সমরেশ মজুমদারের গল্প ‘অক্টোপাস’

প্রকাশিত : মার্চ ১০, ২০২২

কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্মদিন আজ। ১৯৪৪ সালের ১০ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘অক্টোপাস’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:


এই মেঘ অসময়ের। তবু দু-দুটো দিন এঁটুলির মতো লেগে আছে আকাশের গায়ে। অভিরাম ভেবেছিল ঝড়ো বাতাস নুনের ছিটে দেবে। কিন্তু দুটো দিনরাত কাটল, কেটেই গেল।

যে কোনও মুহূর্তেই মেঘগুলো জল হয়ে নামতে পারে। ব্যস, তাহলে আর রক্ষে নেই। সব গেল। এ যেন সব পাট চুকিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া বুড়ি মেয়েছেলেদের শরীরে নতুন আঁচড় পড়ার মতো ব্যাপার। ঝরেও ঝরে না জল, শুধু খটাং-খটাং শব্দ বাজে মেঘের হাড়ে-হাড়ে। যৌবনের কাঠঠোকরা বড় মারাত্মক। ঠুকে-ঠুকে ঠোঁট ভোঁতা তবু অভ্যেস মরে না।

তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে অভিরাম। চারপাশের জঙ্গলটাও থম মেরে আছে। মেঘ দেখলেই, গাছের পাতা অসাড় হলেই পাখিগুলোর গলা পালটিয়ে যায়। জঙ্গলের শরীরে কালো রং লাগে, সেই রং বোধহয় পাখিদের শ্বাসে মাখামাখি হয়। তিনযুগ হয়ে গেল এই ভারতবর্ষের জঙ্গলে কেটে গেল অভিরামের, চরিত্র বোঝা এখনও হয়ে উঠল না। লোকে বলে মেয়েমানুষের মন নাকি দেবতারাও জানে না, হয়তো কিন্তু একটা সোমথ জঙ্গলের মন চরিত্র বোঝ দেখি কেমন হিম্মত?

পুরুষ্টু টাকের মতো কিছুটা খোলা জমি, তার একদিকে অভিরামের তাঁবু। ওপাশে চালার নিচে আগুন জ্বলে, রান্না হয়। ছয়জন মানুষ খায়-দায়-শোয়। রাত্রে নেশা করে, দিনে পরিশ্রম। গুনতিটা ঠিক হল না। ছয়জনের মধ্যে দুজন এখন ব্যতিক্রম। সম্পূর্ণ সন্ন্যাসীর জীবন তাদের। ঠিক মধ্যিখানে একটা কাটা গাছের গুঁড়িতে শেকলে বাঁধা হীরামতি। এখন ওদের সর্বাঙ্গে কাদা মাখা। শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে, চাপড়া বেঁধে ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। ওদের বয়স হয়েছে, বেশ বয়স। অভিরামের কাছেই রয়ে গেছে অনেক বছর। এখন ওদের নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। হাতি দুটোও অভিরামের মনের কথা টের পেয়ে যায় বেশ।

অভিরাম ও-দুটোর পাশে এসে দাঁড়াতেই খুঁড়জোড়া তাকে ছুঁয়ে গেল। পায়ে শেকল বাঁধা কিন্তু ঘুরতে ফিরতে অসুবিধে নেই। জোড়া হাতি অভিরামের শরীরে আদর ছড়িয়ে দিয়ে শব্দ করল। যেন নিশ্বাসে জানাল, বয়েস হয়ে গিয়েছে গো, তোমার এবং আমাদেরও। এই পুরুষ এবং স্ত্রী হাতি দুটো অনেককাল একসঙ্গে রয়েছে। অথচ এদের সন্তান আসেনি। ওরা আজকাল শুধু জাবর কাটতেই ভালোবাসে। কাজ না থাকলে হাঁটু মুড়ে ঝিমোয়। কাছাকাছি থাকা ছাড়া পরস্পর সম্পর্কে কোনও আকর্ষণ নেই। দুটো পাথরের মতো, চলন্ত পাথর।

পাকা দাড়িতে হাত বোলায় অভিরাম। কোনও মেয়েছেলের শরীরে এই জীবনে যাওয়া হয়নি। আজকাল যাওয়ার ইচ্ছেটাই হয় না। শরীরের ভেতরে যে শরীর আছে তার মুখ ঠিক ব্রহ্মার মতো। একটা মুখে লোভ চটচট করে, দ্বিতীয়টায় লকলকে খিদে। যা কিছু খাওয়া যায় তাই গেলো, পেটে না যাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। পেটে গেলেও তা যেতে না যেতেই খিদে। তৃতীয় মুখে অহঙ্কারের লাল লোহা টঙ হয়ে থাকে। একটু জলের ছিটে লাগলেই ছ্যাঁক শব্দ। আর এখন চতুর্থ মুখের জিভ শুকিয়েছে, দাঁত নড়বড়ে। তার খাঁজে খাঁজে যে সুড়ঙ্গ তাতে ভয়ের বাসা। যদি সামান্য চাপেই ঝরে যায়! ন্যাংটো মাড়ি নিয়ে পালিয়ে আসা মানে নিজের অক্ষমতা পাঁচজনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। কি লাভ তাতে? ফলে অভিরামের চতুর্থ মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ, ঠোঁট দুটো টসটসে হাসিতে ভিজিয়ে রাখাই সার। দুহাতে দুটো গঁড় জড়িয়ে ধরল অভিরাম, আর দুটো বছর, দুটো বছর তোরা আমার সঙ্গে থাক। অন্তত গোটাচারেক বাচ্চা বিক্রি করতে দে। তারপর তোদের ছুটি, আমারও। যৌবনটা গেল, কখন এল টেরই পেলাম না।

এই একটা ভাবনায় স্থির হয়ে রয়েছে অভিরাম। আর দুটো বছর। তারপর ছুটি। এই জঙ্গলের শরীর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে কোথাও। কোথায়–সেইটে ঠিক নেই, তবে যাবে। জঙ্গলও তো মেয়েছেলে, বলা যায় গরম মেয়েছেলে, যতক্ষণ তার সঙ্গে তাল ঠুকতে পারবে সে রাখবে। যেই তুমি কমজোরি হলে তো তোমার পায়ের তলার মাটি সরল। তখন সরে যাওয়া ভালো। কিন্তু মুশকিল হল, এতদিনের যৌবনবেলা একসঙ্গে কাটিয়ে এই জঙ্গল বুকের গভীরে ঢুকে কখন যে সব যাওয়ার জায়গাগুলো ঢেকে দিয়েছে অন্ধকারে! বিষ, বিষের নেশার মতন। কিন্তু আর নয়। দু বছরে আরও কিছু টাকা জমিয়ে পালাবে এখান থেকে। কোনও শহর কিংবা গাঁয়ে গিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বাকি দিনগুলো খরচ করবে।

