
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ৭
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : মে ২১, ২০১৯
ছয়.
খানের লোকটা চলে যেতেই জকি কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। লোকটা যেন একটা রবোট বিশেষ, কথা বলে যন্ত্রের মতো। কুতকুতে দুচোখের ভাষা সাংঘাতিক দুর্বোধ্য। এ ধরনের লোকেরাই মানুষ খুন করতে পারে। এই লোকটা খুনে কিনা কে জানে! জকির মতামত শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই লোকটার। লোকটা জকিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ইয়াবার ডিলার হতে হলে এই লোকটির প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। জকির মতো ছেলেকে পাত্তা দেয়ার কিছু নেই যেন! স্পষ্টত লোকটি জকির ওপর এখনই কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। এ ধরনের একটা ভীতিকর চরিত্রের সাথে কাজ করতে হবে জেনে জকি মনে মনে দমে যায়। তারপরও জকি নির্বিকার থেকে লোকটির প্রতিটি কথা মনযোগ দিয়ে শুনেছে কেবল। লোকটি যদি জকিকে বোকা ভাবে তাহলেই জকি জিতে যাবে। এখন সেই লোকটার প্রতিটি কথা বিশ্লেষণ করছে নিজের মতো। এই লোকটাকে ভবিষ্যতে ঘায়েল করার জন্য এখনই একটি সূত্র তৈরি করতে হবে। সময় ও সুযোগমতো সূত্রটা প্রয়োগ করতে হবে। তবে সূত্রটা পেতে হলে লোকটার একটা দুর্বল পয়েন্ট চাই। এখন এই পয়েন্ট আগে বের করতে হবে।
জকির ধারণাই ঠিক, খান এত সামান্য ব্যবসায় নামেনি। খান জকির ধারণার চেয়েও দেখছি অনেক গভীর জলের মাছ। এখন খানকে আর এড়িয়ে চলার উপায় নেই। জকি জলে নেমে গেছে এখন আর কুমিরের সাথে লড়াই করা চলে না। এখন যতটা সম্ভব ঝুঁকি মুক্ত থেকে নিজের স্বার্থ দেখতে হবে। বিশেষ ডিজে পার্টির দিন ইয়াবা হবে স্পেশাল। সেইদিন এই ইয়াবা বিতরণ করা হবে। আগামী এক মাসের প্রতিটি পার্টিতেই সবাই বিনা-আয়াসে ইয়াবা পাবে। তারপর প্রতিমাসে অন্তত দু হাজার কাস্টমার জোগাড় হবে। সময়ের সাথে সাথে এই জালটা বাড়তে থাকবে। সব ঠিকঠাক থাকলে ছয়মাস পর, প্রতিমাসে এককোটি টাকা প্রফিট করা সম্ভব। এক বছর এই ব্যবসা চালাতে পারলেই কেল্লা ফতে। এক বছর পরই হোটেল ব্যবসা শুরু করার মতো পুঁজি এসে যাবে। তখন জকি আর এই ঝুঁকির ব্যবসায় থাকবে না। এসব ব্যবসার ইতি ঘটিয়ে হোটেল চেইন শুরু করে দেবে। এলিজিবল ব্যাচেলার হওয়ার প্রথম ধাপ।
ওকারা নামের নতুন ক্লাবটা বেশ নাক উঁচু ভাব নিয়ে গুলশানে দাঁড়িয়ে আছে। দুগ্ধ-ধবল ক্লাব ভবনটা রাতের বেলা নানা-বর্ণিল আলোতে মোহনীয় হয়ে ওঠে। রাতের বেলায় পথিক মাত্রই মুগ্ধ চোখে ক্লাবটার দিকে তাকায়। ক্লাবটা ইদানীং এতই চলছে যে সহজে বুকিং পাওয়া যায় না। এরা নুতন ধরনের লাইট এন্ড সাউন্ড সিস্টেম এনেছে। ক্লাবের মালিকানার সাথে প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা জড়িত। হোমরা চোমরা না হলে এখানে কেউ পাত্তাই পায় না। জকি সরাসরি ম্যানেজারের রুমে ঢুকে গেল। নিজের নামটা বলতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। ডিসকো পার্টির জন্য সবচেয়ে বড় বল রুমটা নিমিষেই বুকড হয়ে গেল। নিঃসন্দেহে খানের ম্যাজিক।
