
রূপনির রূপকথা
উপন্যাস ২৭
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : জুন ১৮, ২০১৯
২৮.
রুশনি ওর মা জলি বানুকে রূপনির কথা বলতেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। রূপনির বাসায় যাওয়া তো দুরের কথা, ওর সাথে টেলিফোনে কথা বললেও রুশনির খবর আছে। রুশনির বাবা এখনও এসব জানে না। রুশনি বাড়াবাড়ি করলে ওর বাবাকে সব জানানো হবে। এ ধরনের একটা ফ্যামিলের মেয়ের সাথে রুশনির সম্পর্ক কিভাবে হলো, তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। রুশনির ফ্যামিলি হলো এদেশের দশটা খানদান ফ্যামিলির একটা। রুশনির কারণে এখন গোটা ফ্যামিলির সম্মান ভূলুণ্ঠিত হতে চলেছে। রুশনির মা প্রায় ঘণ্টাখানেক একটানা বকবক করে গেলেন। রুশনি আর কিছু না বলে নিজের রুমের পড়ার টেবিলে বসে কাঁদতে লাগল।
দুরুদুরু মনে রুশনি দিনের প্রথম ক্লাসে বসল। কালরাতে রুশনি অনেক ভেবেছে, একটা কিছু না করলে শান্তি পাচ্ছে না। এখন মনের জোর বাড়াতে নানা চেষ্টা করছে। কোনোভাবেই নার্ভাস হওয়া যাবে না। আজ প্রথম ক্লাস সাদিয়া ম্যাডামের। তিনি এমনিতেই একটু কড়া। পান থেকে চুন খসলে গার্ডিয়ানদের তলব করেন। যা হয় হবে, প্রথম ক্লাসেই ব্যাপারটা ঘটাতে হবে।
ম্যাডাম ক্লাসে এসে সবাইকে বসতে বলে পড়াতে যেই শুরু করলেন, অমনি রুশনি এক্সকিউজ মি বলে দাঁড়িয়ে গেল। ম্যাডাম ভ্রু কুঁচকে রুশনির দিকে তাকালেন, বললেন, প্লীজ ক্যারি অন।
ম্যাডাম, আমাদের বন্ধু রূপনিকে ভার্সিটি থেকে বের করা হয়েছে।
তো, ম্যাডাম একটু অবাক হয়ে রুশনির দিকে তাকালো।
আই প্রটেস্ট, রূপনিকে বের করার প্রতিবাদে আমি এখন আর ক্লাস করবো না। এই বলে রুশনি প্রায় কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসের বাইরে চলে গেল। ম্যাডাম একটু অবাক হয়ে রুশনির গমন পথের দিকে তাকালেন, তারপর পড়ায় মন দিলেন। রুশনি কমন রুমে গিয়ে বসে রইল। পরের ক্লাশ জামান স্যারের, তিনি হিউমার খুব পছন্দ করেন। রুশনি এবার তেমন ভয় পেল না। স্যার কিছু বলার আগেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একই কথা বলে গেল। জামান স্যার অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। রুশনির দু সারি পেছনে বসেছিল রুমকি। রুশনির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রুমকি দাঁড়িয়ে গেল। রুমকি রুশনির কথার জের ধরে বলল, আই এলসো প্রটেস্ট। এ কথা বলে রুমকির পেছনে এসে দাঁড়ালো। জামান স্যার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এনি আদার?
বাকিরা কেউ কোন কথা বলল না। স্যার বই খুলতে খুলতে আপন মনে বললেন, এক্সাইটিং ভেরি এক্সাইাটং। রুশনি আর রুমকি হাত ধরাধরি করে বাইরে চলে এলো। আরেকটা ক্লাসে রুশনি, রুমকি যখন ক্লাশ বয়কটের জন্য দাঁড়িয়েছে, তখন গোটা ক্লাশের ছেলেমেয়েরা ওদের সাথে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই একসাথে কথা বলায় খলবলিয়ে উঠল যেন গোটা ক্লাস রুমটা। এই ক্লাসের ম্যাডাম এমনিতেই একটু নার্ভাস ধরনের, তিনি অবাক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসম রুম থেকে চলে যেতে দেখলেন। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সবাই কমন রুম আর ক্যান্টিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল। বিগত মাস খানেক সময়ের মধ্যেই ওরা রূপনিকে ভুলে গিয়েছিল। এখন সবার আলোচনায় রূপনি ফিরে এলো। রূপনির বাবার অপরাধে রূপনি কেন শাস্তি পাবে? ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আর গার্ডিয়ানরা রূপনিকে বের করে দিয়ে খুব খারাপ একটা কাজ করেছে। রূপনিকে ওর মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সবাই একমত হলো রূপনির অধিকার ফিরিয়ে না দিলে ওরা কেউ আর ক্লাসে ফিরে যাবে না।