সরকারি ইজারা নেওয়া আছে। প্রতি বছর হাতি ধরে দিতে হবে। বুড়ো-হাবড়া নয়, টাটকা কিশোর। বিনিময়ে টাকা পাওয়া যাবে, অঙ্কটা যদিও মোটেই ভালো নয় কিন্তু তাই বা কে দেয়! হাতি ধরা অভিরামের পেশা। ডুয়ার্সের এই বিশাল জঙ্গল এলাকায় আজকাল হাতি থিকথিক করে। কিন্তু তাদের ধরতে যাও, তোমার চৌদ্দপুরুষের শিরদাঁড়া ভেঙে দেবে ওরা। চোরা। শিকারিরা আসে ওদের মেরে দাঁত চুরি করতে। সরকারি প্রহরীরা গুলি ছুঁড়তে পারে না ওরা বেয়াদপি করলেও। অথচ হাতিগুলো সংখ্যায় বাড়ছে। আগে ওরা বেড়াতে যেত বার্মায়। জঙ্গলে জঙ্গলে চমৎকার পথ ছিল। কিন্তু সেই পথ এখন বন্ধ। মানুষগুলো গাছ কেটে পথ হাওয়া করে দিয়েছে। ফলে এই একই জায়গায় ঘোরাফেরা। সারা বছর এই জঙ্গলে তাই খাবার জোটে না হাতির, দলবেঁধে বেরিয়ে হামলা করে তাই আশেপাশের গাঁয়ে, চা-বাগানে। লুটপাট করে, মানুষও মারে। যত দিন যাচ্ছে তত মানুষের ওপর অত্যাচার করতে ভালোবাসছে ওরা। মানুষের সবরকম প্রতিরোধের ছলাকলা ওরা জেনে ফেলেছে আজকাল। ইলেকট্রিক তারকে পর্যন্ত ভয়। পায় না, গাছের ডাল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে তার ছিঁড়ে পথ করে নেয়।

এই হাতিদের ধরতে কম পরিশ্রম আর বুদ্ধির দরকার! তাও এলোপাথাড়ি ধরলেই চলবে না, কাউকে আহত করাও চলবে না। দল থেকে টাটকা কিশোর খুঁজে ধরে নিয়ে আসতে হবে, এ যেন সাপের মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বিষের থলি সরিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার। টাকাটা ওরা মুখ দেখে দিচ্ছে না, আর এই কাজটাই করতে হয় অভিরামকে। একটাও গুলি না ছুঁড়ে, এক ফোঁটা রক্তপাত না করে হাতির বাচ্চাকে দল থেকে বের করে নিয়ে এসে সরকারের হাতে তুলে দিতে হয় আর এই কাজের সহায়ক চালার নিচে বসে থাকা কজন মানুষ আর দীর্ঘকালের পোষা হাতি দুটো।

অভিরাম চালাটার দিকে তাকাল। লোকগুলো রান্নাবান্নার আয়োজন করছে। পরনে ঢলঢলে হাফ প্যান্ট, খালি গা। ওরা আসে ভুটানের একটা পাহাড়ি গ্রাম থেকে। ওই গ্রামের মানুষগুলোর জন্মই যেন হাতির সঙ্গে পাল্লা দিতে। কলজে থেকে যেটা জন্মমাত্র ঝরিয়ে ফেলে তার নাম ভয়। এত সাহসী এবং বিনয়ী মানুষ কোথাও দ্যাখেনি অভিরাম, দুপুরুষ ধরে ওদের চেনে সে। শাসন। করলে শাসিত হয়। হুকুম ওদের কাছে শেষ কথা। বছরের শুরুতে দাদন পাঠাতে হয়। ওরা আসে। হাতি ধরে দিয়ে ফিরে যায়। না ধরতে পারলে পরের বছর ফিরে আসে অভিরামের ঋণ শোধ করতে।

মাঝে-মাঝে নিজেকে শোষক বলে মনে হয়। সামান্য কয়েকটা টাকার বিনিময়ে সে লোকগুলোকে কিনে রেখেছে। ওদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা সে জানে। খাবার ওদের কাছে স্বর্গের চেয়ে বেশি লোভনীয়। সেই খাবারের লোভ দেখিয়ে ওদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় সে। মাঝে-মাঝে অভিরামের মনে হয় এটাই নিয়ম। কেউ কাউকে নিয়ে খেলছে। যে খেলাচ্ছে তাকে নিয়েও আর একজন খেলে যাচ্ছে। এই জঙ্গলের নিয়মের রকমফের সমস্ত জগতে ছড়ানো। আর এইসব ভাবলেই বিকেলের বুদবুদগুলো বেশ ফেটে যায়।

কয়েক পা এগিয়ে অভিরাম হাঁকল, মাইনু!

হোই। সাড়া এল চালার নিচ থেকে। অভিরামকে অপেক্ষা করতে হল না, ঢলঢলে হাফপ্যান্টের তলায় লিকলিকে পায়ের জোড়া যেন উড়ে এল। বেঁটে প্রৌঢ় লোকটা ভীরু গলায় জিজ্ঞাসা করল, জি?

হাতিগুলোকে দেখতে পেয়েছিস?

হুঁ। কিন্তু ওরা মেঘ দেখে আর নড়ছেই না। আরও কাছে না এলে–।

কতক্ষণের পথ।

পুরা দিন।

হিসেবটা ভালো লাগল না অভিরামের। যেতেই যদি দিন কাবার হয়, তাহলে–। আকাশের দিকে তাকাল সে। বুড়ো মেঘেদেরও কি একই অবস্থা হয়? অভিরাম এবার ফিরল। অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। অন্তত দশ মাইলের মধ্যে দলটা যদি না আসে তাহলে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। সে হাতি দুটোর কাছে এসে ডাকল, এ্যাই, তোরা নেমে আয়।

সঙ্গে-সঙ্গে সরসর শব্দ হল। দুটো হাতির শরীর বেয়ে দুটো বেঁটে মানুষ টুক করে মাটিতে পড়ল। কাদায় ওদের মুখ চোখ দেহ প্রায় ঢাকা। সেই কাদা শুকিয়ে এঁটে বসেছে শরীরে। গত পাঁচ দিন ধরে ওরা এই অবস্থায় রয়েছে। দিনরাত ওদের হাতি দুটোর সঙ্গে থাকতে হয়। সমস্ত শরীর উদোম, শুধু কোমরে একটা কাদা মাখা কৌপিন। শিকারে যাওয়ার সময় সেটাকে খুলে যেতে হবে। এই কদিন ওদের মাছ ডিম পেঁয়াজ রসুন খাওয়া নিষেধ। এই কদিন মদ, বিড়ি, খইনি, খাওয়া কিংবা স্ত্রীসঙ্গ করা বেআইনি। অত্যন্ত পবিত্র হয়ে হাতির শরীরের গন্ধ নিজেদের শরীরে মাখতে হবে ওদের। দিনরাত হাতির সঙ্গে থেকে-থেকে মানুষের চামড়ায় হাতির গন্ধ লেগে। যাবে। এ বছর হাতি ধরার অপারেশন এই প্রথম। প্রথম দলটা যাতে কোনওভাবে অকৃতকার্য না হয় অভিরাম সে বিষয়ে সজাগ।

সে জিজ্ঞাসা করল, খেয়েছিস?

দুটো লোকই মাথা নাড়ল, না।

যা খেয়ে আয়। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় বৃষ্টি নামবে না। যদি নামে চট করে হাতির পিঠে উঠে বসবি।

সমরেশ মজুমদারের গল্প ‘অক্টোপাস’
কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের জন্মদিন আজ। ১৯৪৪ সালের ১০ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা গল্প ‘অক্টোপাস’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

একটার বয়স বছর পঁচিশ, অন্যটা তিরিশ ছাড়িয়েছে। হুকুম পাওয়া মাত্র ওরা চালাঘরের দিকে ছুটল। পঁচিশের পায়ে যেন বেশি জোর। খাওয়া বলতে আলুসেদ্ধ নুন আর ফেনাভাত। যদ্দিন হাতি না ধরা পড়ে অন্যরাও চেষ্টা করে এই খেতে।

ওপাশের জঙ্গলে হাসির রোল উঠল। তারপরেই ওদের তিনজনকে দেখা গেল জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। মাথায় ঝাঁকা, তাতে নানান ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। দুটি কিশোরী আর একটি যুবতী। অভিরামকে দেখে এগিয়ে এসে ঝাঁকা নামিয়ে বলল, হিসেব মিলিয়ে নে।

অভিরাম হেসে তার পাকা দাড়িতে হাত বোলালো। এই জঙ্গলে বাস করতে গেলে যেসব জিনিস একান্ত প্রয়োজন তাই রয়েছে ঝাঁকায়। জঙ্গলের গায়ে যে ছোট্ট লেপচা গ্রাম সেখান থেকেই আসে এই সওদাগুলো। ওই যুবতীর বাবার একটি শীর্ণ মুদির দোকান আছে ওখানে। সে বলল, চুরি করলে তুই করবি, তোর বাবা তো চোর নয়। যা ওখানে পৌঁছে দিয়ে আয়।

যুবতী ঠোঁট ওলটালো, তারপর সঙ্গীদের ঝাঁকা তুলতে ইশারা করা মাত্রই অভিরাম বাধা দিল, না, তুই না, ওরা যাক।

আমি না কেন?

তোকে দেখলে যদি ওদের বুকে ঢেউ লাগে! অভিরাম হাসল।

ঢেউ তো ওঠে নদীতে। ওরা তো ডোবাও না।

কী জানি! তোদের বিশ্বাস নেই। ডোবাকেও সমুদ্র করে দিতে পারিস। তুই আমার সঙ্গে আয়, দাম নিয়ে যা। ওরা চালাতে মাল দিয়ে আসুক। অভিরাম তাঁবুর দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার কথা শুনে যুবতীর মুখে কালো ছায়া নেমেছে সেটা তার নজর এড়ায়নি। না, ওর এখানে আসা বন্ধ করতে হবে। ওর বাপকে খবর পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। মুশকিল হল ওই গ্রামে ছেলের। চেয়ে মেয়ের সংখ্যাই বেশি। তারপরেই অভিরাম হেসে ফেলল। সে বোকার মতো এসব ভাবছে। তার কর্মচারীরা আধবেলা খেয়ে থাকে, গ্রামে, কেউ-কেউ জীবনেও শহর দ্যাখেনি, কৌপিন। কিংবা হাফপ্যান্ট ছাড়া পোশাক নেই অঙ্গে, ওদের প্রেমে পড়বে এই যুবতী? অসম্ভব। যতই গরিব হোক, ঠাট-বাট আর অহঙ্কারটি এর ষোলআনা খাঁটি।

তাঁবুতে ঢুকে ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে-করতে যুবতী পরদা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। অভিরাম জিজ্ঞাসা করল, কত টাকা বলেছে তোর বাপ?

কুড়ি।

অভিরাম চোখ তুলে তাকাতেই বুকের ভেতর ঢেউটাকে টের পেল। মেয়েটা তাঁবুতে ঢুকেই খাঁটিয়ায় বসেছে। ওর বুকের খাঁজ দেখতে পাচ্ছে অভিরাম। টাইট জামার ওপর যে কালো ওড়না সেটা সময় বুঝে সামান্য সরে গেছে। অনেক অনেকদিন পরে যুবতীর বুকের দিকে তাকিয়ে অভিরামের শরীর বেইমানি করল। যেন পূর্ণ চাঁদের আকর্ষণে তার শরীরের শিরায়-শিরায়। জোয়ারের টান লেগে গেল আচমকা।

টাকা দে।

অভিরামের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। তার বয়স হয়েছে ঠিক কিন্তু সত্যিকারের বুড়ো তো হয়ে যায়নি। যা টাকা জমেছে আর দুবছরে যা জমবে তাই নিয়ে এইরকম একটা যুবতীর সঙ্গে বাকি জীবনটা যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সে কিছুই বলল না, চুপচাপ টাকাটা দিয়ে দিল।

যুবতী জামার মধ্যে সেটাকে চালান করে দিয়ে বলল, হাতি ধরবি কবে? যদি বৃষ্টি নানামে তাহলে কাল–।

হায় ভগবান, যেন বৃষ্টি নামে। খুব-খুব। তারপর শরীর দুলিয়ে বেরিয়ে গেল তাঁবু থেকে।

অভিরামের স্থির হতে সময় লাগল। কিন্তু তার মনে একটা তিরতিরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। তার শরীর বিকল হয়নি, আঃ!

