
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ২১
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ১২, ২০১৯
২২.
ভাগিস্য জিনিয়া আন্টি কাল খানের ওখানে গিয়েছে। এই তথ্য জানার পর জিনিয়া আন্টির সাথে স্পেশাল সেশন না হলে জকি শান্তি পাচ্ছে না। খানের সাথে একদিন মাত্র কথা হয়েছে। তারপর থেকে খানের লোকটার সাথে সব ডিল করতে হচ্ছে। এ লোক ওকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়াচ্ছে যেন! খানের ব্লেসিং পাওয়ার লোভে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খানের লোকটার খবরদারি জকিকে মেনে নিতে হয়েছে। জকির পারফর্মেন্সে খান খুশি কিনা জকি এখনো জানে না। যে লেনদেন হচ্ছে তার কতটা খান পায়, কে জানে! সবচেয়ে ভাল হতো যদি খানের এই মিডলম্যানকে সরিয়ে খানের সাথে সরাসরি ডিল করা যেত। এজন্য ফের জিনিয়া আন্টির সাহায্য দরকার। জিনিয়া আন্টিকে পটাতে হলে তাকে তোয়াজ না করে উপায় নেই। জিনিয়া আন্টিকে পটনোর জন্যই জকি সোনারগাঁওয়ে একটা রুম বুক করে ফেলল। তারপর এসে বসল হোটেলের লবিতে। জিনিয়া আন্টি এক দেড় ঘণ্টার আগে গুলশান থেকে আসতে পারবে না। সাজগোজ সারতে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। এ ধরনের দিনগুলোতে জিনিয়া আন্টি ন্যাকা সাজেন, নিজেকে ছুকড়ি বানাতে চেষ্টা করেন। জকির ঠিক সামনে বসে এক বিদেশিনী পিয়ানো বাজাচ্ছে। জকি একটা বিয়ারের অর্ডার দিল। ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে গত দুতিন মাসের ঘটনাগুলো রিসাফল করতে লাগল। দু-দিন ধরে টক অব দি টাউন হলো লাল শুয়ারের ধরা পড়ার ঘটনা। পত্রিকার পাতায় রূপনিদের বাড়ির ছবি দেখে আর ওর বাবার নানা কাহিনি পড়ে জকির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। নিজেকেও বোকা মনে হয়েছে। রূপনির সব তথ্য ওর কাছে থাকা উচিত ছিল, এজন্য জকিকে পস্তাতে হবে হয়তো। রূপনির কললিস্টে জকির ফোন নন্বর আছে। এছাড়া মেয়েটা হয়তো পুলিশি জেরার মুখে পড়বে। এই মেয়ের পক্ষে সত্য লুকানো কঠিন। জকিরও নামটা পুলিশের নজরে আসবে। তখন নাড়ি-নক্ষত্র জানতে পুলিশ পিছনে উঠে পড়ে লাগবে। জকি যতটা ভেবেছে বাস্তব পরিস্থিতি হয়ত তার চেয়ে খারাপ। এজন্য জকি সাবধানে থাকছে। রূপনি গতকাল অনেক বার জকিকে ফোন করেছে। জকি ফোন ধরেনি। তারপর কল লকই শুধু করেনি, ফোনের সিমটাই পাল্টে ফেলেছে। পরিস্থিতি ঘোলা হওয়ার আগে কয়েকদিনের জন্য দেশ ছাড়তে হবে। জকি বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে এই প্রস্তুতি নিয়েও ভাবছে।
এক ঘণ্টার মধ্যেই জিনিয়া আন্টি এসে হাজির। কড়া মেক-আপ নিয়ে তিনি বলিরেখা লুকাতে চেষ্টা করেছেন। বড় গলার ব্লাউজে তার ক্লভিজ স্পস্ট দেখাচ্ছে। খাঁজে ঝুলছে হিরের লকেট। জিনিয়া আন্টিকে ওয়েটার সালাম দিল, এধরনের সালাম তিনি উপভোগ করেন। এই হোটেল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জিনিয়া আন্টিকে চেনেন। তিনি প্রায়ই এই হোটেলে আসেন, রাত কাটান। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে। জকিকে দেখে জিনিয়া আন্টি কিশোরীর মতো উচ্ছ্বাস দেখিয়ে জকির মুখোমুখি বসল। এই আগে বলো তো, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে!