ভারমুক্ত হয়ে শিস দিতে দিতে জকি ওকারা ক্লাব থেকে বেরিয়ে ওর লাল স্কোডার এক্সিলেটরে পা দিল। এখন দরকার একটা জুতসই ক্যাম্পেইন। জকি প্রকাশ্য কোনো ক্যাম্পেইনে যেতে চায় না। রূপনি নামের মেয়েটা ওর বড়শির টোপ গিলেছে। এই মেয়েটাকে পনের বিশটা ছেলেমেয়ে ঘিরে থাকে। রূপনিই ওদের ডমিনেট করে। ওদের সবার বাবারা বেশ শসালো-টাকাকড়ির পাহাড় গড়েছে একেকজন। এই সব টাকার পাহাড়ে নানা ধরনের ফাঁক-ফোঁকড় থাকে। জকি ভবিষ্যতে এই সব ফাঁক-ফোঁকড়গুলো জেনে নিতে চায়। আপতত এদের টাকার কিছু অংশ ডিজে পার্টির মাধ্যমে জকির পকেটে আসবে। এটাই মন্দ কি! রূপনিকে দিয়ে ওদেরকে দলে ভেড়াতে হবে। এই দলটা হবে ওর জালের প্রথম দিককার মাছ। সন্ধ্যায় রূপনির জন্য ওয়েস্ট ইন এ ক্যান্ডেল নাইট ডিনার। খরচটা জকি অন্যভাবে পুসিয়ে নেবে।
রূপনি যখন ওয়েস্ট ইন এলো তখন ছেলে-বুড়ো সবার ভিমরি খাওয়ার দশা। চোরাচোখে সবাই রূপনির দিকে তাকাচ্ছে। জকির কথা ভেবে রূপনি একটা স্পেশাল ড্রেস পড়েছে। এখানে আসার আগে বিউটি পার্লার হয়ে এসেছে। রূপনির বিকশিত সৌন্দর্যে জকি নিজেও পুলকিত। জকি নিজের সিলেকশনকে তারিফ না করে পারে না। এই মেয়েটার পাশে বসতে কার না ভাল লাগে! ডিনারের টেবিলে বসে জকির প্রধান কাজ হলো ধৈর্যশীলের শ্রোতা হওয়া। অভিজ্ঞতা থেকে জকি জানে, প্রথমদিন বেশি এগুতে নেই। আজকে দরকার মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন। এই জন্য মেয়েটার প্রতিটি কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। মাঝে মাঝে তারিফ করতে হবে। নিজের প্রশংসা শুনলে বিনয় দেখাতে হবে। আর নিজের লোনলি থাকার ব্যাপারটা কিছুটা করুন রস মিশিয়ে বলতে হবে। এতেই মেয়েটা গলে যাবে। ভবিষ্যতে এই মেয়েকে নানাভাবে কাজে লাগাতে হবে। জকি নিশ্চিত মেয়েটি এখন নানা স্বপ্নের জাল বুনছে। ‘সামনের মাসের আঠারোয় তোমার জন্মদিন। তোমার এবারের জন্মদিন একটু আলাদা হবে, ভাবছি কি করা যায়! চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে তোলে জকি। রূপনির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভালো লাগার অনুভূতি বয়ে যায়।
‘ইয়োরেকা! তোমার জন্মদিন হবে ওকারায়।’ জকি বলল।
‘আমি ভেবেছিলাম ‘অল ওয়েজ ফ্যানি’তে পার্টিটা হবে।’ রূপনি বলল।
‘ওটা এখন পুরানো হয়ে গিয়েছে। ওকারা নুতন এসেই একেবারে বাজার মাতাচ্ছে। ডিসকো থ্যাক, ক্যান্ডেল নাইট ডিনার, মাক্সিকান রেসেপি-একেবারে জোশস। কিভাবে যেন মিলে গেল। ওই দিন ওখানে ডিসকো পার্টি।
আমি অনেক ধরেকেটে মাত্র পাঁচটি টিকেট পেয়েছি। তোমার তো ম্যালা বন্ধু, কম হয়ে গেল! তোমার অন্য বন্ধুদের কি হবে?’ চিন্তিত স্বরে জকি বলল।
‘তাই তো আমাদের তো অন্তত বিশটা টিকেট দরকার। বিশটা পেয়ার। এখন উপায়?’ রূপনির কথায় হতাশা ঝরে পড়ে।
‘আমি অবশ্য জেনেছি কারা যেন এক সাথে অনেক টিকেট কিনে নিয়ে গেছে। এদের খোঁজ পেলে কাজ হতো-তোমার বন্ধুদের বল না একটু পাত্তা লাগাতে। আমি পেমেন্ট দিয়ে দেব। প্রতিদিন আমার হাজারটা হ্যাপা-একটু সময় পাচ্ছি না।’ জকি বলল।
রূপনি মুগ্ধ চোখে জকির দিকে তাকিয়ে থাকে। এসময় রূপনির ফোনটা বেজে ওঠে। রূপনি বিরুক্তি চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ঈশান, নুতন পরিচয় হওয়া সেই রোদে পোড়া ছেলেটা। এই সময় এই ছেলেটা ফোন করলো কেন? রূপনি ফোনের লাইনটা কেটে দিল।
চলবে