জি।

বাইরে থেকে গলা ভেসে আসতেই অভিরাম বাইরে এল। বুড়ো সর্দার মাইনু একটু উত্তেজিত গলায় জানাল, হাতিগুলো আরও সরে এসেছে। এখন মাত্র আধ বেলার পথ।

অভিরামের ঠোঁটে হাসি ফুটল। মুখে বলল, সাবাস!

মাঝখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তিনজন পাহারা দিচ্ছে তিনদিকে। অবশ্য সেটার যে খুব দরকার পড়ে তা নয়। বন্যজন্তুর পা একদিকে পড়লেই হাতি দুটো চঞ্চল হয়ে ওঠে। তবু ব্যাটাদের বয়স হয়েছে বলেই অভিরামের ঠিক ভরসা হয় না। অভিরামের সামনে দুজন দাঁড়িয়ে। অভিরাম কথা বলছিল, আমি আর নতুন কি বোঝাব তোদের। মাইনুর কাছে তো সব জেনেছিস। শুধু লক্ষ রাখবি হাতিটা যেন ছটফটে আর তাগড়াই হয়। তুই তো এর আগেও গিয়েছিস, তোকে নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু তুই ভয় পাচ্ছিস না তো?

পঁচিশ বছরের মাথাটা দ্রুত আপত্তি জানাল, না।

একটুও ভয় পাবি না। তুই হীরামতির ওপর ছেড়ে দিবি। সে তাকে ঠিক দলের মধ্যে নিয়ে যাবে। যা, এখন শুয়ে পড়। আজকের রাত্রে তোদের ঘুম দরকার। ঠিক চারটের সময় রওনা হতে হবে। মাইনু! অভিরাম পেছন ফিরল।

জি!

খাদ ঠিকমতো ঢেকে রেখেছিস?

জি।

অভিরাম তাঁবুতে ফিরে এল। আর তখনই টপটপিয়ে বৃষ্টি নামল। অভিরামের কপালে ভাঁজ পড়ল। বৃষ্টির ধাক্কায় হাতিগুলো আবার দূরে সরে যায়! অভিরাম খাঁটিয়ায় শরীর এলিয়ে দিতেই মনে পড়ল যুবতী এখানে বসেছিল। তার মন চনচনিয়ে উঠলেও শরীরে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ব্যাপারটা যত সে ভাবছিল তত বুকের ওপর একটা পাথর চেপে বসছিল। নিজেকে অক্ষম ভাবতে তার একটুও ভালো লাগছিল না। খাঁটিয়ায় উঠে বসল অভিরাম। এখনই একটা ছাতি নিয়ে বেরিয়ে গেলে কেমন হয়! সোজা গিয়ে যুবতীর বাবাকে প্রস্তাব দেবে, আমি তোমার মুদির দোকানটাকে ভালোেমতন সাজিয়ে দিচ্ছি, তুমি তোমার মেয়েটাকে আমায় দাও। আমি দেখতে বুড়ো কিন্তু আমি সত্যিকারের বুড়ো নই। আর যেটুকু বুড়োটে দেখায় তোমার মেয়েকে পেলে সেটাও চলে যাবে।

অভিরাম হাসল। ঠিক কথা। ও মেয়ে সঙ্গে থাকলে যৌবন ফেরত আসতে বাধ্য। আজ যখন তাঁবুর ভেতরে ঢুকেছিল তখনই নাকে বাস এসেছিল। না, কোনও দোকানি গন্ধ নয়, স্রেফ যৌবনের বাস। সব মেয়ের শরীরে ওই বাস থাকে না। যার থাকে তার গায়ে গা ছোঁয়ালে যৌবন ফেরত আসতে বাধ্য।

বৃষ্টিটা বাড়ছে কমছে। কাল বিকেলে হাতির বাচ্চাটাকে নিয়ে ওই গ্রামে যেতে হবে। তার সম্পত্তি তার বীরত্ব তার। একটু থমকে গেল অভিরাম। যুব তাঁকে বোঝাতে হবে, যে শত্রুর সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ করে তার চেয়ে যে তাকে পেছন থেকে হুকুম করে সে অনেক বড় বীর। আর তখনই এক ফাঁকে প্রস্তাবটা দিয়ে দেবে সে। আজ রাত্রে গেলে তো খালি হাতে যেতে হবে। অভিরাম শুয়ে পড়ল আবার, আজকাল শরীর এলিয়ে শুলে বেশ আরাম লাগে।

এখনও আকাশে মেঘ। তবে বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে। পায়ের তলায় ঘাস ভিজে চপচপে। গাছের ডাল থেকে জল ঝরছে টুপটুপিয়ে। নিভে যাওয়া রাতের আগুনটাকে নতুন করে জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। দুটো হাতি এখন হাঁটু মুড়ে বসে আছে মাঝখানে। ওদের পা থেকে লোহার শেকল খুলে দেওয়া হয়েছে। অভিরাম ইশারা করতে লোক দুটো হাতির পিঠে চড়ে বসল। তারপর দুহাতে কৌপিন খুলে ছুঁড়ে দিল সঙ্গীদের সামনে। মাইনু এগিয়ে গেল ওদের মাঝখানে। ওর হাতে গোল করে পাকানো শক্ত দড়ি যার একপ্রান্তে বড় ফাঁস। দুজনই দুটো হাতির ঠিক মাথার নিচে এমনভাবে বসল যাতে দুটো পা টানটান করে ছড়াতে হাতির কানের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। হাত বাড়িয়ে মাইনুর হাত থেকে দড়ি নিল দুজন। দুটো বারো হাত লম্বা দড়ি কায়দা করে গোটানো। ওরা। দড়িজোড়া যে যার পেটের তলায় এমন গুছিয়ে রাখল যাতে তার কোনও অংশ বাইরে থেকে না দেখা যায়। তারপর বসা অবস্থায় শরীরটাকে মিশিয়ে দিল উপুড় হয়ে হাতির মাথায়। শুধু চিবুকটা মাথার খাঁজে ঢুকিয়ে ওরা দেখার সুবিধে করে নিল। হীরামন আর হীরামতি নির্বিকার। এই মানুষ দুটো তাদের শরীরে এই কদিন ধরে শোওয়া-বসা করায় ওদের ওজন নিয়ে আর ওরা বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না। অভিরাম লোক দুটোকে শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে একটা কথা না। বলেও ওই হীরামন হীরামতিকে সব কথা বোঝানো যায়। ওই যে দুটো পা দুই কানের নিচে ঢোকানো সেখানেই আছে হাতিকে নির্দেশ দেওয়ার কায়দা। বাঁ-দিকে যেতে চাও বাঁ-পা দিয়ে টোকা দাও, ডানদিকে তো ডান কানে। দু-পা একসঙ্গে সোজা সামনে। আর দু-পা একসঙ্গে কানের পেছনে ঘষলে হাতি বুঝবে আর এগোতে হবে না, সামনে বিপদ।

