খালিদ

খালিদ

রেজা ঘটকের গদ্য ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০২৪

দুঃখ কী হিমালয় হয়ে আসে! খালিদ ভাইকে নিয়ে আমার দীর্ঘ স্মৃতি। নব্বইয়ের শেষের দিক থেকে খালিদ ভাইয়ের সাথে আমার ওঠাবসা। দ্য অ্যাংরি ম্যান উইথ এ সিজার! অধিকাংশ সময়ে খালিদ ভাইকে আমি কাঁচি হাতে দেখতাম। মনে হতো এই তো সেই ঠাকুর বাড়ির মালী! দেখা হলেই আমাকে নিয়ে গলির ভেতরে একটা ঘরে হারিয়ে যেতেন। তারপর আর ঘড়ির কাঁটা চলতো না। আড্ডা আর আড্ডায় কয়েক ঘণ্টা চলে যেত।

খালিদ ভাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। খুব ভালোবাসতেন। কখনোই খালিদ ভাইয়ের ভেতরে আমি কোনো ধরনের অহংকার দেখিনি। বাজারের জনপ্রিয় তারকা ব্যান্ড সিংগার অথচ তার কোনো ধরনের অহংকার নেই। এই বিষয়টা আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করতো। একেবারে মাটির মানুষ। বয়সের কোনো বেড়ি না রেখেই খালিদ ভাই আমার সাথে নির্ভেজাল আড্ডা দিতেন। আমিও খালিদ ভাইকে খুব ভালোবাসতাম।

৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে খালিদ ভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে। সেদিন ছিল জি-সিরিজের কর্ণধর নাজমুল হক ভুঁইয়া খালেদ ভাই`র জন্মদিন। সেদিন ছিল জি-সিরিজেরও ৪১তম জন্মদিন। জি-সিরিজে খালেদ ভাই`র রুমে খালিদ ভাই`র সাথে সেদিনই শেষ মোলাকাত। জি-সিরিজে তখন ঈশা খান দূরে ভাই`র নেতৃত্বে পুরান ঢাকার বড় বড় ডেকচিতে ভুরিভোজের আয়োজন। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের সবাই সেখানে উপস্থিত।

দীর্ঘ প্রায় আট বছর পর সেই আড্ডায় আবার খালিদ ভাইকে পেলাম। মাঝখানের সময়টুকু খালিদ ভাই আমেরিকা প্রবাসী ছিলেন। খালিদ ভাই আমাকে আদর করে ডাকতেন ঘোটক। আমি খালেদ ভাইকে বলে বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু খালিদ ভাইকে দেখিনি। পেছনে থেকে ওস্তাদ চিৎকার দিলেন, কীরে ঘোটক, তুই এক খালেদকে কইলি, আরেক খালিদকে দেখলি নাহ!

আমি ঘুরেই খালিদ ভাইকে আলিঙ্গন করলাম। দীর্ঘ আট বছরের আপডেট মাত্র কয়েক সেকেন্ডে চুকে গেল। আমরা চলে গেলাম আমাদের পুরানো আড্ডায়। একবারও মনে হয়নি মাঝখানের আট বছর খালিদ ভাইয়ের সাথে আমার একবারও দেখা হয়নি। সেই চিরচেনা আদর, সেই শান্তিলাগানো মায়ার টান, সেই আবেগভরা দরদি ডাক, ঘোটক, সেই ভালোবাসায় পূর্ণ স্নেহ, সেই সারা দিন হারিয়ে যাবার গান, সব যেন মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আবার আমার বুকের পাঁজরে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

ওস্তাদ আমাকে একটা আদেশ দিয়েছিলেন। আমার শুটিংয়ের ব্যস্ততা থাকায় ওস্তাদের আদেশ পালনে আমি ব্যর্থ হয়েছি। ওস্তাদের সেদিনের সেই আদেশের কথা সৌরভ জানতো। সৌরভ সেদিনও আমাকে কইলো, ওস্তাদ তোমারে খুঁজতেছে। আজকে সন্ধ্যায় সৌরভ আবার ফোন করে জানালো, খালিদ ভাই নাই। পৃথিবীতে এরচেয়ে মহাবিস্ময় আর কী হতে পারে! সেই সন্ধ্যা থেকে আমি আর চলার শক্তি পাচ্ছি না খালিদ ভাই। আমাকে ক্ষমা করে দিও ওস্তাদ!

কোনো কারণেই
কোনো কারণেই ফেরানো গেলো না তাকে
ফেরানো গেল না কিছুতে
কোনো বাঁধনেই
কোনো বাঁধনেই
বাঁধা তো গেল না তাকে
বাঁধা তো গেল না কিছুতেই।

সে যে হৃদয় পথের রোদে
একরাশ মেঘ ছড়িয়ে
হারিয়ে গেল নিমিষেই
কি কারণ যায়নি সে বলে
কি ভুল আমি করেছি ভুলে
অজস্রবার আমি ক্ষমা চেয়েছি নিজে জ্বলে
সে যে হৃদয় পথের রোদে
একরাশ মেঘ ছড়িয়ে
হারিয়ে গেল নিমিষেই।।

নিঃসীম আঁধারে পথ চলা
নিজের সাথেই কথা বলা
বিষণ্ণতা বন্ধু যখন চেতনাতে
সে যে হৃদয় পথের রোদে
একরাশ মেঘ ছড়িয়ে
হারিয়ে গেল নিমিষেই...

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা