রূপনির রূপকথা

পর্ব ২০

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ১১, ২০১৯

২১.
মধ্য দুপুরে ইকবাল ভাইকে কবর দেয়া শেষ হলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ইকবাল ভাইয়ের শবযাত্রায় কালকের প্রতিবাদ সমাবেশের অনেকেই এসেছে। প্রচুর লোক ইকবাল ভাইকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার বাড়িতে গিয়েছে। শবযাত্রায় সামিল হয়ে আজিমপুর পযর্ন্ত এসেছে।  ইকবাল ভাইকে শ্রদ্ধা জানানো যেন ওদের প্রতিবাদেরই অংশ। ইকবাল ভাইয়ের লেখা গানটা এখন অনেকের মুখে মুখে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আগোছালো ইকবাল ভাই কোনো ধরনের ডকুমেন্ট রাখেননি। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের জন্য দৌড়াদৌড়িকে ঘৃণা করতেন। এজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ মরণোত্তর প্রাপ্য সন্মান তিনি পাননি। তাতে কি? ঈশানরা ইকবাল ভাইয়ের প্রিয় লাল সবুজ পতাকা দিয়ে তার কফিনটা ঢেকে দিয়েছে। আনা এই পতাকাটা চেয়েছে। দাফনের পর পতাকাটা সযত্নে সংগ্রহ করে ঈশান আনার হাতে তুলে দিয়েছে।

আনা আর ঈশান কালরাত থেকে এখন অব্দি ঘুম-বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। আনা এখন গাড়িতে বসে চোখ বন্ধ করে ক্লান্তি তাড়াতে চেষ্টা করছে। ইকবাল ভাইকে কবর দিয়ে ফেরার সাথে সাথে রাজ্যেও ক্লান্তি এসে ঈশানের ওপর ভর করল। এখন ঈশানের সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ইকবাল ভাইয়ের চিলেকোঠায় আর কখনো যাওয়া হবে না। ওদের ভিন্ন মাত্রার আড্ডাটা ভেঙে গেল।

ঈশান ওর মোবাইল ফোন ওপেন করলো। কয়েক ঘণ্টা ওর ফোনটা বন্ধছিল। সাথে সাথে ম্যাসেজ আসা শুরু করলো, প্রায় পনের-বিশটা। কললিস্ট চেক করতে গিয়ে ঈশান দেখলো, রূপনির কল। রূপনি দুদিন আগে ওদের সাথে মিছিলে না যেয়েই টিএসসি থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। এই ব্যাপারটা ঈশানের ভাল লাগেনি। যাক, রূপনিকে ইকবাল ভাইয়ের মৃত্যুর কথা বলা উচিত। ঈশান রূপনিকে ফোন করলো।

মোবাইল ফোনে রূপনির কণ্ঠ ভেসে এলো, ঈশান আমার খুব বিপদ। প্লীজ আমার বাসায় একটু আসো।

কথার সাথে সাথে মেয়েটা ফোঁপাচ্ছে। কাঁদছে বোধ হয়। ঈশান জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার?
প্লীজ একটু বাড়ি আসো। বলেই রূপনি ফোনটা কেটে দেয়।

আনা একটু নড়েচড়ে বসে, ক্লান্ত গলায় বলে, কার সাথে কথা বললি?
রূপনি যেতে বলল, খুব নাকি বিপদ।
চোখ বন্ধ করেই আনা বলল, এখন ওসব ছাড়, বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে নে আগে। এই সব পুতুপুতু মেয়ের অনেক অদ্ভুত সমস্যা থাকে। তিলকে তাল বানিয়ে ফেলে।
কিন্তু মেয়েটা কথা বলতে বলতে কাঁদছিল যে!
মেয়েরা কত ধরনের ন্যাকামিই না করে, মেয়েটা তোকে ফাপড় দিচ্ছে।

ঈশান আর কথা বাড়ালো না। ওদের বাড়ির মোড়ের কাছে গাড়িটা আসতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ঈশানের জন্য মা ভাত টেবিলে সাজিয়ে বসে আছে। মায়েরা কি ভাবে যেন সব কিছু আগেভাগে টের পায়। ভাত দেখতেই পেটের খিদে বেড়ে গেল। কালরাত থেকে পেটে কিছু যায়নি। গোছল-টোছল সেরে ভাত খেয়েই, ঈশান বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর জন্য দু চোখ বন্ধ করলো। ঈশান ভেবেছিল, শোয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসবে। ঘুম এলো না। শুধু ছটফটানিই বাড়ল কেবল! ঘরে থাকতে আর ভাল লাগছে না। ঈশান রূপনিকে ফোন করল। রূপনির ফোন বন্ধ। আচ্ছা ফ্যাকড়ায় পড়া গেল। এখন রূপনিকে পাওয়া যাবে কি করে! কল লিস্টে নোভার নব্বর বের করে নোভাকে ফোন করল। নোভা কাল রবীন্দ্র সরোবরের পুরো প্রোগামে ছিল। নোভা ফোন ধরল।

নোভা, আমি রূপনির সাথে কথা বলতে চাই। ওর ফোন এনগেজ পাচ্ছি। ওর কি অন্য কোনো নব্বর, ল্যান্ড ফোন নন্বর আছে তোর কাছে?
দোস্ত, এই মাত্র রুশনির সাথে কথা হলো। রূপনি সত্যি এক বিপদে আছে। কিন্তু এখন ওর সাথে যোগাযোগ করাও বিপদজনক।
কেন কি হয়েছে? কিসের বিপদ রূপনির?
তুই বোধ হয় দুদিনের কোন খবর রাখিস না! পত্রিকায় সব বেরিয়েছে, চ্যানেলগুলোতে দেখিয়েছে সব।
কি দেখিয়েছে বলবি তো!
লাল শুয়ারের কাহিনি বেরিয়েছে।
ঈশানের মনে পড়ল এই ধরনের এটা শিরোনাম যেন দেখেছিল গতকালের পত্রিকায়। বলল, কিন্তু এর সাথে রূপনির কি সম্পর্ক কি?
লাল-শুয়ারই হলো রূপনির বাবা। এক ডজন খুনের আসামি। গ্যাং স্টার। ভাবতে পারিস, একজন মোস্ট ওয়ান্টেড খুনির মেয়ে আমাদের রূপনি, আমাদের বান্ধবী!
তুই ঠিক বলছিস তো?
তাহলে আর বলছি কি! রূপনি আমাদের সবাইকে ফোন করেছিল, আমরা কেউ ফোন ধরিনি। এখন ভাবছি মোবাইলের সিমটা পাল্টে ফেলবো। রূপনির সাথে যোগাযোগ রাখতে গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ি! তুই ও আবার ফোন-টোন করে ঝামেলা পাকাস না। পুলিশ-র‌্যাব আর গোয়েন্দারা ওদের বাড়িটা ঘিরে আছে।
এ সব তুই কি বলছিস? বিস্মিত গলায় ঈশান বলল।
তুই পত্রিকা নিশ্চয়ই পড়িসনি! ভয়াবহ সব ব্যাপার।

ঈশান ফোনটা কেটে দিল। রূপনির দিকটা ভাবল, এই ধরনের পরিস্থিতিতে এই পুঁচকে মেয়েটা কি ভাবে সামলাবে? প্রতিদিনের সব বন্ধুরা ওকে এড়িয়ে চলছে। মেয়েটা কি ওর বাবার কুকর্মের সঙ্গী? চলবে