হাতির উদোম পিঠে যে নগ্ন মানুষ দুটো বসে আছে তাদের সামনে আঁকড়ে ধরার কিছু নেই। দুটো হাত হাতির মাথার খাঁজে এমনভাবে রাখতে হবে যে সেটাই তোমার ব্যালেন্সের কাজ করবে। তবে দীর্ঘকালের অভ্যেসে হাতির পিঠে ওইভাবে বসে থাকার জন্যে কিছু ধরার দরকার ওদের হয় না।

মাইনু চিৎকার করে ওদের ভাষায় কিছু বলল। লোক দুটো সেই সঙ্গে মাথা নাড়ল। অভিরাম জানে এটা মন্ত্রপাঠ, যাতে ওদের কার্যসিদ্ধি হয়। ওরা যাবে জঙ্গলের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান প্রাণীর মাঝখানে। খুব বোকামি না করলে অবশ্য প্রাণের আশঙ্কা নেই। তবু বুনো হাতির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে বুকের জোর লাগে। একটু বেচাল হল তো সব শেষ।

অভিরাম সংকেত করামাত্র হাতি দুটো উঠে দাঁড়াল। বুড়ো শরীরে সেই চনমনানি নেই। শরীর সোজা করে উঠতেও কষ্ট হয়। ওরা দাঁড়ালে অভিরাম ঘুরে-ঘুরে পরীক্ষা করল। না, লোক দুটোকে দেখা যাচ্ছে না, হাতির শরীরে মিশে গিয়েছে ওরা। অভিরাম দেখল হীরামন আর হীরামতি তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। যেন বনবাসে পাঠাচ্ছে ওদের এইরকম চাহনি। আজ ওদের কোথায় যেতে হবে সে সম্পর্কে ওরা সচেতন। এই যাওয়াটা মোটেই পছন্দ করছে না ওরা। একদল যৌবনের মাঝখানে মতলবে যেতে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার একটুও ইচ্ছে করছে না। অভিরাম বুঝল। তারপর এগিয়ে গেল ওদের সামনে। দুটো শুড় উঠে এল ওর কাঁধে। অবসন্নভাবে হেলান দিল তার কাঁধে। যেন বলছে, আর কত ঝুঁকি নেব তোমার জন্যে!

চাপা গলায় নির্দেশ দিতেই দুটো হাতি যাত্রা শুরু করল। ডানদিকের জঙ্গলের পথে ঢুকে গেল ওরা। না, শিকারি দুজনকে কিছুতেই দেখতে পাবে না বুনো হাতির দল। হাতির শরীরের সঙ্গে চমৎকার মিশে আছে। নিশ্চিন্ত হল অভিরাম। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তবু অভিরাম বাকি দল নিয়ে চলল বাঁ দিকের পথটা ধরে। পায়ের তলায় প্যাঁচপেচে জল, ওপরের জঙ্গলের গা থেকেও। জল ঝরছে। এখন সারা শরীরে জোঁক ঝুলছে কিন্তু কিছু করার নেই। মেঘ না থাকলে পথটা দেখা যেত, এখন আন্দাজে যাওয়া। যেতে হবে যেখানে মাইনুরা দক্ষ হাতে গর্ত করে ঢেকে রেখেছে। জায়গাটা এমন নির্বাচন করা হয়েছে যাতে তার চারপাশে গাছ থাকে। সেই গাছের ডালে লুকিয়ে বসে থাকতে হবে যতক্ষণ না শিকার আসে।

হীরামন-হীরামতি তো ভয় পাবেই। বুনো হাতির দল যদি বুঝতে পারে ওরা পোষা তাহলে ছিঁড়ে ফেলবে। দুই বুড়ো-বুড়ির তো নড়বার ক্ষমতা নেই। কিন্তু ওরা অভিনয় করতে জানে। এখন বোধহয় আর নিজেদের ওপর ঠিক ভরসা রাখতে পারছে না।

মানসচোখে দেখতে পাচ্ছে অভিরাম। হীরামন আর হীরামতি নিঃশব্দে দলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দলটার কাছাকাছিনা পৌঁছনো পর্যন্ত ওরা থামবে না। জঙ্গলের যেখানে বুনো হাতির দলটা রয়েছে তার কাছে গিয়ে ওরা লক্ষ করবে তারা কী করছে। সাধারণত সকালের দিকে। হাতিরা একটু অলস থাকে। গাছপালা ভাঙে, পাতা খায়। ছোটরা খুনসুঁটি করে। সদ্য কিশোর যারা তারা ছটফটিয়ে এপাশ-ওপাশ যায়, আবার দলে ফিরে আসে। দলের যিনি নেত্রী তিনি পাতা খেতে-খেতে উদাস চোখে তাকিয়ে দ্যাখেন সবাই ঠিক আছে কিনা। তাঁর কাছাকাছি থাকে সেই দাঁতাল পুরুষটি। হস্তিনীর সেবক এবং স্বামী। উঠতি ছোঁকরাদের সম্পর্কে তার বেশ বিরক্তি। এরাই সামান্য বড় হলে তার পদটি বিপন্ন হতে পারে। কোনওরকমে এদের দল থেকে কাটিয়ে দিতে পারলে সে খুশি হয়। কিন্তু নেত্রীর সামনে সেটা প্রকাশ করতে পারে না সে। তাকে সবসময় সজাগ থাকতে হয়। যে-কোনও মুহূর্তে নেত্রীর হুকুমে শত্রুর মোকাবিলা করতে হতে পারে! এমনকী চিবোবার সময়েও সে চোখ বন্ধ করার সুযোগ পায় না।

