রূপনির রূপকথা

উপন্যাস ২৩

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জুন ১৪, ২০১৯

২৪.
রূপা বেগম আর পারছেন না। তিনদিনে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেননি। ডিবি অফিসে যেতে হয়েছে। নানা ধরনের জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় লাল শুয়ারকে নিয়ে নানা ধরনের কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে। লাল শুয়ার যাদের হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা লাল শুয়ারের ফাঁসির দাবিতে রাজপথে মিছিল করেছে। স্মারকলিপি দিয়েছে। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, রূপা বেগমের প্রথম স্বামী রিয়াজুলের হত্যাকারী হিসাবে লাল-শুয়ারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হবে। রিয়াজুলের পরিবারের কোনো এক সদস্য নাকি এই মামলা করবেন। স্বল্পতম সময়ের বিবাহিত জীবনে ওই পরিবারের কাউকে তেমন করে চেনার সুযোগ হয়নি রূপা বিবির। যে নামটি ছাপা হয়েছে সেই নামের কাউকে চেনা মনে হচ্ছে না। হতে পারে, কোনো সুযোগ সন্ধানি, পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার ধান্দা করছে। পত্রিকায় লিখেছে, রূপা বেগমকে আসামি করা হতে পারে। সেই থেকে রূপা বেগম গ্রেফতার আতংকে ভুগছেন।

ডিবি অফিসে রূপা বিবিকে অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। ডিবি অফিসের সামনে সাংবাদিকরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক ঠেলাধাক্কা খেয়ে পথ চলতে হয়। অনেকেই নানা ধরনের টিটকারি টিপ্পনি দিয়েছে। রাজপথে জনতা যদি রূপা বেগমের পরিচয় পায় তবে কপালে নিশ্চিত গণপিটুনি। রূপনির জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন। রূপা বেগম লাল শুয়ারকে কখনো ভালবাসেনি। তারপরও মানিয়ে নিয়েছিলেন, বাধ্য হয়ে অথবা জৈবিক প্রয়োজনে। কিন্তু যেদিন রূপা বেগম জেনেছিল লাল-শুয়ার একজন খুনি সেদিন থেকে স্বামীর জন্য তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রাথর্না ছিল একদিন লাল-শুয়ার এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ুক, তার প্রাপ্য শাস্তি জুটুক। এখন কেন যেন হচ্ছে, প্রাপ্যের চেয়ে বেশি শাস্তি পাচ্ছে লাল-শুয়ার। লাল-শুয়ারের সাথে একটুকু দেখা করার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে মাথা কুটেছে, কাজ হয়নি। পুলিশ কাস্টরি থেকে লাল-শুয়ারকে এখনো কোর্টে সোপর্দ করা হয়নি।

লাল-শুয়ার ভাল আছে, রূপা বিবির সাথে দেখা হয়েছে এসব কথা রূপনিকে বানিয়ে বানিয়ে বলতে হয়েছে। মেয়েটা বাবার সাথে দেখা করার জন্য জিদ ধরেছে। এখন ওকে কিভাবে সামলাবে! অক্টোপাসের বাহুর মতো একের পর এক বিপদ রূপা বেগমের ওপর চেপে বসেছে যেন! সারারাত রূপা বিবি দুচোখ এক করতে পারেন না। রূপনি একটা ছোট্ট মেয়ের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা কখনো কেঁদে ওঠে, আবার কখনো খলখলিয়ে হাসে। রূপা বেগম মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নেন। ওকে জাগাতে চেষ্টা করেন। ঘুম ভেঙে গেলে রূপনি ফ্যালফেলিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কোনো ঘোর থেকে জেগে উঠেছে। তারপর ‘পাপা’ ‘পাপা’ বলে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ওঠে। রূপা বেগম মেয়েকে শান্ত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। কাজ হয় না, রূপনি শান্ত হয় না। তারপর রূপনিকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এভাবেই রাত পার হয়, সকালের সূর্য যেন নতুন আতংক নিয়ে এ বাড়িতে আলো ছড়ায়!

রূপনির সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের মধ্যে একজন হলো রুশনি। রুশনির মা সব কিছুতেই এগিয়ে থাকতে পছন্দ করে। দেহের এখানে ওখানে বিপুল চর্বিকে উপেক্ষা করে এখনো তিনি তরুণীর মতোই ছোটাছুটি করে দিন পাড় করেন। প্রতিদিনই তিনি শপিং করেন, সামান্য জিনিস কিনতে দু চার ঘণ্টা পাড় করে দেন। রুশনিদের কলেজের পারেন্টস্ ডে তে পুরো কলেজ মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। ইদানীং তিনি পারেন্ট কোটায় ভার্সিটি ম্যানেজিং কমিটিতে ঢোকার ধান্দা করছেন। এহেন রুশনির মা জলি বানু যখন জানলেন রূপনির বাবাই লাল শুয়ার, তখনই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। প্রথম শাসালেন মেয়েকে, রুশনি যেন কোনোভাবেই রূপনির সাথে সম্পর্ক না রাখে। তার মেয়ে এক খুনির মেয়ের সাথে এতকাল চলাফেরা করেছে এটা ভাবতেই নাকি তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার যোগাড়। তারপর মোবাইল ফোনে কথা বলা শুরু করলেন রুশনির অন্য সহপাঠীদের মায়েদের সাথে। ঘণ্টাখানেক ঝাড়া টেলিফোন বকবকানির পর তিনি ছুটলেন রূপনিদের ভার্সিটিতে।