তোমাকে একেবারে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো লাগছে।
এই জকি গ্যাস দিবি না বলছি! নিজে দিব্যি গলা ভেজাচ্ছিস, আমারটা কই?
জকি ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল।
লার্জ সাইজটা, সাথে পাকুরা। ওয়েটারকে বিয়ারের ক্যান দেখিয়ে জিনিয়া বলল।
তুমি দেখি এখানে বসে সময়টা কাটিয়ে দেয়ার ধান্দা করছো।
তাই তো, এখানে ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে বাড়ি চলে যাই। জকিকে তাতানোর জন্য জিনিয়া বলল।
ট্যাক্সসহ আট হাজার টাকা পে করেছি রুমের জন্য। বাড়ি যেতে চাইলে পার্স থেকে হাজার দশেক বের কর দেখি।
কি ব্যাপার। খুব তেতে আছিস মনে হচ্ছে! তুই না সব খুকিদের সাথে ঘোরাঘুরি করিস, তোর খুকিরা কই!
তুমিই তো একটা খুকি, বয়স যেন প্রতিদিনই কমাচ্ছ। কিভাবে সব মেন্টেন কর কে জানে! জকি নিরীহ গলায় বলল।
হয়েছে তোকে আর পাকামো করতে হবে না। এখন বল তো কি কারণেই আজকের এই আয়েজন। জিনিয়ার কণ্ঠটা সিরিয়াস হয়ে ওঠে। জিনিয়া বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দেয়।
এমনি! অনেক দিন তোমাকে দেখি না জিনিয়া! জকি বলল। জকি আগে জিনিয়া আন্টি বলত। এখন আন্টি বললে জিনিয়া মাইন্ড করে। জিনিয়ার মেয়েটা জকির চেয়ে অন্তত চার বছরের বড়। এখন বরের সাথে লন্ডনে থাকে। জিনিয়ার মেয়ের বাচ্চা লন্ডনে পড়াশুনা করে। অথাৎ জিনিয়া একজন নানি বটে, এসব কথাগুলো জিনিয়া চেপে যায়। কেউ জিজ্ঞাস করলে নিজের বয়স চল্লিশ বলে চালিয়ে দেয়।
তুই দিন দিন জটিল হচ্ছিস, শুধু আমাকে দেখার ধান্দা তাই না! বলে ফেল, আমার কাছে অনেক তথ্যই আছে। তুই একেবারে টাশকি খেয়ে যাবি। তাঁর আগে দেখা যাক তুই আজ আমার জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছিস। লিকারে জিনিয়াকে ধরছে। ওর কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এখানে আর বেশিক্ষণ না বসল জকি। জিনিয়াকে নিয়ে ডিনারের জন্য ঝর্ণা রেস্টুরেন্টে গেল। এই বুফে জিনিয়ার খুব পছন্দ করে। বুফে খেতে খেতে জিনিয়া একটা বাচ্চা মেয়ের মত প্রগালভ হয়ে উঠল। কিছুটা জড়িত কণ্ঠে নিজের জীবনের নানা কথা, জকিকে তিনি কতটা ভালবাসেন ইত্যাদি বলে গেলেন। নিজের একদা নিস্কর্মা বরকে কোথা থেকে টেনে কোথায় তুলেছেন ইত্যাদি বলে গেলেন। জকি তাকে আগের মত সময় দেয় না দেখে দুঃখও পেলেন। কান্না আটকাতে রুমাল দিয়ে চোখও মুছলেন।