হীরামন আর হীরামতি যখন বোঝে দলটা অলস হয়ে আছে তখন তারা আলাদা হয়ে এগোয়। যেতে যেতে ডাল ভাঙে, পাতা চিবোয়, যেন কোনও মতলব নেই এমন ভঙ্গিতে পা ফেলে। দলের হাতিরা তাদের দিকে তাকালে এমন অভিনয় করে যে ওরা বাইরের কেউ নয়। কিন্তু ওদের লক্ষ থাকে নেত্রীর দিকে। খুব সাবধানে তাকে এড়িয়ে ওরা দলে মেশে। কিছুক্ষণ কাটানোর পর সংকেত পায় কানের তলায়, কোনদিকে তাদের যেতে হবে। ওই যে চঞ্চল কিশোরটি দল থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে সাহসী পায়ে, তার দিকে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে ওপরের মানুষ। অথচ চটপট পায়ে গেলে চলবে না। কেউ যাতে সন্দিগ্ধ না হয় এইভাবে ওই কিশোর হাতির পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সেই মুহূর্তে ওরা দুজন কিশোরের দুই পাশে। কিশোর মনের আনন্দে ডাল ভাঙছে। ওরা শরীরের পেছনদিকটা দিয়ে একসঙ্গে চাপ দিতেই কিশোর সামনে এগিয়ে যাবে। স্বভাবতই সে বিরক্ত হবে কিন্তু যখন দেখবে ওরাও পাতা ছিঁড়ছে তখন সে আর একটু এগিয়ে পাতায় শুড় দেবে এই ভেবে যে দলটা তার সঙ্গে আছে। মিনিটখানেক অপেক্ষা করার পর আবার একই কৌশল। দুপাশ ঘিরে পেছনে চাপ দিলে কিশোর সন্মুখগামী হবেই। এইভাবে অন্তত আধঘন্টার পর ওকে বের করে আনবে হীরামন আর হীরামতি। এই সময় লক্ষ রাখতে হবে দলের কেউ যেন সন্দেহ না করে। কিশোর যেন বিদ্রোহ না করে বসে। একটু নিরাপদ সীমায় আসা মাত্র মানুষ দুটো আচমকা খাড়া হয়ে বসে চিৎকার করে উঠবে। অনেক-অনেক ট্রেনিং নিতে হয় ওই চিৎকার নিখুঁত করার জন্যে। শব্দটা অবিকল কোনও হাতি বিপদে পড়লে করে থাকে। সেটা কানে যাওয়ামাত্র কিশোর ভাববে সেও বিপদে পড়েছে। তৎক্ষণাৎ সে শুড় তুলে। চিৎকার করতে চাইবে। যেই তার শুড় ওপরে উঠবে অমনি দুটো দড়ির ফাঁস তাতে গলিয়ে দেবে মানুষ দুটো। ভয় পেয়ে খুঁড় নামিয়ে নেওয়া মাত্র কিশোরের গলায় ফাঁস এঁটে বসবে। তৎক্ষণাৎ ছুটতে শুরু করবে হীরামন আর হীরামতি। দৌড়াবার সময় তারা দড়ির দুই প্রান্ত নিজেদের মুখে নিয়ে নেয়। ওপরের মানুষ দুটো কোনওক্রমে ঝুলে থাকে তাদের শরীরে। দড়ির টান লাগামাত্র কিশোর ছুটতে থাকে মাঝখানে। তখনও ধারণা যে সে সঙ্গীদের সঙ্গে আছে। এই দৌড় চলবে সেই লুকানো খাদ পর্যন্ত। সেখানে এসে এই খাদের দুইপাশ দিয়ে দৌড়য়। আর কিশোর হুড়মুড়িয়ে পড়ে গোপন ফাঁদে। তখনই চটপট নেমে আসে অভিরামরা, গর্তে পড়ে যাওয়া হাতিটাকে সুন্দর করে ঢেকে দিয়ে সরে যায় আরও দূরে। বিশেষ করে দাঁতাল যদি বুঝতে পারে কিশোর হাতিটি বিপদে পড়েছে তাহলে সে সরে যাওয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেবে এই ভেবে যে তার একটি ভাবী প্রতিদ্বন্দ্বী কমে গেল। এইবার ফাঁদে পড়ে থাকা কিশোরটিকে কজা। করা অভিরামদের কাছে কিছুই নয়। এই অভিযানে মানুষ এবং হাতি দুটোর বুদ্ধির সমন্বয় থাকা। দরকার। হীরামন আর হীরামতির ওপর অভিরামের ভরসা আছে। বুনোদের দলে মিশে যাওয়ার সময়টাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। তার ওপর ওই পঁচিশ বছরের ছেলেটি আজ প্রথম যাচ্ছে। অভিরাম মাইনুকে জিজ্ঞাসা করল, নতুন ছোঁকরাটা পারবে তো?

মাইনু লাল দাঁতে হাসল, ওর বাপ কত বড় শিকারি ছিল আর ও পারবে না!

অভিরাম মাথা নাড়ল। ছিল কথাটায় তার মোটেই আস্থা নেই। তারও তো যৌবন ছিল। সে সময়টা জঙ্গলে-জঙ্গলে গাছের নেশায় কেটে গেল। আজ যুব তাঁকে দেখার পর থেকেই সেই যৌবনটা ল্যাজ নাড়ছে শরীরে কিন্তু তাই বলে কি সে যুবকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে? বাপ শিকারি ছিল বলেই ছেলে পারবে এমন নাও হতে পারে। দুটো লোকের কাঁধে চেপে অভিরাম গাছের ডালে উঠল। দুটো ডাল গুলতির বাঁটের মতো ছড়ানো। সেখানে বসে হাঁপ ছাড়ল সে। এখন এখানে অনন্তকাল বসে থাকতে হবে। হৃৎপিণ্ড শান্ত হতেই চোখের সামনে যুবতীর শরীরটা ভেসে উঠল। হাতিটা ধরা পড়া মাত্রই প্রস্তাবটা পেশ করবে সে। শরীরে বড় নেশা ধরেছে, এই নেশা নিয়ে মরেও সুখ নেই।

হীরামন আর হীরামতি আগু পিছু হাঁটছিল। মাঝে-মাঝে ড় তুলে বাতাস যাচাই করে পথ পালটাচ্ছে। এই মেঘবৃষ্টিতে ওদের হাঁটতে মোটেই ভালো লাগছিল না। মাঝে-মাঝে পিছু ফিরে হীরামন হীরামতির শুঁড় জড়িয়ে ধরছিল। একবার জঙ্গলে ঢুকে গেলে কথা বলা নিষেধ। তবু পঁচিশ বছর চাপা গলায় বলল, এ দুটো ঠিক ভয় পেয়েছে মনে হয়।

