রতিষ্ঠান কাজ করে। পৃথিবীতে বানরের পরই বাংলাদেশ আর আফ্রিকার গরিব মানুষের অবস্থান। আর উন্নতদেশের মানুষ দেবতার পরের ধাপ।
ইকবাল ভাইয়ের ধারণা, এদেশে যারা সরকার চালায় তারা পশ্চিমাদেশের এই সব ভয়াবহ পরীক্ষার কথা জানে। তবে ক্ষমতার লোভে চুপ করে থাকে। ইকবাল ভাই কট্টর মার্কিন বিরোধী আবার মাঝে মাঝে বলেন তিনি মার্কিন গ্রীন কার্ড হোল্ডার। বয়স ষাট হলেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবেন। ওখানে গিয়ে পলিটিক্স করবেন। সিনেটর হওয়ার চাঞ্জ আছে। রিপাবলিকানদের সাথে নাকি তার এ ব্যাপারে একটা এমওইউ হয়েছে। কারও সন্দেহ হলে তিনি সেই সমঝতাপত্র দেখাতে পারেন। তবে ইকবাল ভাইকে যারা জানেন তারা ইকবাল ভাইয়ের এসব কথা গোনায় ধরে না। ইকবাল ভাই অনেক কিছু নিয়ে গল্প ফাঁদেন, অনেক কিছু নিয়ে মসকরা করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কখনো কোনো গল্প করেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন নিজমুখে এমন দাবিও করেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ গল্প ফাঁদলে তিনি বিরক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ কিছু বানিয়ে বললে তিনি রেগে যান। এমনকি মারমুখি আচারণও করেন।
এই ইকবাল ভাইই ঈশানকে জন লেলনের কথা, বিটলস্’ এর কথা, যোয়ান বায়েসের কথা বলেছেন। ইকবাল ভাইয়ের গল্পে নিজের অজান্তেই ঈশানের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। ঈশান ইন্টারনেট ঘেঁটে এদের সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে। লেলনের গান, যোয়ান বায়েসের গান ডাউন লোড করেছে। এখন শুধু প্রেম গদগদ্ গান ঈশানের ভাল লাগে না। গতানুগতিক ধারার বাইরে কিছু একটা করার তাগিদ এসেছে। ঈশান একটা ভিন্ন ধারার ব্যান্ড গড়ার চেস্টা করছে। এ জন্যই দরকার নুতন ধারার, নুতন সুরের গান। ও যখন একটা মনের মত গানের জন্য হা-পিত্যেশ করছে তখনই কোন খেয়ালে ইকবাল ভাই ঈশানের জন্য চারটা গান লিখে ফেলেছেন। নুতন ধরনের কথা, নুতন ধারার গান। এ ধরনের গানই ঈশান চেয়েছিল। এ গানে ঠিকমত সুর দিতে পারলে ঈশানকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। ওদের ব্যান্ডটা দাড়িয়ে যাবে।
ধর্ম-ব্যবসায়ী তুমি দোজগ বেহশতের এক আজব কারবারী
তোমার জন্য গোশত পোলাও আমার পেটখালি।
চলবে