ডিনার শেষে দুজনে সপ্তম তলায় নির্দিষ্ট রুমটায় চলো এলো। জিনিয়া এসেই রুমের ছোট্ট ফ্রিজারটা খুলে রেড ওয়াইনের বোতলটা বের করল। জকি প্রমাদ গুণলো, জিনিয়া যেন এখন আকণ্ঠ মদে নিমজ্জত হতে চায়। একদিকে ভাল, এই বিশেষ অবস্থায় জিনিয়া আন্টি কথা পেটে রাখতে পারেন না। এই জকি, এ মাসে তুই কত টাকা কামিয়েছিস? বলবি না তো! আমিই বলি, তুই দশ লাখের ওপর কামিয়েছিস। খান আমাকে সব বলেছে। এখন আমাকে এক লাখ দিবি, টেন পার্সেন্ট আমার কমিশন। জড়িত গলায় জিনিয়া বলে। জিনিয়ার হিসাবটা শুনে জকি প্রমাদ গুনে। খান সঠিক হিসাবটাই দিয়েছে। তারমানে খানের লোকটা খানের সাথে নয় ছয় করেনি। এখন জিনিয়া টেন পার্সেন্ট কমিশন চাচ্ছে। এই বুড়িটাকে সব সময়ই টেন পার্সেন্ট কমিশন দিয়ে যেতে হবে নাকি! জকি কিছুটা ভাবনায় পরে। এই আবদার বজায় থাকলে ভবিষ্যতে জিনিয়াকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, হয়ত চিরতরে। জিনিয়াকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা জকির মাথায় সেট হয়ে গেল।
জিনিয়া আন্টি বালিশে মাথা দিয়ে রানি-মহারানিদের স্টাইলে আধ শোয়া হলেন। চূড়ান্ত ভূমিকায় যাওয়ার আগে তিনি এমনই করেন। তুই লাল শুয়ারের কথা তো জানিস। খান আমাকে কালকে অনেক কথা বলেছে। লাল শুয়ারের সাথে খানের অনেকদিনের সম্পর্ক। রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ীরা খানের শরণাপন্ন হলে খান লাল-শুয়ারকে কাজে লাগাতেন। লাল শুয়ারের রি-রোলিং মিল থেকে খান বছর খানেক আগে নয়-কোটি টাকার মাল বাকিতে নেয়। লাল-শুয়ার এই টাকার জন্য ইদানীং খানকে খুব চাপ দিচ্ছিল। এতেই লোকটা কপাল পুড়েছে। বুঝলি এখন লাল-শুয়ার ক্রসফায়ারে মারা যাবে। খানের নয় কোটি আর কোন এক মন্ত্রীর তের কোটি টাকা বেঁচে যাবে। লাল-শুয়ারের হুমকি আর থাকবে না। জিনিয়া একটু থামল, হয়ত জকির প্রতিক্রিয়া দেখল তারপর ঊরুর কাপড়টা কিছুটা সরিয়ে বলল, পাটা একটু টিপে দে তো, কেমন যেন যন্ত্রণা হচ্ছে।
লাল-শুয়ার কাহিনীটা শুনে জকি কিছুটা ঘাবড়ে যায়। রূপনি যে লাল-শুয়ারের মেয়ে এটা জিনিয়া জানে না। ভাগ্যিস জিনিয়া রূপনিকে চাক্ষুস দেখেনি। কোনোভাবে যদি খানের কানে কথাটা যায় তবেই সেরেছে! খান জকিকে শত্রুপক্ষ জ্ঞান করবে। পুলিশের চেয়ে খানকেই এখন বড় ভয়! ভেতর ভেতর জকি নাভার্স হয়ে উঠল। জিনিয়ার দিকে তাকালো, এখন জিনিয়াকে যত বিরক্তই লাগুক না কেন, জিনিয়াকে জকির প্রয়োজন হবে। আজ রাতে জিনিয়ার পেছনে বিশ-পঁচিশ হাজার নেমে গেলেও, যে তথ্যগুলো পাওয়া গেল তাতেই সুদ-আসলে ইনভেস্ট উঠে আসবে। জকি একটা গোলমাল পরিস্থিতি আঁচ পাচ্ছে। ঘটনা কোন দিকে যায় সেটা দেখার জন্য জকি অপেহ্মা করবে নাকি জিনিয়াকে নিয়ে কয়েকদিন গা-ডাকা দেবে। কোলকাতা অথবা ব্যাংকক! এসব ভাবতে ভাবতে জকি জিনিয়ার ঊরুতে হাত রাখে। জিনিয়া একটা বাচ্চা মেয়ের মত উ আহ্ করতে থাকে। কত ছলা-কলাই না জিনিয়া জানে! চলবে