বয়স্ক পুরুষটি জবাব দিল না। শুধু জিভে যে শব্দ করল তার অর্থ, কথা বলবি না। দুটো পা কানের তলায় চালিয়ে শরীর বেঁকিয়ে পঁচিশ বছর হাতির মাথায় চিবুক রেখে জিভ কাটল, কথা বলা নিষেধ সে ভুলে গিয়েছিল। অনেক কিছু সে ভুলেছিল কাল রাত্রে, এটা তো তার কাছে কিছুই না। কিন্তু হাতি দুটো ভয় পেয়েছে সেটা ওদের শরীরের কাঁপুনিতে মালুম হচ্ছে।

অনেকক্ষণ যাওয়ার পর জঙ্গলটা যখন আরও ঘন তখন হীরামন আর হীরামতি থমকে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে শব্দ করল। মানুষ দুটো কান পাতল। দূরে গাছভাঙার শব্দ হচ্ছে। সারাটা পথ মাথার ওপর ভিজে গাছে বসে পাখিরা চিৎকার করেছে, বানরগুলো ছটফটিয়েছে। হাতির ওপর মানুষ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝেই ওদের অস্বস্তি। এখানে জঙ্গল বেশ ঘন। বয়স্ক মানুষটি সন্তর্পণে হীরামনের কানের তলায় পায়ের আঙুলের ডগা দিয়ে সঙ্কেত করামাত্র হাতিটা সোজা হাঁটতে লাগল। দেখাদেখি পঁচিশ বছর হীরামতিকে নিয়ে এল পাশে। হাতিদুটো নির্লিপ্ত হয়ে ডাল ভাঙছে। পাতা খাচ্ছে। মেপে-মেপে এগোচ্ছে। হঠাৎ একটা বাচ্চা হাতিকে দেখতে পেল ওরা। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে হীরামনদের দেখে থমকে গেল। তারপর আবার সহজ হয়ে একটা ডাল ভেঙে ফিরে গেল ভেতরে।

এখান থেকে হীরামন সরে গেল হীরামতির কাছ থেকে। বয়স্ক পুরুষটি ধীরে-ধীরে হীরামনকে জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে নিতেই দেখল গোটা বারো বুনো হাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাতা খাচ্ছে, গাছ। ভাঙছে। সে যে দলে ঢুকছে সেটা কেউ খেয়াল পর্যন্ত করল না। আটটা বড় আর চারটে বাচ্চা। সে দলনেত্রীটাকে খুঁজে বের করল। ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাতা চিবোচ্ছে! তার ঠিক সামনেই। দাঁতালটা। হীরামন ওদিকে যাবে না। সে ধীরে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস শব্দ করল দুবার। লোকটি বুঝতে পারছিল না হীরামনের মতলব। বুনো হাতি দেখে অন্য কোনও ইচ্ছে হচ্ছে নাকি! তারপরেই সে কিশোরটিকে দেখতে পেল। বেশ বেপরোয়া ভাব। বারংবার দল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বয়স্ক লোকটি হীরামনকে সেদিকে নিয়ে যাওয়া স্থির করল। হীরামন এখন অভিনয় করছে। পাতা ছিঁড়ছে আর মুখে পুরছে। কিন্তু একা গেলে চলবে না। বয়স্ক লোকটি সামান্য মুখ ফিরিয়ে হীরামতিকে খুঁজতে লাগল।

হীরামতি ওপাশ দিয়ে দলে ঢুকছে। শুড় তুলে একটা গাছের পাতা ধরল। তার ওপরে পঁচিশ বছর যে শুয়ে রয়েছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। এবার হীরামনকে সে কিশোরের দিকে নিয়ে এল। ওর যাওয়া দেখে হীরামতিকে নিশ্চয়ই পঁচিশ বছর এদিকে আনবে। তাদের শিকার কোনজন বুঝে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু হঠাৎ দলনেত্রীকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখল বয়স্ক লোকটি। হাতিটার চেহারা চট করে পালটে গেল। শুড় ওপরে তুলে যেন বাতাসে একটা ঘ্রাণ খুঁজতে চাইল। তারপর দুপা এগিয়ে আবার। বাতাস টেনে হুঙ্কার ছাড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে দাঁতালটা ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুতপায়ে সে ছুটে এল নেত্রীর পাশে। বয়স্ক লোকটি বুঝতেই পারছিল না এইরকম কেন হচ্ছে। তার বুক কেঁপে উঠল। সে দেখল হীরামতি যেন অস্বস্তিতে পড়েছে। একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে সে। দলনেত্রীর লক্ষবস্তু যে সে, তা টের পেয়েছে হীরামতি। এই সময় নেত্রী চেঁচিয়ে উঠতেই হীরামতি ঘুরে দৌড়তে আরম্ভ করল। সঙ্গে-সঙ্গে দাঁতালটা ছুটল তার পিছে। বাকি দলটাও অনুসরণ করল ওদের।

বয়স্ক লোকটি জানে এখন অন্য কোনও আচরণ করা যাবে না। তাকেও দলের সঙ্গে ছুটতে হবে। এবং এই অবস্থায় পঁচিশ বছরকে সাহায্য করার কোনও সুযোগই নেই। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না কী করে হীরামতি ধরা পড়ল। তার দিকে তো কেউ লক্ষই করছে না। হীরামনের পা দ্রুত চলছিল, যেন হীরামতিকে বাঁচাতে সে উদ্দাম হয়ে উঠছিল। ওদিকে হীরামতি ছুটছে প্রাণের দায়ে। তার ওপর ওই অবস্থায় বসে থাকতে পারল না পঁচিশ বছর। হাত বাড়িয়ে একটা ডাল ধরতে গিয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে-সঙ্গে দাঁতালটা তাকে খুঁড়ে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল দলনেত্রীর সামনে। বয়স্ক লোকটি চোখ বন্ধ করার শক্তিও পেল না। হীরামতি ততক্ষণে চোখের বাইরে। পুরো দলটা থমকে দাঁড়িয়েছে দেখে হীরামন শান্ত হল।

