
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ২২
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ১৩, ২০১৯
২৩.
রাত নেমে এলেও ঈশানের চোখে ঘুম আসছে না। গতকাল সারা রাত ওরা হাসপাতালে কাটিয়েছে। দিনটা শেষ হয়েছে ইকবাল ভাইকে সমাহিত করে। ইকবাল ভাই নেই, কথাটা এখনো ঈশানের বিশ্বাস হচ্ছে না। গলির মাথায় ইকবাল ভাই ঠিক দাঁড়িয়ে আছে, আসা-যাওয়ার পথে চিলেকোঠায় যাওয়া ওদের সবার অভ্যাস। ঈশান চিলে কোঠার দিকে তাকাল, কেমন যেন হলদে ম্যারম্যারে দেখাচ্ছে ভবনটা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভবনটার চেহারাও যেন পাল্টে গেছে! কয়েকটা ঘণ্টায় কেমন পাল্টে গেছে পৃথিবী! অন্যদিকে মারাত্মক এক বিপদে আছে রূপনি। আজ রূপনির সাথে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। আগামীকাল যেভাবে হোক রূপনির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে হবে। বিপদ হলে, হবে। আনার সাথে রূপনির প্রসঙ্গটা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। এত রাতে আনার ঘুমিয়ে পড়ার কথা, তবু ঈশান ফোন করলো। মাত্র দুবার রিং টোন বাজতেই আনা ফোনটা ধরল। তার মানে আনা এখনো ঘুমায়নি।
আনা বলল, আমিই তোকে ফোন করতাম। আমার খুব অস্থির লাগছে রে ঈশান। লালনের ভাস্কর্য আমরা রক্ষা করতে পারলাম না। মাঝখান থেকে ইকবাল ভাইকে হারাতে হলো। মিছিলে না এলে ইকবাল ভাইয়ের হয়তো এই ম্যাসিভ অ্যাটাকটা হতো না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে রে। আমাদের সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, আমার আর ভালো লাগছে না। কথা বলতে বলতে শেষদিকে আনার গলাটা ধরে আসে, বোধ হয় কাঁদছে।
একটু সময় নিয়ে ঈশান সংক্ষেপে রূপনির সমস্যাটা আনাকে বলল। আনা বলল, ঈশান, এখন আর আমার মাথা কাজ করছে না। তারপরও মনে হচ্ছে, তোর কিংবা আমাদের যাওয়া উচিত। বাচ্চা একটা মেয়ে, জীবনে ভাজা মাছটাও উল্টে খায়নি। এই সমস্যা থেকে ও কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে! আমি তোর সাথে যাব। তোর কথা শুনে মেয়েটার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।
ঠিক হলো, আগামী কাল সকালেই আনা আর ঈশান গুলশানে রূপনির বাসায় যাবে। পরদিন সকালে ঈশান ও আনা ওই বাড়ির গেটে কলিং বেল চাপার অনেক পর গেটের আড়াল থেকে কেয়ার-টেকার গোছের একলোক ওদেরকে নানাভাবে জেরা করল। ঈশানের সাথে আনাকে দেখে একটু নিশ্চিত হলো যেন। তারপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রাখার পর গেট খুলল। লোকটি ভীতু চোখে ওদের দেখছে। তারপর ধীর পায়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। বিশাল বাড়ি। সুনসান নীরবতা হোক অথবা মানসিক কারণেই হোক ঈশানের কাছে বাড়িটা এখন ভূতের বাড়ির মতো মনে হচ্ছে। লোকটি ওদেরকে বিশাল ড্রইং রুমে নিয়ে বসালো। অনেকক্ষণ পর দোতলা থেকে যিনি নেমে এলেন তিনিই যে রূপনির মা এতে কোন সন্দেহ নেই। রূপনির চেহারার সাথে যথেষ্ট মিল আছে। তবে এখন পরোপুরি বিধ্বস্ত, চোখের নিচের কালি দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি রাতে ঘুমাননি। তারপর ভেতরের জমে থাকা প্রাণ শক্তি এক করে তিনি নিজেকে ঠিক রাখার প্রাণপণ চেস্টা চালাচ্ছেন। ঈশান আর আনা ভেবে পাচ্ছে না কিভাবে কথা শুরু করবে। রূপনির মাও কি যে বলবেন ভেবে পাচ্ছেন।
আনাই প্রথমে মুখ খুলল, আন্টি, রূপনিকে একটু ডাকুন। আমরা ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই।
রুপনি সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। এখন ঘুমাচ্ছে, তারপরও আমি ডেকে দিচ্ছি। এ কয়েকদিন থানা-পুলিশের লোকজন আর উটকো সাংবাদিক ছাড়া কেউ এই বাড়িতে আসেনি। আমাদের যেন দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার তো জীবন শেষই, এখন ভাবনা রূপনিকে নিয়ে। কখন যে কী হয়ে যায়! অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন রূপনির মা। তিনি রূপনির ঘুম ভাঙাতে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর রূপনি এলো। দুদিনেই যেন অর্ধেক হয়ে গেছে। রূপনির ঠোঁটে সব সময়ই ঈশান হাসি দেখেছে। আজ রূপনির সেই হাসিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এক বন্ধু এসেছে একথা বলে মা যখন ওকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, তখন রূপনি ভেবেছিল নিশ্চয়ই জকি এসেছে। অন্য সবার মতো রূপনি ঈশানকে রিং করেছিল। ঈশানের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। এই ঈশান যে চলে আসবে সেটা রূপনি মোটেই ভাবেনি। আনাকে দেখে রূপনি বিস্মিত। রূপনি মনে মনে আনার ভক্ত। কী অদ্ভুত আনার গলা! আর কেমন ড্যাম কেয়ারভাবে কত কিছু করে বেড়ায়! রূপনির তুলনায় আনা কত স্বাধীন। আনার জগৎটা কত বড়! আনার কাছে রূপনির নিজেকে ছোট লাগে। যাই হোক, পাপার ঘটনার পর রূপনির সবচেয়ে খারাপ লেগেছে ওর বন্ধুরা কেউ ওর পাশে নেই বলে। এমনকি জকি ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। জকি দেশের বাইরে চলে গেল কিনা কে জানে! সে হ্মেত্রে রূপনিকে জানানোর কথা আর হতে পারে জকি নিজেই কোন বিপদে পড়েছে। জকিকে নিয়েও রূপনির ভাবনা হচ্ছে। ঈশান কিংবা আনা রূপনির নতুন বন্ধু। ওরা ঠিক এসেছে। পুরানো বন্ধুরা কেউ এলো না বলে ওদের ওপর রূপনির খুব অভিমান হচ্ছে। ঈশান, আনাকে অনেক কিছু বলতে চাইলেও রূপনি কিছুই বলতে পারলো না। সে কেবল বলল, আমার পাপা, আমার পাপা, বলে হু হু করে কেঁদে ফেলল।
ঈশান কিংবা আনা কিছুই বলতে পারলো না। আনা উঠে গিয়ে রূপনির পিঠে হাত রাখলো। রূপনির কান্না যেন আর থামে না। চলবে