শ্রেয়া চক্রবর্তীর গল্প ‘পটাইদা’

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২২

পাশের পাড়ার ফুলটুসির টেলারিংয়ের দোকান। ঝপাঝপ সালোয়ার-কামিজ, ব্লাউজ ও ফ্রক, মানে মেয়েদের নানা পোশাক সেলাই করে দ্যায়। আর সেসবের ডিজাইনও দারুণ। ফুলটুসির সাথে পটাইদার অ্যাফেয়ারটা পটাইদার বউ ঊমাবৌদি নিজের হাতে ধরে ফেলেছে। রোজ বিকেল হতে না হতেই পটাইদার উশখুশ... একটা সিগ্রেট কিনতে যাচ্ছি বলে দু’ঘণ্টার জন্য হাওয়া। একদিন পটাইদা সিগ্রেট কিনতে বেরিয়েছে আর ঊমাবৌদি সেই ফাঁকে গেছে ফুলটুসির টেলারিংয়ের দোকানে ব্লাউজের ডেলিভারি নিতে। সামনেই পুজো। এবার পাঁচটা শাড়ির সাথে ম্যাচিং পাঁচটা ব্লাউজ আগেভাগেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছে ঊমাবৌদি। নাহলে সময়মতো ডেলিভারি পাওয়া মুশকিল।

দোকানে পৌঁছে ঊমাবৌদি দ্যাখে দোকান খোলা। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ইতিউতি উঁকি মেরে ঊমাবৌদি হঠাৎ খেয়াল করল, দোকানের পেছনদিকে পর্দা দেওয়া যে অংশটায় ব্লাউজের মাপ নেয় ফুলটুসি, সেখানে পর্দার আড়ালে কী যেন নড়ছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকতে ঊমাবৌদি সটান দোকানে ঢুকে পর্দাটা একটু ফাঁক করতেই যা দেখলো তাতে তার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু ঊমাবৌদির দজ্জাল গিন্নি হিসেবে পাড়ায় সুনাম। পটাইদা একবার কাজে যাচ্ছি বলে তিনদিন পর বাড়ি ফিরেছিল। ঊমাবৌদি পটাইদাকে চারদিন দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, পাড়ার মোরলদের সাক্ষী রেখে দশবার কান ধরে ওঠবস করে তবেই পটাইদা ঘরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল।

এবার তো আর রক্ষে নেই! প্রথমে চুলের মুঠি ধরে ফুলটুসিকে দমাদ্দম মার। তারপর সারা রাস্তা নাকে খৎ দিতে দিতে পটাইদাকে বাড়ি নিয়ে এলো ঊমাবৌদি। তাতে কী আর শান্তি হয়? আশপাশের বাড়ির লোক কিল চড় ঘুষির শব্দ, বাসন ছোঁড়ার আওয়াজ, ‘শূয়োরের বাচ্চা তোমার একদিন কী আমার একদিন...’ জাতীয় উৎপাতে শিটিয়ে ছিল প্রায় সপ্তাহখানেক। তারপর যা হয়, কানাঘুষো, ঠাট্টা তামাসা, হাসাহাসি পটাইদাকে নিয়ে রকের আড্ডায় লেগেই রইল।

এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু মাস। প্রথম প্রথম ফুলটুসিকেও যথেষ্ট অপমান সহ্য করতে হয়েছে। পাড়ার মহিলারা ব্লাউজের ডেলিভারি নিতে এসে শুনিয়ে গেছে যত কথা, ‘তুমি কেমন মেয়ে মানুষ গো! একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের...।’ ফুলটুসি এসব কথার কোনো জবাব দ্যায়নি। যার যা জিনিস তাকে ধরিয়ে দিয়ে নীরবে টাকা গুণে নিয়েছে। এদিকে ঊমাবৌদির স্পর্ধা আর রণরঙ্গিনী মেজাজের কথা আলোচ্য হয়ে উঠেছে। এবাড়ির বউমাকে তেলে মাছ ভাজতে দিয়ে জানলা দিয়ে ওবাড়ির ডালে ফোরন দেওয়া মাসিমাকে বলতে শোনা গেছে, ‘শুনেছেন তো মাসিমা, আমাদের ঊমাবৌদি সাক্ষাৎ মা দুর্গা। দিয়েছে লম্পটটাকে আচ্ছা ধোলাই। এইরকম বউ ঘরে ঘরে দরকার।’ পাড়ার মহিলা সমিতি থেকে এসে মেম্বার হওয়ার টিকিট ধরিয়ে দিয়ে গেছে ঊমাবৌদির হাতে।

এদিকে ফুলটুসিও দমবার পাত্রী নয়। সে নিয়ে এসেছে নতুন ধরনের লেহেঙ্গা চোলির ডিজাইন। নাম দিয়েছে, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’। এবার পুজোর জন্য অর্ডার দিতে পাড়ার কমবয়সী মেয়েদের লাইন পড়ে গেছে।

ফুলটুসির দোকানের ছ’সাত বাড়ি পরেই তুলসিদার আদি টেলারিং শপ। ফুলটুসি দোকান খোলার পর থেকে তুলসিদার দোকানে অর্ডার আসে কম। পাড়ার মেয়ে বউরা ফুলটুসির দোকানেই ভিড় জমায়। এবার তুলসিদাও নিয়ে এসেছে ব্লাউজের নতুন ডিজাইন। নাম দিয়েছে, ‘সতির বুকের পাটা’। সেই ডিজাইনে ব্লাউজ বানানোর জন্য ভিড় জমিয়েছে পাড়ার বৌদি, মা আর মাসিমারা।

এসবের মাঝখানে পটাইদা কোথায় যেন হাওয়া! সেদিন বিকেলে আমরা পাড়ার ক্লাবের সদস্যরা বসে এই নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছি। হঠাৎ একটু দূরে দেখা গেল এক ভদ্রলোক। মাথা ন্যাড়া, গোঁফ দাড়ি কামানো, চোখে কালো চশমা। থলে হাতে নিয়ে উদাস মনে চলেছে। আমাদের মধ্যেই পাড়ার রতন হৈ হৈ করে উঠলো, ‘আরে আরে ওই তো পটাইদা। চুল দাড়ি সব কেটে ফেলেছে।’ বলতেই সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

পটাইদার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি এসবে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে হেঁটে চললেন। যেন মোহমুক্ত সন্ন্যাসী। থলে হাতে হেঁটে চলেছেন নির্বাণের পথে।