শামীম রেজা

শামীম রেজা

শামীম রেজার কবিতা: গুহাচিত্রে শায়িত সোনা বউ

কাজী নাসির মামুন

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০২৪

গুহাচিত্রে শায়িত সোনা বউয়ের সঙ্গে প্রত্ন-অভিসারই হচ্ছে শামীম রেজার কবিতা। ‘সেই সোনা বউ’র মুখ বড় বেশি নদীবিধৌত। সেই নদী আবার উত্তাল ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত নয়, সেটাও বুঝি। একটা নিস্তরঙ্গ সন্তাপের মতো প্রাচীন স্মৃতির সংরাগে ভরা সেই ঢেউয়ের গোঙানি। ভাঙনের প্রসঙ্গ যে নাই, তা নয়। কিন্তু নদীর প্রসঙ্গে যখন সাঁকোর অনুষঙ্গ এনে তিনি বলেন:

ও কৃষাণবালা, ভাঙনের নদী আমি ভাঙি দুই ধার
সাঁকোর বাহুতে রাখি বাহু
তুমি সাঁকো আমি সওয়ার

তখন নদীর পরিসর ছোট হয়ে যায়। খালের নিস্তেজ জলের কথা মনে পড়ে। কেননা সাঁকো সেখানেই মানায়। তাই বুঝে ফেলি, এ ভাঙন আসলে তার মনের। নদী ভাঙনের চেয়ে সে ভাঙন আরও বেশি দ্যোতনা ছড়ায়:

ও কৃষাণবালা, দেখে যাও তুমি
দুই হাতে গড়ি আমি ভাঙনের নিত্য আয়োজন।
 ভাঙনের নিত্য আয়েজন/পাথরচিত্রে নদী কথা

তার নিজের কবিতার পঙক্তির মতোই আমারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, বালক মাঝি কতটা জলে কেটেছো সাঁতার? তখন নিজেই উত্তরটা পেয়ে যাই। তার নদী তো পাথরচিত্রের নদী। সংলগ্ন অভিজ্ঞতার অনুবর্তী নয়। মনে পড়ে আল মাহমুদের একটা বক্তব্যে শুনেছিলাম, তাকে এক চাকরির ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশের নদী সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের এমন কোনো প্রধান নদী নেই যেখানে আমি সাঁতার কাটিনি।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতায় যে শক্তিশালী অনুভূতির কথা বলেছেন, তা সংলগ্নতার গুণে রূপরসস্পর্শগন্ধময় হয়ে উঠবার কথা। শামীম রেজা সেই নদী সংলগ্নতা জানান দেননি তার কবিতায়, যা তীব্র অনুভূতিতে ছেয়ে ফেলবে আমাদের। বরং নদী তার চৈতন্যের সারথি। তার বিদগ্ধ মননে নদী প্রত্নস্মৃতিময় পৌরাণিক অভিধার মতো লেগে থাকে। তাই কবিতায় তিনি নদী পরিবেশক, কিন্তু হৃদয়ে নদী পরিবেষ্টিত নন বলে মনে হয়। মৃতদের পাঁজরের দাঁড়টানা বাতাসে কীর্তনীয়া নদী কীর্তনখোলায় উঠে উত্তাল ঢেউ— এতগুলো শব্দ পেরিয়ে নদীর ঢেউ যেন আর গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে না।

কিন্তু এ কথা নিশ্চিত বুঝতে পারি, নদী ও নদীবিধৌত জনপদের প্রতি অপরিসীম টান তার আছে। নাগরিক বৈদগ্ধ্য এড়িয়ে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ভূগোল ও পুরাণের মিশেলে তার কবিতার পরিমণ্ডল। সুদূর পরাহত একটা আদিম বৃত্তের মধ্যে কি এক রহস্য ছড়াতে চায় তার কবিতা। কিন্তু ভাঙনের হাজারটা সমন পেয়ে যেন সেই রহস্যও ভেঙে ভেঙে যায়। তাই পরগাছা হয়ে কেটেছে যার/একটা জীবন তিনি ঠিকই বুঝে ফেলেন— পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে থাকলে/ঘিরে ধরে প্রেমহীন অন্ধকার। পরজীবী চাঁদের আলোয়/নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে

তখন ঠিকই সংলগ্নতাকে টের পান তিনি। আত্মদংশন শুরু হয়:
থুর থুরে সন্ধ্যা হেঁটে যায়
যার কোষে—কসাইয়ের ছুরি আর একটুকরো কাঠের
মধ্যে-সময় শুধু সে বোঝে—; ক্ষুধার্ত মা আমার
কুলা হাতে রাত্রি ঝেড়েছিলেন, চিটাধান—অন্ধকার; অতঃপর
আমার জন্মদিন বেঁধে রাখি অদ্ভুত তারকাটায়...
            কালিঘাটের পটচিত্রের ভিতর।

‘কুলা হাতে রাত্রি ঝাঁড়া’র চিত্রকল্প ব্যাপ্ত ব্যঞ্জনায় ছেয়ে থাকে। পাঠকের জন্য যা নিঃসন্দেহে উপাদেয়। এই মাতৃ সংযোগের সূত্র ধরেই তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং সংলগ্ন সত্তার গান এইখানে পাথরচিত্রে আর স্থির থাকেনি। অনেক বেগবান হয়েছে:

শান্তিয়ানো নদীর পাশে ঘুরে ঘুরে ঘুঘুপথ বাঁক নেয় দূর—
    অজানায়, আমি ভোরের বুঁছনায় কতটা কাঁঠালি চিংড়ি
    বেঁধেছে—আর কতটা বা বুঁইছা মাছ তা দেখার
    কৌতূহলে মেহগনি বনের ধারে চুপ হয়ে বসি, বসে থাকি
                    যোজন-যোজন বছর অফুরন্ত মহাকালের পারে; একটি
                    হাত স্পর্শ করে থেমে-থাকা বিরল রোদ্দুর ভিজতে থাকি
                    ধূমল রোদ্দুরে, সেই হাতের খোঁজে ডোগা-থোর-ধান
                    এসে মুছরে পড়ে হৃদয়ের অন্দরে
                      শান্তিয়ানো নদীটি দেখিনি কোনদিন/নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে

প্রত্নঘোরের মধ্যে তার যে-আচ্ছন্ন চোখ সেখানে আমলকি পাতার অন্তরালে দূর্বারঙের মুখ, জলঝিঁঝির ডাক, ডাহুকের ডাক, বাবলার ছায়ার অন্তর্বাস, ধানময়ী পথরোখা, ভাদ্রের রাত্রের বৃষ্টিসঙ্গমে ক্লান্ত আউশ, মেঠো সাপ, বেলকুঁড়ি-ফোটা সকাল, রূপচাঁদা মাছের সাঁতার, কাঁটালতা ঝোপঝাড় ছুঁয়ে কুঁড়েঘর, আমফুল সুবাস, চালতাপাতা ভোর, নাইওর গেছে এমন মেয়ে, কাঁঠালমুচি ভর্তা, নকশীকাঁথা ইত্যাকার গ্রামীণ অনুষজ্ঞ প্রত্ন-প্রাচীনতাকে ভেঙে দৃষ্টির বিস্তৃতি তুলে ধরে।

এরকম গ্রামীণ আবর্তে বাংলা সাহিত্যের অনেক কবিই তাদের স্বাচ্ছন্দ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে শামীম রেজা নিজের স্বকীয়তাকে উসকে দিয়েছেন। এ পর্বে এসে দার্শনিকতার প্রজ্জ্বলন লক্ষ্য করি তার কবিতায়। যখন তিনি বলেন: সব নদী কি পারে মরে যেতে তার নিজস্ব ইচ্ছায়, যদি না সমুদ্র ডাকে অবহেলায়? অথবা যখন বলেন: আল্লাহর অধর স্পর্শ করে শপথ করছি/যাহা বলিব সত্যি বলিব— সত্যি ছাড়া মিথ্যা বলিব না/কারণ আল্লাহ মানুষে বিরাজমান, অমানুষে নয়।’ তখন একটা মরমি চিন্তার রেশ আমাদের পুলকিত করে।

কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, প্রাচীন বিষয়াদির সঙ্গে সমসাময়িকতার একটা ভারসাম্যমূলক মেলবন্ধন তৈরি করেননি শামীম রেজা তার কবিতায়। মনে হয় বর্তমানে পা ফেলে প্রাচীন অনুষঙ্গে বিমুগ্ধ রয়েছেন তিনি। তাই সমসাময়িকতা একটু আড়ালে পড়েছে বটে। কিন্তু বোধের জায়গায় তার কথক সর্বদাই আধুনিক। যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে এসে তিনি আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে একটা দুর্মর নিরীক্ষা চালালেন। এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় কারো কারো মন মজেছিল আগেও। কিন্তু ততটা বিস্তৃতি নিয়ে সেই চেষ্টা কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আমাদের স্মরণে আসতে পারে পরাণের গহীন ভিতর । কিন্তু সেখানেও এতোটা বিস্তৃতি নেই।

একবার কমলদহে প্রিয়তমার শরীর দাহ
হলে কমলারঙের আগুন ছড়ায়েছিল পূর্ণতোয়ার জলে,
আর আমি সেইদিন থেইকা সাঁতার কাটছি আগুন-জলের
ভিতর, তাতেও মৃত্যু আসে না,
এমন পৃথিবীতে ঘুম আসে না— মৃত্যু আসে না।
        যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নগরে: এক

এই যে, ‘মৃত্যু না আসা’ পৃথিবীর কথা বললেন শামীম রেজা, এইখানে তিনি নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে গেলেন। আগের দুইটি কাব্যগ্রন্থ থেকে এখানে তার কাব্যিক উল্লম্ফন নান্দনিক বিভায় উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এখানে তার পরিচয় শুঁড়িখানার ঠিকানা হারানো বালক, এক অজানা খাঁচায় নিজেরে খুঁইজা মরেন। এই আত্ম-ক্ষরণের ভাষায় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন শামীম রেজা। কিন্তু ‘ঘুম না আসা’ পৃথিবীর বোধ অথবা ‘শুড়িখানায় হারানো বালক’—এর ধারণা কোন আঞ্চলিক খাঁচায় বন্দী ব্যক্তিমননের নয়। কেননা, ‘সমুদ্রের কাছে গেলে অস্থির লাগে কেন বলো? অথবা পাহাড়ে উঠতে ক্লান্তি লাগে তবু কেন মানুষ পাহাড়ে ওঠে— এ ধরনের প্রশ্নবাণ নাগরিক ও শিক্ষিত মননের দিকে ইঙ্গিত করে।

বোধের জায়গায় আঞ্চলিকতার সীমাকে ডিঙিয়েছেন তিনি। আর ভাষাটাকে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জের মতো। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষাও সর্বময় সদ্ব্যবহার পেয়েছে এমন মনে হয় না। যখন বাত্তির নাইমা আসে আমাদের আদিম পৃথিবীতে হাইপার রিয়ালিটি নামে, এই ‘হাইপার রিয়ালিটি’ আঞ্চলিক সৌন্দর্যকে ভেঙে দেয়। তাই ভাষা ব্যবহারে কোথাও কোথাও আরোপন জেঁকে বসেছে। গীতিময়তা তখন একটা দুর্গতিতে ঠেকে। ফলে ‘সময় প্রাজ্ঞ বিচারক’ এই বেদবাক্যে বিচারের ভার সোপর্দ করেও কোথায় যেন বলে উঠে মন:

এই জনপদে তুই ছাড়া আর কোনো নদী নাই ও কুমারী
নদী দোয়েলা আমার। তুই কি জানো তোর চোখে ঘুমায়
বৃষ্টিমাসী সকাল, ইমনরাগে সন্ধ্যা জাগে কণ্ঠে তোমার।
আর আমি দুইলা উঠি অন্ধ জোছনায়। দুধালি লতায়
আলোর বর্ষণ হলে তোর চুলগুলো আকাশের নাহান
খোলে। তোর মধু আলতা শরীরের ভাঁজে জোছনা
উঁকিঝুঁকি মারে বাত্তির শাখায়।
                             যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নগরে: ৯

শামীম রেজার নিজের কল্পনায় সৃষ্ট দোয়েলা নদীর এই শীতল ব্যঞ্জনা অনাবিল প্রমোদ জাগায়। বরিশালের আঞ্চলিকতায় ‘তুই’ ‘তুমি’র অবিবেচনা দুধালি লতায় যেন আমাদেরও বেঁধে ফেলে কাব্যের আনন্দে। এই শিল্পিত আনন্দের দায়ে হয়তো সময় একদিন তাকেও সমর্থন দেবে। আপাতত অপেক্ষায় থাকি।

লেখক: কবি