পঁচিশ বছর কোনও আওয়াজ করল না। দলনেত্রীর ভারী পা যখন তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে তখন দলটা আবার সহজ হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে ওরা আবার। জঙ্গলে ঢুকে যেতে লাগল। দলনেত্রী এবং দাঁতাল আগে-আগে যাচ্ছে। এই জায়গাটা নিরাপদ নয় সেটা বুঝতে পারছিল বোবাধহয়।

ক্যাম্পে এখন শোকের ছায়া। পাঁচটা মানুষ পাথরের মতো বসে আছে। খুঁটিতে হীরামন আর হীরামতি চেনে বাঁধা। হীরামতি ছটফট করছে আর তার শরীরে শুঁড় রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে হীরামন। অভিরাম দাড়িতে হাত বোলাচ্ছিল। তার সামনে বস্তায় জড়ানো পঁচিশ বছরের শরীরের অবশিষ্ট। বারংবার সে বয়স্ক পুরুষটির কাছে বৃত্তান্ত জেনেছে। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। ওরা হীরামতিকে কী করে আবিষ্কার করল। হীরামতির শরীরটাকে সে ভালো করে যাচাই করছে। কোনও খুঁত নেই। কোনও চিহ্ন নেই যা ওকে ধরিয়ে দিতে পারে।

অভিরাম ডাকল, মাইনু!

জি। প্রৌঢ় বেঁটে শরীরটা সাড়া দিল। দল থেকে উঠে এল না।

ও কি মাছ ডিম রসুন পেঁয়াজ খেয়েছিল?

না। ওসব আমরা সাতদিন খাইনি।

 হাড়িয়া? নেশা করেছিল?

না। করলে আমি জানতে পারতাম। জানলে পাঠাতাম না।

তাহলে কী করে হাতিগুলো ওকে ধরল? কারণটা কী?

আমি জানি না। এখন ওর মাকে কী জবাব দেব গ্রামে ফিরে গিয়ে!

অভিরাম জানে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। থানায় জানাতে হবে। কিন্তু কী করে এমন হল সেটা না। জানা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। সে বয়স্ক লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, কাল সারারাত ও হাতির পিঠে ছিল?

লোকটা ভাবল একটু। তারপর বলল, মাঝরাত্রে নেমেছিল।

কেন?

পায়খানায় যাবে বলে।

কতক্ষণ পরে ফিরেছিল?

একঘণ্টা হবে।

সময়ের মাপটা এদের কখনই ঠিক হয় না অভিরাম জানে। তার সব প্ল্যান আজ নষ্ট হয়ে গেল। এবছর আর এই দলকে হাতি ধরতে পাঠানো যাবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু কারণটা জানা দরকার, অথচ সে জানতে পারছে না।

মৃত্যু-খবর মানুষকে চিরকাল উৎসাহিত করে। থানায় খবর দিতে লোক পাঠিয়েছে অভিরাম। তার কাছেই গ্রামের মানুষ জেনেছে হাতির বাচ্চা ধরা পড়েনি বরং একজনকে মেরে ফেলেছে। বিকেলে ওদের অনেকে জঙ্গলে এল। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ছেলেটা বড় ভালো ছিল। গতবারও দেখেছি, বেজাত হলে কী হবে মুখটা ভারি মিষ্টি ছিল।

তোমাদের গাঁয়ে যেত নাকি?

গতবার খুব যেত। এবার দুই-একবার।

অভিরামের কপালে ভাঁজ পড়ল, কার কাছে যেত?

ঠিক কারও কাছে না। মুদির দোকানে বসে থাকত।

মুদির মেয়ের সঙ্গে কথা বলত?

যৌবনের ধর্মই তো কথা বলার।

অভিরামের বুকের মধ্যে ছোবল মারল কালকেউটে। টর্চ হাতে সে হাঁটতে লাগল গ্রামের দিকে। গ্রামে ঢোকার মুখেই সাঁকো। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। হঠাৎ টর্চের আলোর বৃত্তে মূর্তিটাকে নজরে পড়ল। ঝরনার গায়ে একটা পাথরের ওপর যুবতী স্থির হয়ে বসে আছে। একা।

অভিরামের বুকের মধ্যে যেন ঝরনাটা উঠে এসেছে। বুড়ো কলজে কলকল করছে। সে টর্চনা নিভিয়ে এগিয়ে যেতেই মুখ ফেরাল মেয়েটি, চোখ ঢাকল।

এবার টর্চ নেভাল অভিরাম, তুই এখানে?

জবাব দিল না যুবতী। তারপর উঠে দাঁড়াল।

তুই লোকটাকে চিনতিস?

কোন লোক? যুবতীর গলায় কাঁপন।

যে আজ মরলা!

হ্যাঁ।

কাল রাত্রে তোর কাছে এসেছিল?

হ্যাঁ।

কোথায়?

এখানে।

কী করেছিলি তোরা?

এবার অদ্ভুত একটা শব্দ এল, পুরুষেরা যা করে।

অভিরামের হৃদপিণ্ড নড়তে লাগল, তুই জানতিস না শিকারে যাওয়ার আগে ওসব করতে নেই? শরীরে যৌবন লেগে থাকলে তা বাতাসে ভাসে?

আমি না বলেছিলাম, ও শোনেনি। বলল, যদি না ফিরি তাহলে সাধ ঘুচবে না ওর।

অভিরামের জিভ শুকিয়ে গেল, তুই ওকে মেরে ফেললি!

আমি না, ওর যৌবন।

হিলহিলে শীত অভিরামের শরীরে খেলা শুরু করল। একটু উত্তাপ নেই। তার অঙ্গে যৌবনের সামান্য দপদপানি বন্ধ হয়ে গেছে আচমকা।

যুবতী দুপা এগিয়ে এল, কে টের পেয়েছিল? হাতি না হস্তিণী?

হস্তিণী। অভিরাম বিড়বিড় করল, মেয়েরাই তো মেয়েদের টের পায়।

ওদিকে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। যারা জঙ্গলে গিয়েছিল মৃত্যুসংবাদ শুনে তারা ফিরে আসছে। যুবতী ঘুরে দাঁড়াল, বলো সত্যি কি আমি দোষী?

দোষ? অভিরাম শূন্য চোখে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে উলটোপথে হাঁটতে লাগল। প্রত্যেকটা

পদক্ষেপ তাকে শীতল থেকে শীতলতর করছিল। তবু যুবতীর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার মধ্যে সে আর এক ধরনের আরামের সন্ধান পেল। সেই উৎসাহটা শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। কিছু ছেড়ে গেলে এত মুক্ত লাগে!