রূপনিদের কলেজের ভেতর পারেন্টদের হুটহাট করে ঢোকার নিয়ম নেই। জলি বেগম আজ যথেষ্ট উত্তেজিত। এ কারণে দারওয়ান তাকে আটকাতে সাহস পেল না। তিনি সরাসরি প্রিভির রুমে ঢুকে গেলেন। কি ম্যাডাম, আপনারা নাকি এরিস্টকেট ফ্যামেলি না হলে তাদের ছেলেমেয়েদের এই ভার্সিটিতে ভর্তি করান না। এখন কি হলো! কোনো সময় না নিয়েই জলি বানু বললেন। প্রিন্সিপাল কথার মর্মাথ বুঝলেন। এরপরও বললেন, আপনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন?

খুনির ছেলেমেয়েদের সাথে কি আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে হবে! আমি লাল-শুয়ারের কথা বলছি। এমন একটা খুনির মেয়েকে আপনারা কিভাবে আডমিট করলেন! আমি জানতে চাচ্ছি রূপনির ব্যাপারে আপনি কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?
আমি যত দূর জানি, রূপনি আপনার মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। রূপনিকে নিয়ে অন্তত আপনার সমস্যা হওয়ার কথা না।
এই কারণেই আমার এত মাথাব্যথা। রুশনি রূপনির বেস্ট ফ্রেন্ড এটা ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
রূপনি কিন্তু একটা ভালো মেয়ে। ভিসি হালকা সুরে বলল। ভিসি এই ধরি মাছ না ছুঁই পানি ব্যাপারটা জলি বেগমের ভাল লাগল না। তিনি ফুঁসে উঠলেন, শুনুন ম্যাডাম, আমি অন্য গার্ডিয়ানদের সাথে কথা বলেছি। রূপনিকে এই ভার্সিটি থেকে এক্সপেল করতে হবে। সম্ভব হলে আজই। না হলে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাল থেকে আর এই ভার্সিটিতে আসবে না।

এত তাড়াতাড়ি কি এই সিদ্ধান্ত নেয়া যায়! মেয়েটা তো অপরাধ করেনিম, ওর একাডেমিক ইয়ার নষ্ট হবে।
আপনি কেন মেয়েটার পক্ষ নিচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের ডিসিশন আপনাকে জানিয়ে গেলাম। আপনি আজকের মধ্যেই আপনার ডিসিশন জানান। জলি বানু ভিসিকে আর কোন সুযোগ দিতে চাইলেন না। হিল ঠকঠক করে যোদ্ধার মত দ্রুত চলে গেলেন। জলি বানু কলেজ কম্পাউন্ডের বাইরে এসে দেখলেন, তার ফোনে কাজ হয়েছে। অনেক ভাবিই চলে এসেছে। এমন একটি ঘটনার পর চুপচাপ বাসায় বসে থাকা যায় না। খুনির মেয়ে হিসাবে রূপনির কলংক তাদের ছেলেমেয়ে গায়ে কতটা লেগেছে তার একটা হিসাব নিকাশ চলছে। জলি বানু নিজের বুদ্ধিকে নিজেই বাহবা দিলেন। ভাগ্যিস তিনি আগেভাগে ভিসির সাথে কথা বলে এসেছেন। এখন তিনি সবার থেকে এগিয়ে আছেন। লীডারশীপ তো এভাবেই নিতে হয়!

লাল-শুয়ারকে নিয়ে প্রচারিত বিভিন্ন ঘটনার পর্যালোচনা শেষে একজন ভাবি উঠালেন রূপনির মা রূপা বেগমের কথা। এই মহিলা এত অহংকারী যে, সবার সাথে ঠিকমতো কথাই বলতে চাইতো না। রূপনির মা নিশ্চয়ই এ সব দুস্কর্মের ভাগিদার। অন্য ভাবিরা তাকে সমথর্ন করলেন। জলি বানু তাদের দাবি-দাওয়া একটা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে চাইলেন। তিনি ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে নাটকীয় ভাবে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিলেন। কাগজে সবার স্বাক্ষর সংগ্রহের পর কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য আলোচনা শুরু করলেন। অনেক তর্ক বিতর্কের পর সবাই একমতে পৌছলো যে, রূপনিকে আর সময় নষ্ট না করে আজই বহিষ্কারের ঘোষণা দিতে হবে। নয়তো আগামীকাল থেকে কোনো ছাত্রছাত্রী ক্লাশে আসবে না। চলবে