একজন প্রস্তাব করলো, চল আজ সবাই দল বেধে রূপনিকে দেখতে চাই। এই প্রস্তাবের পর সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। সবার মধ্যে অনুশোচনা বোধ কাজ করতে লাগল। গার্ডিয়ানদের কারণেই হোক অথবা ভয়েই হোক ওরা রূপনির দুঃসময়ে রূপনির পাশে থাকেনি। এমনকি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেনি। এখন কোন মুখে ওরা রূপনির মুখোমুখি হবে? ইলা নামের স্বল্পভাষি মেয়েটি, যাকে ওরা ‘ম্যাডাম’ বলে, দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ঢংয়ে বললো, আমরা আজ আর রুপনির বাসায় গিয়ে কাজ নেই। আগামিকাল আমরা এক্সপালশন উইথড্র করে সবাই মিলে রূপনির সবায় গিয়ে ওকে দারুণ সারপ্রাইজ দেব। ইলার কথাই সবাই হাততালি দিয়ে সমথর্ন করলো। ওদের সমাবেত হাততালির দরুণ সারা ভার্সিটির ছন্দপতন হলো। হচ্ছেটা কি জানতে অনেকেই ওদের দিকে ছুটে এলো। একটি ছেলে গলায় গেয়ে উঠল, উই শ্যাল ওভার কাম। সাথে সাথে কোরাস ধরল অনেকে। কেউ একজন একটা গিটার নিয়ে এলো। পুরো সমাবেশের চেহারাটাই পাল্টে গেল। যে যা পারে গাইতে লাগল, মাঝে দু একটা বক্তব্য।
রুশনি এতটা আশা করেনি। রুশনি ভেবেছিল, এভাবে প্রতিবাদ করলে ওকে রূপনির মতো ক্লাস থেকে বহিষ্কার করা হবে। রুশনি এটাই চেয়েছিল এক্সপেল্টড হলে রূপনির কাতারে দাঁড়নো যেত, অন্তত রূপনির দুঃখটা শেয়ার করা যেত, মায়ের একটা শিক্ষা হতো। এখন ঘটনাটা কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে। রুশনির মাথায় আর এখন কাজ করছে না দেখা যাক আগামিকাল কাল কি ঘটে! এই ভার্সিটি দশবছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। গতকাল ফাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্টরা ক্লাশ বয়কট করেছে। আর আজ গোটা ভাসির্টির কেন স্টুডেন্টই ক্লাশে যায়নি। করিডোর, ক্যান্টিন, কমন রুমে জটলা করছে। দু একজন টিচার এসে ওদের ক্লাশে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। রূপনির এক্সপালশন উইদ্ড্র না করা পর্যন্ত কেউ ক্লাসে যাবে না। অবশেষে সব সিনিয়র টিচাররা মিলে ভিসির রুমে গেল। ভিসি রূপনির ব্যাপারে নমনীয় হলেও তার হাত-পা বাঁধা। পাবলিক ইউনিভারসিটিতে গার্ডিয়ানদের গুরুত্ব না দিলেও চলে। এখানে গার্ডিয়ানদের কথায় অনেক কিছু করতে হয়। তারপর আছে পরিচালনা পরিষদ, যারা এখানে ইনভেস্ট করেছে। ব্যবসায় ক্ষতি হবে এমন কাজ তারা অনুমোদন দেবে না। রূপনিকে ভার্সিটি ফিরিয়ে নিয়ে এলে অনেক গার্ডিয়ান তাদের সন্তানদের এখানে আর পড়াবেন না। টিউশন ফিসহ বিশাল এক অর্থঝুঁকিতে পড়বে এই প্রতিষ্ঠান। এই ভার্সিটির গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো অন্য ভার্সিটিগুলো এই সুযোগটা লুফে নেবে। এমন হলে পরিচালনা পরিষদ ভিসিকে অপসারণ করতে দ্বিধা করবে না। অন্যদিকে স্টুডেন্টদের আচরণও বেশ মারমুখি। এখন একমাত্র উপায় হলো, গার্ডিয়ানদের তলব করা। তারাই তাদের সন্তানদের সাথে বোঝাপড়া করে পরিস্থিতি সামাল দিক। স্টুডেন্টদের এ সব কথা বুঝিয়ে বলার জন্য দুজন জনপ্রিয় শিহ্মককে দায়িত্ব দিয়ে ভিসি মিটিং শেষ করলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর ভিসি তার ভাবনায় ডুবে গেলেন। লাল শুয়ার যার আসল নাম মহব্বত আলি তিনি বিভিন্ন সময়ে এই ভার্সিটিতে মোটা ডোনেশন দিতেন। ভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাস ভবনে নির্মাণের জন্য দু মাস আগে লাল শুয়ার মোটা টাকা ডোনেট করেছে। এখন আর এ সব কথা প্রকাশ্যে বলে যাবে না। কোনো ডকুমেন্ট থাকলেও সরিয়ে ফেলতে হবে। ভিসি কয়েকটি ফাইল টেনে নামিয়ে ডকুমেন্ট খুঁজতে লেগে গেলেন। চলবে